রুদ্রদীপ আর বন্নিশিখার আত্মজীবনী
রুদ্রদীপ আর বন্নিশিখার আত্মজীবনী
মেঘের কোলে রোদ উঠেছে বাদল গেছে টুটি,
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি!
পুজোর এক মাস বাকি আছে মাত্র,কিন্তু! ছুটি পড়ার পর থেকে রুদ্রের দিনগুলো খুব নিঃসঙ্গতাকে সাথে নিয়ে কাটছে। সে তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছে। তার অফিসে পুজোর অনেক আগেই ছুটি পড়ে যায়,সুতরাং সে আর কলকাতার ফ্ল্যাটেতে থাকেনা। অফিসের ছুটির পরে তার পরের দিন খুব ভোর বেলায় সে ট্রেনে করে কৃষ্ণনগরে চলে যায় সবাই জানে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠিত দুর্গাপুজো খুব বড় করে ধুমধাম করে পালন হয়। কৃষ্ণনগর তার গ্রাম যেখানে সে তার ছোটবেলাটা কাটিয়েছে, বড় হওয়ার পর যখন সে কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়েছে, তখন রুদ্রের বাবা রুদ্রের জন্যে একটা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে। ওদের অবস্থা খুবই ভালো। তার ঠাকুরদা জমিদার ছিলেন।
কৃষ্ণনগরে তাদের বিশাল বড় বাড়ি আছে, সেই বাড়িতে কি কি নেই সেটা বলাই বাহুল্য তাদের নিজেদের দুধেলা চারটে গরু আছে সেই গরুর দুধ তারা রাত্তিরে ও সকালে খায় থেকে ছানা হয় মাখন তৈরি হয় সেই মাখন আর ছানা তারা বাজারে বিক্রি করে অনেক পয়সা কামায়। তার কৃষ্ণনগরের বসত বাড়ির পিছনে একটা বেশ বড় পুকুর আছে সেই পুকুরে ছোট ছোট চারা মাছ,শিঙি মাছ, মাগুর মাছ এমনকি তেলাপিয়া চাষ করা হয়,সেই মাছ তারা দুপুরবেলা গরম ভাতে আয়েশ করে খায়।রবিবার রবিবার বাজার থেকে রুদ্রের দাদা ঠাকুর পাঁঠার মাংস আনায়, রুদ্রের দাদা ঠাকুর সম্পূর্ণ নিরামিষাশী ছিলেন,তিনি মাছ-মাংস কিছুই ছুতেন না। তিনি শাকসবজি খেতে খুব ভালোবাসেন তাই তার জন্য বাড়ির সামনের দিকে ফুলের বাগানের পাশে একটা ছোট্ট সবজি বাগান বানিয়েছেন তার স্ত্রী গৌরী দেবী। গৌরী দেবী খুব সাদাসিধে পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি মাথায় কালো সাদা মেশানো ভর্তি চুল, কানে একটা সোনার ঝুমকো। গলায় একটা শুরু সোনার হার আর দুই হাতে সোনা বাঁধানো শাখা পলা আর কয়েকগছা সোনার চুড়ি আছে। রুদ্রের মা দুর্গা দেবী লাল পাড় হলুদ শাড়ি পড়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বাড়ির উঠনে রাখা তুলসী মঞ্চতে প্রদীপ জ্বালিয়ে ধূপকাঠি দেখাতেন রোজ। রুদ্রের দাদু খুব বড় ডাক্তার ছিলেন রুদ্রের মায়ের যখন বিয়ে হয় তখন তার বাপের বাড়ি থেকে আশি ভরি সোনার জিনিস দিয়েছিলেন রুদ্রের দাদা ঠাকুর প্রতাপ সিংহ পণ্যের খেলাপ ছিলেন তাই রুদ্রের দাদু ব্রিজ মোহন গাঙ্গুলী তার নিজের ইচ্ছায় মেয়েকে সোনায় ভরিয়ে দিয়েছিলন। রুদ্রের জন্ম হয় 2000 সালে তার মা-বাবার আট বছর বিয়ের পরে ।রুদ্র যদিও পড়াশোনা করছে এখন কিন্তু সে পড়াশোনার পাশাপাশি ইন্টার্নশিপ ও করছে সে প্রথমে একাউন্টান্সি তে অনার্স নিয়ে পড়ে সেটার উপর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে এখন এমবিএ করছে তার পাশাপাশি একাউন্টস আর অডিটের জব করছে। রুদ্র একটা ছোটবেলাকার খুব ভালো বান্ধবী ছিল সে এখন কলকাতাতেই ওর মতন পড়াশোনা করছে তার পাশে চাকরি করছে সেই মেয়েটি হলো প্রতাপ সিংহ রুদ্রের দাদাঠাকুরের বন্ধুর রুপনারায়ণ গাঙ্গুলীর ছেলের মেয়ে বন্নি শিখা। সবাই তাকে শিখা বলে ডাকে কিন্তু রদ্র তাকে ছোটবেলা থেকেই যখন থেকে তারা সবে কথা বলতে শিখেছে একে অপরকে নাম ধরে ডাকে,মানে... বন্নি শিখা রুদ্রদীপকে রুদ্র বলে ডাকে আর রুদ্র দীপ বন্নিশিক্ষাকে বন্নি বলে।
বন্নিশিখাদের অবস্থা প্রতাপ সিংহদের থেকেও আরো বেশি ভালো, প্রতাপ সিংহের বন্ধু হলেন বন্নিশিখার ঠাকুরদা।বন্নি শিখার বাবা ও কাকারা সবাই ডাক্তার তাদের তিন-চারটে কলকাতার মত জায়গায় নিজেদের নার্সিংহোম আছে তার পাশে বোম্বে, দেল্লীতেও , নার্সিংহোম আছে।এবারের পুজোয় রুদ্রদীপ কলকাতা থেকেই ঠিক করে এসেছিল সে বন্নি কে তার মনের কথাটা জানাবে,সে তাকে বলবে যে সে তাকে কতটা ভালোবাসে কিন্তু ও বুঝতে পারছে না সে বন্নি শিখা কে কিভাবে প্রপোজ করবে।রুদ্রদীপ সারাক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রাক্টিস দিচ্ছিল যে সে কিভাবে বন্নি কে প্রপোজ করবে, তখনই সে শুনতে পেল বন্নির গলার আওয়াজ তার মা দুর্গা দেবী বললেন যে শোন বাবুন দেখ কে এসেছে তোর ছোট বেলাকার বান্ধবী বন্নি। বন্নির নামটা শুনতে পেয়ে রুদ্রদীপ কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে বলল যার জন্য সকাল থেকে অপেক্ষা করছিল তাকে এ মনের কথাটা বলার জন্য সেই তার বাড়িতে এসে পড়েছে, এটা ভাবতেই রুদ্রের গলাটা কেমন যেন একটা শুকিয়ে গেল তার মনে হলো যেন সে সাহারা মরুভূমির লাভা গলানো গরম বালির উপর দাঁড়িয়ে আছে পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল, যেন সে আন্টার্টিকার ভাসমান বরফ কে সদ্য স্পর্শ করে এসেছে।
রুদ্রদীপ নীচে নামার আগেই বন্নি উপরে উঠে এল সে রুদ্র ঘরে গিয়ে থমকে দাড়ালো,সে দেখতে পেল সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একা একা আয়না সঙ্গে কথা বলছে,বন্নি হো হো করে হাসতে লাগলো বন্নির হাসির আওয়াজ শুনে চমক ভাঙলো রুদ্রদীপের।রুদ্রদীপ তাকিয়ে দেখল বন্নি ঘরের ভেতরে ঢুকে এসে সোফায় হেলান দিয়ে কায়দা করে বসে বসে হাসছে,রুদ্রদীপ জিজ্ঞেস করল
কিরে তুই কখন এলি, আমি বুঝতেই পারলাম না...
তুই কি করে বুঝতে পারবি, তুইতো নতুন প্রেমিকা আরশি সঙ্গে কথা বলতেই ব্যস্ত ছিলিস...
নতুন প্রেমিকা সে আবার কি কথা, আমার তো পুরোনো বা নতুন প্রেমিকা কোনটাই নেই...
সে কি রে !...এতক্ষণ ধরে তার সঙ্গে কথা বলছিলিস, এখন বলছিস চিনিস না
না...আমি চিনি না... আর এই আরশি মেয়েটা কে?...
বাব্বা,...যার সামনে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলিস তার নামই তো হল আরশি...
আমিতো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম এখানে মেয়ে কোত্থেকে এলো...
ওই তোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আয়নাটাইতো হল আরশি...
তুই কি উদ্ভট কথা বলছিস...আমি একদম বলছি না তুই ভেবে দেখ আয়নাকে আরশি বলে কিনা না...
না...মনে পড়ছে না ! কিরে হাঁদারাম এত বড় জায়গায় চাকরি করিস আর পড়াশোনাটা ভুলে গেলি নাকি এই বলে বন্নি ওর মাথায় একটা হালকা থাপ্পর দিল,বাদাম খা তাহলে দেখবি সব মনে থাকবে।এসব ছাড় তো এখন বন্নি বল তুই কেমন আছিস?
আমি তো ভালো আছি আর মনে হচ্ছে তুই ভালো নেই আমি তো বেশ দিব্যি আছি।
হুম...দেখে তো মনে হচ্ছে না এইতো দেখ আমার চেহারাটা আগের থেকে আরো বেশি মজবুত আর ছিপছিপে হয়ে গেছে...
মনে হচ্ছে তুই দীপিকা পাড়ুকোনের মত ডায়েটিং শুরু করেছিস আবার হাসতে লাগল বন্নি...
নানা ডায়েটিং শুরু করেনি এটাকে বলে বডিবিল্ডিং আমি কলকাতায় রোজ সকালবেলা অফিসে যাওয়ার আগে এক ঘন্টা ধরে জিমে গিয়ে ওয়ার্কআউট করি।
আচ্ছা,তাহলে এখন এইসব করা হচ্ছে বাবুর... এখন তো সব কম বয়সী ছেলে মেয়েরাই জিমে গিয়ে ওয়ার্কআউট করে,কেন তুই করিস না...?
আমি করি কিন্তু ওয়ার্কআউট না আমি সকালবেলা উঠে রোজ এক ঘন্টা ধরে ইয়োগা করি।
আচ্ছা তোকে তো দেখে মনে হচ্ছে না এই বলে রুদদীপ হাসতে শুরু করলো। এই সব কথার মধ্যে বন্নি হুট করে রুদ্রদীপকে প্রপোজ করে ফেলল বন্নি। রুদ্রদীপ একটু অবাক হল যে বন্নি কে সে চেনে সে বন্নি খুব লাজুক,ধীর-স্থির আর এখন যে বন্নি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে বোল্ড,মর্ডান, স্টাইলিশ এই বন্নি কে তো চিনতেই পারছেনা।রুদ্রদীপ বলল আমায় একটু সময় দে...
বন্নির প্রপোজ করার পর ছয় মাস কেটে গেল,এসে গেল দুর্গাপুজো প্রত্যেক বছর রুদ্রদীপ এর বাড়ীর বড় দালানের ধুমধাম করে দূর্গা পূজা করা হয় এই বছরেও অনুষ্ঠিত করা হলো দুর্গাপুজো। পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পর বন্নি রুদ্রদীপ এর হাত ধরে দালানের ঠিক উলটো দিকের ঘরে নিয়ে গেল বন্নি জিজ্ঞেস করল...
আমি যে প্রশ্নটা করেছিলাম সেই প্রশ্নটা জবাব আমি এখনো পেলাম না,তাহলে বল তুই আমায় বিয়ে করবি কি...?
রুদ্রদীপ উৎকণ্ঠায় ভরা বন্নির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ... আমি তোমায় বিয়ে করবো,সত্যি...! তুই আমায় বিয়ে করবি... হ্যাঁ করব,কিন্তু...এখন কাউকে আমরা জানাবো না কারণ এইসবে নতুন একটা চাকরি তে ঢুকেছি আমি যদি এক্ষুনি এক্ষুনি বিয়ের জন্য ছুটি নিয়েনি, তাহলে সেটা ভালো দেখাবে না আর ভালো ইম্প্রেশন পড়বেনা আমার কাজের উপর। আচ্ছা আমি না আরো ক'মাস ওয়েট করবো এই বলে দুজন দুজনকে জাপটে জরিয়ে ধরল। এরপর আরো পাঁচ ছয় মাস কেটে গেল রুদ্রদীপ গ্রামের বাড়িতে ফিরে বন্নির বাবার কাছে গেল তার আর বন্নির বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে সেখানে গিয়ে জানতে পারল যে বন্নির দুমাস আগে বিয়ে হয়ে গেছে,যদিও সে বিয়ে করতে চাই নি সে বলছিল যে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে এবং সেও তার জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু তখন খুব বড় বিপদ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বন্নি বিয়ে করতে রাজি হল।
আসলে বন্নির কুষ্টি দেখানো হয়েছিল একজন মহান পণ্ডিতকে, সে বলেছিল যে এই বছরের মধ্যে বিয়ে না হয় তাহলে আগামী দশ বছরের মধ্যে বন্নির বিয়ে হলে সে বিধবা হতে পারে। বন্নির বাবা যদিও এই সব কুসংস্কার কে মানে না কিন্তু তবুও তার বন্নির মায়ের কাকুতি-মিনতিতে বন্নির বাবা বন্নির বিয়ে দিতে রাজি হলো। রুদ্রদীপ এর আগামী তিন মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল স্নেহা বলে একটি সোনার ব্যবসায়ীর মেয়ের সঙ্গে।দুজনের বিয়ের পর প্রায় আঠ বছর কেটে গেছে এর মধ্যে বন্নি আর রুদ্রদীপ অনেকবার ঠিক দুর্গাপূজার সময় ওদের গ্রামের বাড়িতে একসঙ্গে একে অপরের সঙ্গে সময় কাটিয়েছে, দেখা করেছে কারণ...তারা বিয়ে করার সময় একে অপরকে মনে মনে বলে রেখেছিল যে যাই হোক না কেন,যে কোন পরিস্থিতিতে তারা প্রত্যেক বছর এই দুর্গাপূজার সময় গ্রামের বাড়িতে যাবে আর এক সঙ্গেই পুজোর চার দিন কাটাবে।তারা নিজেদের এই মনের কথাটা রেখেছে,প্রত্যেক বছর অতি বড় ঝড় আর বৃষ্টির মধ্যেও তাদের কথাটা কোন ভাবে তাদের কথার অন্যথা করেনি। তারা একে অপরের সঙ্গে দুর্গাপূজার চারটের দিন খুব ভালোভাবে কাটিয়েছে। এরাম করে আরও 30 বছর কেটে গেছে তখন তাদের দুজনেরই বয়স বেড়েছে একজনের বয়স 80 ছুঁই ছুঁই আর আরেকজনের বয়স প্রায় 75 এর কাছাকাছি।তারা এই বছরও তাদের 35 বছর আগে মনে মনে দেওয়া কথাটা আজও রেখেছে...মায়ের বিসর্জনের দিনে তারা একসঙ্গে সিঁদুর খেলেছে,মিষ্টি খাইয়েছে একে অপরকে তারপরে নদীর ধারে গিয়ে একসঙ্গে বসে নিজের মনের অনেক কথা বলেছে, একে অপরের হাতে হাত দিয়ে অনেক গোপন কথা ফাঁস করেছে সে এত বয়সে এসে... কথা বলতে বলতে হঠাৎ কি যেন একটা হল যে তাদের চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল নিমিষে তারা কখন যে ঝিমিয়ে পড়লো তাদের খেয়ালই নেই ।অনেকক্ষণ হয়ে গেল তারা উঠছে না দেখে ওখানে কয়েকজন লোক জমা হল তারপর ডাক্তার ডাকলো তারা,ডাক্তার এসে বলল যে তারা মারা গেছে...।