Unveiling the Enchanting Journey of a 14-Year-Old & Discover Life's Secrets Through 'My Slice of Life'. Grab it NOW!!
Unveiling the Enchanting Journey of a 14-Year-Old & Discover Life's Secrets Through 'My Slice of Life'. Grab it NOW!!

Indrani Bhattacharyya

Drama Tragedy Others

4.5  

Indrani Bhattacharyya

Drama Tragedy Others

রূপান্তর

রূপান্তর

11 mins
12.1K


(১)


ভি আই পি রোডের জ্যামটা আজকাল বড্ড ভোগাচ্ছে। আর ঘন্টা দেড়েক পরেই তিন্নির ফ্লাইট ল্যান্ড করে যাবে। অথচ এখনো কেষ্টপুর ছাড়াতে পারলো না গাড়িটা।গাড়িতে বসে বসে উদ্বেগে বারবার মোবাইলের স্ক্রিনে ঘড়ির কাঁটা গুনছিল সোমা। পাশে বসে শুভঙ্কর মানে শুভঙ্কর রায়।মাস তিনেক হলো অবসর নিয়েছেন ব্যস্ত কর্মজীবন থেকে। আপাতত তাঁর চোঁখ আটকে রয়েছে উইন্ড স্ক্রিনে আর মন আচ্ছন্ন নানা স্মৃতির ভিড়ে। 


অবশেষে বেশ কিছুটা সময় হাতে নিয়েই পৌঁছলো গাড়ি ।এতক্ষনে হাসি ফুটেছে সোমার মুখে।সদালাপি সোমা ওয়েটিং রুমে ইতিমধ্যেই গল্প জমিয়ে ফেলেছেন তাঁদের মতোই আরেক অপেক্ষমান দম্পতির সাথে। 


নির্দিষ্ট সময়েই রানওয়ে ছুঁলো এমিরেটসের বিমান। একে একে এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ ছেড়ে বেরোতে লাগলো যাত্রীরা। তিন্নি মানে তন্নিষ্ঠা রায় বেরিয়ে এলো বেশ কিছু সময় পর। বহুক্ষণের বিমান যাত্রার ক্লান্তি আর ঘরে ফেরার আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছিল চোখে-মুখে। সোমা তো চিনতেই পারেনি প্রথমে। তিন্নিই প্রথম ডাকে।দেখে চমকে উঠেছিল আর তারপরেই একরাশ আক্ষেপ মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল- "কি রে এতো সুন্দর চুল কেটে ফেললি ?". তিন্নিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শুভঙ্কর তাড়া দিয়ে নিয়ে গেলো পার্কিং লটের দিকে। 


বিশ্ব বাংলা সরণি হয়ে গাড়ি ছুটতে লাগলো পাটুলির পথে। ফেরার সময় রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই ছিল। তাই ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়তে পারলো তারা । 


তাদের ফ্ল্যাটটা গোটা আবাসনের মধ্যে সবথেকে ভালো পজিশনের ফ্ল্যাট। মিতালি আবাসনে এরকম আর একটিও নেই। ঠিক রাস্তার ওপর। দক্ষিণ কলকাতার আনাচে কানাচে রোজই মাথা তুলছে নিত্য-নতুন বহুতল। মিতালি আবাসন সেদিক থেকে একটু বেশিই খোলামেলা। সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে অনেক সাধ করে শুভংকর রায় কিনেছিলেন এই বাসাটি।অবসরের পর তিন মাস যাবৎ আছেন এখানে। তিন্নি স্টেটসে গেছে বছর দেড়েক আগেই। তখন তাঁরা হুগলির সরকারি আবাসনে থাকতেন। তাই তিন্নিও প্রথম এলো এই ফ্ল্যাটে। 


আজ ফ্ল্যাট নিয়ে মেয়ের কাছে দরাজ সার্টিফিকেট পেয়ে মন খুশি হয়ে গিয়েছিলো শুভঙ্করের।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনছিলেন মেয়ের প্রবাসী জীবনের নানান গল্প।


ডিনারের পর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তিন্নি এসে দাঁড়ালো ব্যালকনি তে। জেট ল্যাগ কাটেনি এখনও।


(২)


ঘড়িতে তখন রাত ১টা।হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে মহানগরীর অলিগলি।নীল-সাদা নিয়নের আলো চুঁইয়ে পড়া সুনসান রাজপথে মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎবেগে ছুটে যাচ্ছে একটা দুটো দুচাকা-চারচাকা। একটা ল্যাম্প পোস্টের নিচে ছেঁড়া আধময়লা কাঁথা কোনোরকমে জড়িয়ে আধো ঘুমে শুয়ে আছে দুলালী।পাশে ছোট একটা কাপড়ের পুটুলি আর দুমড়ে যাওয়া স্টিলের থালা।দুলালী নামে অনেককাল হলো আর কেউ ডাকে না তাকে। সময়ের সাথে সাথে নিজেও ভুলে গেছে তার মায়ের সাধের দেওয়া নামটি।

 

বছর দশেক আগে এমনি এক শীতের রাতে পুলিশের তাড়া খেয়ে হাওড়া স্টেশন চত্বর ছেড়ে মায়ের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছেছিল কাছাকাছি নিরিবিলি এক লোকালয়ে।কতই বা হবে বয়স তখন।এই ধরুন ১০ কি ১২। তবু খুব বিপজ্জনক বয়স। শরীর তখন অনাঘ্রাতা কুড়ি।মায়ের কোল ঘেসে হিসহিসে লোলুপ নজর বাঁচিয়ে কোনোরকমে বেড়ে উঠতে লাগলো মায়ের আদরের দুলালী।মায়ের কষ্টার্জিত উপার্জনে কোনোরকমে চলে যেত দুটি পেট।ভর্তি হয়েছিল পাড়ার প্রাথমিক স্কুলেও।নামতা শেখা ,অক্ষর পরিচয় হতে না হতেই ঘনিয়ে এলো আরেক বিপত্তি। 


সেদিনও শীত পড়েছিল ভালোই। কাজ সেরে বাড়ি ফিরে রাতে তার মা রুটি কিনতে গিয়েছিলো পাশের পাড়ায়। আর তার পর পরই বাসায় এসে সামনের চায়ের দোকানের শম্ভু কাকু জানতে চেয়েছিলো তার মা কোথায় গিয়েছে। সরল মনে বলেছিলো দুলালী মায়ের কথা। যদিও শম্ভুকে কোনোদিন ভালো লাগতো না দুলালীর। সুযোগ পেলেই খুব জোরে জোরে আদর করতো তাকে।কেমন যেন গা ঘিনঘিন করতো।


তারপর রাত গভীর হয়েছে, সকাল হয়েছে ক্রমে। কিন্তু মা আর ফেরেনি। সেদিন না। কোনোদিন না।

পাগলের মতো হণ্যে হয়ে মায়ের খোঁজে ঘুরে বেরিয়েছে এপাড়া-ওপাড়া। থানাতেও খোঁজ নিয়েছে । কিন্তু কোথাও কোনো হদিশ পায়নি তার দুখী মায়ের।দুলালী বুঝেছিলো মা ছাড়া পৃথিবীটা কত অন্যরকম। পরিস্থিতির চাপে বুঝতে বাধ্য হয়েছিল সে।পেটের জ্বালায় কাজ নিতে হয়েছিল ওই শম্ভুরই চায়ের দোকানেই। শরীর দিয়ে চোকাতে হয়েছিল তার মূল্য।


কিছু বছর পর একদিন আবার এরকমই এক শীতের রাতে দুলালী যখন রাতের রান্না চাপানোর তোড়জোড় করছে তখনি শোনা যায় বাইরে প্রবল চিৎকার। কি করে যেন আগুন লেগেছে ঝুপড়িতে। চোখের নিমেষে মুহূর্তে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিলো পুরো বস্তি। সহায় সম্বলহীন মানুষগুলো আরেকবার করে আশ্রয়হারা হয়েছিল সেদিন ।


এরপর এই মহানগরীর পথ ধরে ঘর বাঁধার কম চেষ্টা করে নি। প্রাণ খুলে সব ভুলে বাঁচার চেষ্টা করেছে বহুবার। কিন্তু দুলালীর জীবনে কোনো অঙ্কই মেলেনি কোনোদিন।মিথ্যে প্রতিশ্রুতির ফাঁদে বারবার হাত বদল হয়েছে সব কিছু । কিন্তু মন পায়নি কারোর।জমানো পুঁজি ফুরিয়েছে বহুদিন আগেই। আজ সে অপাঙ্ক্তেয়। নানা রোগের উপসর্গ শরীর জুড়ে।এখন আর দুলালীর সব কথা মনেও পরে না।হয়তো এটুকুই ঈশ্বরের কৃপা। মানুষের করুনা আর উচ্ছিষ্টই সম্বল এখন। জীবনের প্রতি আর কোনো প্রত্যাশা নেই তার। 


মিতালি আবাসনের কিছু লোকজন বেশ ভালো। অনেকেই আবাসনের সামনে তাকে থাকতে দিতে রাজি ছিল না, কিন্তু ম্যানেজিং কমিটির লোকজন দয়ালু হওয়াতে ওই নাক সিঁটকানো , ভ্রু কুঁচকানো বা বাঁকা চাহনি থাকা স্বত্তেও আপাতত মাস ছয়েক যাবৎ রয়ে গেছে গেছে এখানেই।কখনো সখনো পুজো-পার্বনে নতুন শাড়ি বা আবাসনের কোনো কোনো পংক্তিভোজনের দিন সবার শেষে ভালো-মন্দ কিছু জুটেও যায় উপরি হিসেবে। এমনকি গত মাসে আবাসনের তরফে দুঃস্থদের জন্য যে ফ্রি হেলথ চেক আপের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাতে পাড়ার অন্য অনেকের মতো তারও ডাক পড়েছিল সেই ক্যাম্পে। যদিও লজ্জায় আর খানিক অজানা ভয়ে সেদিন ও মুখো হওয়ার সাহস দেখায় নি সে। 


আজ রাত বাড়ার সাথে সাথে শীতের পারদ যেন ক্রমেই নিম্নমুখী। দমকা হাওয়ায় বারবার কেঁপে উঠছে শরীর । চেতন আর অবচেতনের দোলাচলে মহানগরীর রাজপথে আচ্ছন্ন দুলালী , আচ্ছন্ন জগৎ চরাচর।


( ৩ )


"...আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে শহরটা।আগেরবার যখন এসেছিলাম তখনো এতো হাই রাইস চোখে পরে নি জানো। শুনলাম স্কাই স্ক্র্যাপারও হয়েছে বাইপাসের দিকে বেশ কিছু। আগে স্টেটসে সিটি স্কেপ দেখে মনে হতো কবে আমাদের শহরে এরকম একটা জমকালো স্কাই লাইন দেখতে পাবো।আজ গাড়িতে আসতে আসতে মনে হচ্ছিলো এই শহরও সাবালক হচ্ছে ধীরে ধীরে। বাবা বলছিলো কলকাতার সবথেকে উঁচু বাড়ি এখন ৪২তলা । ওপর থেকে নাকি চমৎকার কলকাতার বার্ডস আই ভিউ পাওয়া যায়। ওখানে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং , ফ্রিডম টাওয়ার থেকে যেমন নিউ ইয়র্ক শহরের ব্রেথ টেকিং ভিউ পাওয়া যায় অনেকটা সেইরকম বলা যেতে পারে। কলকাতার কসমোপলিটান কালচারটা এই কবছরে ভালোই ডেভেলপ করেছে, বুঝলে.." । ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে অনিমেষকে জানাচ্ছিল দেশে ফেরার এমনি নানান টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতার কথা।ঘুম যে আজ রাতে কেন অন্তত পর পর বেশ কয়েক রাতেই আসবে না সেটা বুঝে গিয়েছিলো তিন্নি। দুই মহাদেশের দিন রাতের ফারাকটা মানিয়ে নিতে সময় লাগবে বেশ কিছুদিন। এ যাত্রায় মাস খানেকের ছুটি পেয়েছে।সামনের বছরের মাঝামাঝি হয়তো আবার আসবে। তখন আরেকটু বেশি সময় নিয়ে দেশে ফেরার চেষ্টা করবে। আপাতত সেরকমই প্ল্যান। অনিমেষকেও সাথে নিয়েই আসবে তখন। দুই বাড়ির মর্জি মাফিক সেসময়ই সাত পাঁকে বাঁধা পড়ার কথা জর্জিয়া য়ুনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্রী তন্নিষ্ঠা রায় এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই পদার্থবিদ্যার তরুণ অধ্যাপক অনিমেষ লাহিড়ীর ।তিন বছরের জমাটি প্রেম আপাতত দিন গুনছে পরিণতি পাবার অপেক্ষায়। তিন্নি আর অনিমেষের জীবনের সেই মেগা ইভেন্টের শপিং আর প্ল্যানিং দুটোই মোটামুটি গুছিয়ে করে রেখে যাবে এই ছুটিতে। তাই সামনের কয়েকটা দিন ভালোই ব্যস্ততায় কাটবে তিন্নির। 

ফোনটা রেখে বাহারি অর্কিডের টবগুলোর পাশে রাখা বাবল চেয়ারে বসলো কিছুক্ষন।চোখে পড়লো তাদের ফ্ল্যাটের ঠিক সামনের ফুটপাথে আলো আধারিতে কুঁকড়ে শুয়ে থাকা দুলালীর ওপর। শীতের কামড়ে কাবু দুলালীর শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিলো বারবার।এতো খুশির মাঝেও দৃশ্যটা কেমন যেন মন খারাপ করে দিচ্ছিলো । তিন্নি বেশিক্ষন বসলো না ব্যালকনিতে। উঠে পড়লো। 


তারপর মাঝখানে কিছুদিন নানা ব্যস্ততায় কেটে গেছে। একদিন তার মধ্যে দুর্গাপুরে অনিমেষের বাড়ি মানে তিন্নির হবু শ্বশুরবাড়িও যেতে হয়েছিল।সেখানেও একপ্রস্থ কেনাকাটা করতে হয়েছে।আবার অনিমেষের ফরমায়েশ মতো দেখেশুনে লিস্ট মিলিয়ে কিনতে হয়েছে কলেজ স্ট্রিট থেকে নানান কিসিমের বাংলা বই যেগুলো নাকি ঠিক অনলাইনে পাওয়া যায় না।তার মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভূতের গল্প আর রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ ।রাশভারী অধ্যাপকের মধ্যে এখনো যে একটি খ্যাপাটে খেয়ালি ছেলে বাস করে তার হদিশ একমাত্র জানে তিন্নিই I যাই হোক সব মিলিয়ে এই কদিনে দম ফেলার সময় পায়নি একেবারে। 


সপ্তাহখানেক পর আজ একটু আরাম করে ছুটি কাটাচ্ছে তিন্নি। সারাদিন বাড়িতে বসে মায়ের আদর খেয়েছে। বিকেলটা কেটেছে বহু বছর পর দেখা হওয়া স্কুলের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে। এখন এসে চুপচাপ দাঁড়িয়েছে ব্যালকনিতে।


ঘড়িতে বাজে রাত ৯টা।

রাতের খাবার তৈরী হতে এখনো কিছু সময় বাকি।দেখলো আজও ফুটপাথে ঠিক ওই জায়গাতেই ছেঁড়া চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে আগের দিনের দেখা সেই মেয়েটি।সামনে ওই একটা স্টিলের থালা আর তাতে ল্যাম্পের আলোতে কিছু খুচরো পয়সা চকচক করছে ।তিন্নিদের ফ্ল্যাটটা ৬তলাতে I তাই তার পক্ষে আর বেশি কিছু স্পষ্ট দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। 


মা বাবা তখন ড্রয়িং রুমে। তিন্নি চটপট নিজের ঘরে গিয়ে বের করলো কলকাতায় আসার পথে শিকাগো এয়ারপোর্টে কেনা আনকোরা নতুন পুলওভারটা ।কোনোরকমে সেটা গায়ে চাপিয়ে নিয়ে ," একটু আসছি" বলে স্লিপারটা গলিয়ে বেরিয়ে পড়লো দরজার বাইরে। শুভংকর বা সোমা কোনো প্রশ্ন করারই অবকাশ পেলেন না। সোমা শুধু একবার তারপর শুভংকরের দিকে তাকিয়ে বললেন -" তিন্নিটা এত বড় হয়েছে কিন্তু এখনও চঞ্চলতা কমেনি এতটুকু। তোমারই মেয়ে তো!" শুভংকর হেসে বললেন - " আরে, ছাড়ো না ওকে একটু ওর মত। কোথায় আর যাবে? খাবার রেডি হলে বোলো। ফোন করে ডেকে নেবো।"


আবাসনের মেন গেট ছাড়িয়েই ফুটপাথ। তিন্নি চুপ করে গিয়ে দাঁড়ালো দুলালীর সামনে। দৃষ্টি বিনিময় হলো দুই সমবয়সীর। হালকা একটা হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেলো দুলালীর মলীন মুখে।বিনা বাক্য ব্যয়ে তিন্নি তাড়াতাড়ি পুলওভারটা খুলে নিজের হাতে পরিয়ে দিলো দুলালীকে। 

তারপর কোনো দিকে না তাকিয়ে আবাসনের দিকে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে শূন্য দৃষ্টিতে হাটতে লাগলো-রায় বাবুদের আদরের দুলালী । জিন্সের পকেটে সমানে বেজে যাচ্ছে চেনা রিংটোন। লম্বা স্ক্রিন জুড়ে বারবার ভেসে উঠছে অনিমেষের মুখ।কিন্তু কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার। সামনে শিশির ভেজা প্রশস্ত লন ,ফুলের কেয়ারী করা। আলোয় মোড়া লনে ইতিউতি ছড়ানো চেয়ার। লনের সামনেই সুইমিং পুলের নীল স্বচ্ছতোয়া।রাত হলেও কমন রুমে তখনও হালকা মেজাজে চলছে ক্যারাম খেলা। আস্তে আস্তে একটা দুটো করে ফ্ল্যাটের আলো নিভছে। সেখানেই কিছুদূর গিয়ে এলোমেলো পায়ে ঘাসের ওপর বসে পড়লো রায় সাহেবের মেয়ে। 

সারা শরীরে তখন শীতকাঁটা দিচ্ছে। দূর থেকে দেখেই ছুটে এলো আবাসনের অনেকদিনের পুরোনো কেয়ার টেকার - অলোক দুবে।কমন রুম থেকেও বেরিয়ে এলো কয়েকজন। তারাই ধরাধরি করে তিন্নিকে পৌঁছে দিয়ে গেলো ফ্ল্যাটে। রায়বাবুদের আদরীনি ততক্ষনে তলিয়ে গেছে গভীর ঘুমে। অসাড় শরীর জুড়ে তখন দীর্ঘ ২৩ বছরের ক্লান্তি।


(৪)


একটা একটা করে নিভে যাচ্ছে রাতজাগা তারা। পুবের আকাশ জুড়ে আদুরে রাঙা মেঘের মেহফিল।ভেসে আসা আজানের আলাপে ভজনের সুর আর গির্জার ঘন্টার অনায়াস বন্দিশে জন্ম হচ্ছে আরেকটি নতুন ভোরের। ক্যালেন্ডারের হিসেবে আজ বড়দিন। ধীরে ধীরে আড়মোড়া ভাঙছে শহরবাসী।। বেলা যত বাড়ছে বোঝা যাচ্ছে দিনটা যেন অন্য আর পাঁচটা দিনের থেকে একটু আলাদা, একটু বেশিই উৎসবমুখর। বড়দিন মানেই বেঙ্গলিপিডিয়া মতে বনভোজনের দিন, বো -ব্যারাক থেকে পার্ক স্ট্রিট দাপিয়ে বেড়ানোর দিন , হঠাৎ চাগিয়ে ওঠা বেড়ানোর খিদেকে সযত্নে প্রশ্রয় দেবার দিন কিংবা ছেলেমেয়ের হাত ধরে বহু বছর আগে ফেলে আসা কৈশোরকে চিড়িয়াখানায় খুঁজে বেড়ানোর দিন।উত্তরে ইকো-পার্ক থেকে দক্ষিনে মিলেনিয়াম পার্ক -কলকাতার ক্যানভাস জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আজ বাঙালির ইচ্ছেফানুস । উৎসবের আঁচ টের পায় ফুটপাথবাসীরাও। আজ শুকনো রুটির বদলে তাদের অনেকেরই থালাতেই বিরাজ করে এক-আধখানা কেকের টুকরো। কেউ কেউ আবার ডাক পায় যীশু উৎসবেও।তারা জানে প্রতি বছরই সারা রাত এবাড়ি সেবাড়ি ঘুরে বার্বি ,টেডি ,চকোলেট বিলিয়ে ভোরের দিকে সান্তার উপহারের ঝুলি শূন্য হয়ে যায় তাদের মতো আশ্রয়হীনদের বেলা। তাই কেকের টুকরো, রঙিন টুপিতেই স্বাদ খোঁজে জীবনের। 


সকাল ৭টা। 


নরম আলোর আলতো স্পর্শে চোখ মেলে তাকায় মেয়েটি। সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত বিষন্নতা , মাথাটা কেমন যেন ইটের মতো ভারী। বুঝতে পারে না কোথায় সে। মনে হয় যেন হাজার রজনী পেরিয়ে কোনো এক অচিন পুরীতে সূর্য্য উঠেছে আজ। কোনোরকমে দেওয়ালটা ধরে উঠে বসলো সে। চেতন-আর অবচেতনের দোলাচলে মাঝেই মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছে সংজ্ঞা । কে একজন কখন যেন ধুলোমাখা ছোট একটা থালায় রাখে দিয়ে গেছে একটা ছোট মাফিন। অনেকক্ষন পরে চোখ পড়াতে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হলো। মুভিস্ক্রিনের মতো চোখের সামনে কিছু অস্পষ্ট ছবি ভেসে এলো ধীর পায়ে। একটা ক্যাফেটেরিয়া , কড়া কফির গন্ধে ম ম করছে চারিদিক।ছোট একটা টেবিলে মুখোমুখী বসে দুজন যুবক-যুবতী। মেয়েটি যেন অনেকটা তারই মতো দেখতে।কিংবা হয়তো সেই। একটা গান বাজছে , মনে হয় জ্যাজ।...জায়গাটা চেনার চেষ্টা করতেই কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এল চারিদিক। তারপর আবার সব কোথায় মিলিয়ে গেলো। হারিয়ে গেলো গভীর আঁধারে।কানের সামনে কে যেন খুব জোরে ডাকছে কাউকে- “এই মেয়ে, এদিকে উঠে এস। লাইনে দাঁড়াও দেখি।..” চোখ তুলে চারপাশে তাকিয়ে বুঝলো তাকেই ডাকা হচ্ছে। যিনি ডাকছেন তিনি একজন বয়স্ক মহিলা সঙ্গেএকদল ছেলে মেয়ে। তার মধ্যে কয়েকজন হয়তো তারই বয়সী হবে । কয়েকজন ব্যস্ত ফটো তুলতে। হাতের ব্যানার , সাজ পোশাক আর মাইকের ঘনঘটা দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না দলটি কোনো NGO র সাথে যুক্ত। উদ্দেশ্য বড়দিনে দুঃস্থদের মধ্যে কম্বল বিতরণ ।অনেকেই ভিড় করেছে চারপাশে I তাদের কাউকেই কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারলো না। হাঁকডাকের বহর দেখে বুঝলো তাকেও বোধ হয় কিছু দেওয়া হবে ।কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করলো না একেবারেই। শরীর সায় দিচ্ছে না মোটেই আর তাছাড়া এমন ভাবে কেউ তার সাথে কথা বলে না। নিজের দিকে হঠাৎ নজর পড়াতে তাকিয়ে দেখলো গায়ে একটা দামি পুলওভার। খুব চেনা লাগলো সেটি। রংটাও খুব প্রিয়। তার বাড়ির সামনের লনে এমন একটা পার্পল রঙের বোগেনভিলা গাছ ছিল। প্রতিদিন ঝরা ফুলে ভরা থাকতো ব্যালকনি।


 নাহ , কোথাও একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। শরীর আর মনের আসমান-জমিন ফারাক।শুধু আমিটুকু রেখে জেনে কেউ খোল নলচে পাল্টে দিয়েছে আমূল। ভাবতে ভাবতে হারিয়ে গিয়েছিলো আবার। এমন সময় আবার একটি মেয়ে ডাকতে এলো তাকে। প্রচুর সাজগোজ করা।মাথায় লাল সান্তা টুপি। সস্নেহে বাড়িয়ে দিলো হাত। সম্বিৎ ফিরে পেলো দুলালী ...নাকি দুলালী রূপে তিন্নি। মুখ ফিরিয়ে বেশ জোরে বলে উঠলো -"Why are all of you so hellbent on disturbing me? I don't need anything. Please leave me alone." চমকে উঠলো সাহায্য করতে আসা মেয়েটি। কথা না বাড়িয়ে যে পথে এসেছিলো সে পথেই ফিরে গেলো সে আর তখনি দুলালী দেখতে পেলো সামনে আবাসনের গেট পেরিয়ে থামলো একটা লাল রঙের সেডান। 


গাড়িটা খুব চেনা। মনে পড়লো সেই স্কাইপে পছন্দ করে দিয়েছিলো মডেলটা। গাড়ির ভেতর থেকে চিন্তিত মুখে নেমে এলো এক পৌঢ় দম্পতি।দেখে মনে হলো খুব চেনা , খুব কাছের কেউ। পেটের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো একবার।মাথাটা যেন একটু ঝিমঝিম করে উঠলো। বিদ্যুৎ খেলে গেলো সারা শরীরে। তারপর যেন নিজের মনেই বলে উঠলো - "মনে পড়েছে। ওই তো মা আর বাবা। আমার নিজের মা বাবা।"একরাশ আনন্দ আর খুশিতে তখন উজ্জ্বল চোখ মুখ।দেখতে পেলো তাদের সাথেই কোনোরকমে হাত ধরে গাড়ি থেকে নামলো একটি মেয়ে।তারই বয়সী।সে যেরকম জামা কাপড় পড়তো ঠিক তেমনি পোশাক পড়া। যদিও পেছন ফিরে থাকায় মুখটা দেখতে পায়নি। দেখার তেমন কৌতূহলও ছিল না। ভাবনাটা একবার মাথায় এসেছিলো কিন্তু তাকে প্রশ্রয় দেয় নি মুহূর্তের জন্যও । ভাবলো ওরা হয়তো গাড়ি থেকে দেখতে পায়নি তাকে। তাই চিনতে পারে নি।সব চিন্তা ছাঁপিয়ে তখন মা বাবাকে ফিরে পাবার আনন্দে উদ্বেল মেয়েটি। ভাবলো ছুটে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরবে। এবার আবাসনটাও চিনতে পারলো খানিকটা। টলোমলো পায়ে আবাসনের দিকে এগোতেই বাঁধা দিলো সিকুরিটি গার্ড, বললো- "আভি অন্দর ঘুসনা মানা হ্যা।" অনেক কাকুতি মিনতি করেও কোনো লাভ হলো না। শেষে হতাশ হয়ে শুধু জানতে চাইলো রায়বাবুদের সাথে মেয়েটি কে ছিল।সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা ভদ্রলোক সদয় হয়ে জানালেন-" উও লেরকি রায়সাহেবের মেয়ে। বিদেশ থেকে এসেছে। গতকাল রাতে কিভাবে যেন অসুস্থ হয়ে পড়ল। তবিয়ত খুব খারাপ। কাউকেই চিনতে পারছে না। আজ তারা ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন লেরকিকে।" এমন উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিল না দুলালী থুড়ি তিন্নি। পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে।


Rate this content
Log in

More bengali story from Indrani Bhattacharyya

Similar bengali story from Drama