অপেক্ষা
অপেক্ষা
সুদূর প্রান্ত থেকে ভেসে আসা একটা মিষ্টি আতরের গন্ধ মিহিরের নাকে এসে পৌছালো।সূর্যের স্নিগ্ধ আলো চারিদিক মোহময় করে তুলেছে, মনে হচ্ছে যেন অপূর্ব এক স্বর্গ দেশের মধ্যে বসে আছে মিহির।সে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই বলল আহা ! কি দেখতে লাগছে পরিবেশটাকে যখন সূর্যের সোনালী আভা চারিদিককে গ্রাস করে ফেলেছে। কিন্তু খানিকটা তার জিভ পুড়ে গেছে এই স্বর্গের মতো পরিবেশ কে দেখতে দেখতে।
সে কেয়ারটেকার কে ডাকলো
দিনু ! দিনু!....কোথায় গেলি,এই মুখ পোড়া কোথায় গেলি...?এত গরম চা কেউ দেয় যে আমার জিভটাই পুড়ে গেল।
ভাতের ফ্যানটা গড়াতে গড়াতেই বলে উঠলো,হাঁ সাহাব জি আপ থোরা রুকিয়ে মে আভি আরাহা হুঁ....।
মিহির গজ গজ করতে করতে আবার ঐ সুন্দর দৃশ্যের মধ্যে নিজেকে এলিয়ে দিল।কিছুক্ষণ বাদে দিনু কাঁধে গামছা নিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে এল দিনু....।পেশায় মিহিরের বিয়ের বাড়ির কেয়ারটেকার দিনুর আদি বাড়ি আসামে তার বউ বাচ্চা ওখানেই থাকে। কিন্তু সে কাজ সূত্রে এখন দার্জিলিঙে একটু দেখতে ভুটিয়া দের মত কিন্তু সে হিন্দির সাথে সাথে খুব ভালো বাংলা বলতেও শিখে গেছে।সে সব সময় খৈনি খায় তাই সে খৈনি হাতে কচলাতে কচলাতে এসে মিহিরের সামনে দাঁড়ালো। মিহির বলে উঠলো... এই যে দিনু.... তুই তো আমায় বলে যাবি যে চা টা গরম,আমার জিভটা তো পুরেই গেল....সাহাব জি ! ম্যাঁনে তো.... আপনাকে বলে গিয়েছিলুম আপনি হয়তো খেয়াল করেননি....।
আমি খেয়াল করিনি.... যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা।
যা গিয়ে আমার দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা কর....হ্যাঁ সাহাব ভাত হয়ে গেছে শুধু মাংসটা কসালেই আপনার দুপুরের খাবার রেডি।
ঠিক আছে... যা তাড়াতাড়ি কর আমাকে একটু বেরোতে হবে চা বাগানের পরিদর্শনে।
মিহিরের বাবার বড় চা বাগান আছে....।তিন-চারটে চা বাগানের মালিক মিহির নিজেই তার বাড়িতে তারই চা বাগানের চা পাতা দিয়ে চা তৈরি করে খাওয়া হয়। হঠাৎ করে এক ফোটা শীতল জল তার কপালে পরল....ওমা !এতো দেখছি শিশির পড়ছে। এরকম মুগ্ধকর পরিবেশের মধ্যে শিশিরপাত যেন এক ফালি সোনালী রোদের মধ্যে হীরের ঝলমলানি।মিহির হাত পেতে শিশিরগুলো নিয়ে গোটা শরীরে মুখে মাখলে কি শীতল কি সুন্দর কি মিষ্টি এই শিশির গুলো। মিহির রীতিমতো খেলা করতে লাগল ওই শিশুর গুলোকে নিয়ে।
ঘণ্টাখানেক পরে সে ঘরের ভেতরে গিয়ে পাঁঠার মাংসর ঝোল আর গরম গরম ভাত আর স্যালাড দিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করল। তারপরে পাইপ টানতে টানতে সামনের দালান ঘরে গিয়ে আরাম কেদারায় বসে বসে একটু জিরিয়ে নিল।
বিকেল চারটে টারটে হবে তখন সে খোলা জিভ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল চা বাগানের উদ্দেশ্যে।দার্জিলিংয়ের প্রচণ্ড ঠান্ডায় মিহির কোনোদিন ও দমেনি।এই বরফ দেশেও খোলা জিপে ঘুরে বেড়ায় মিহির। এই হাড় কাঁপানো শীতের মিহিরের ঘুরে বেড়ানো খুবই পছন্দ।
মিহিরের ঘন্টাখানেক যাওয়ার পরে একটা ফরাসি মহিলা তাকে খুঁজতে এল....। তার পরনে ছিল লাল রঙের গাউন আর সাদা রংয়ের টুপি গলায় একটা মুক্তোর মালা আর কানে ছোট দুল।গাউন এর উপর দিয়ে বড় বাদামি কালারের ওভারকোট পড়েছিল মহিলাটি তার সঙ্গে গ্লাভস।
দিনু নাম জানতে চাইলে সে বলে তার নাম ক্যাথলিন.... সে এও বললো যে সে মিহিরের সঙ্গে কথা বলতে এসেছে।
মিহির তার অনেক দিনের চেনা পরিচিত। ক্যাথলিন দার্জিলিঙে বাণিজ্যিক কাজ নিয়ে এসেছে সে নানা সূত্রে জানতে পারে যে এখানে মহিরু কাজ নিয়ে এসেছে।
ক্যাথলিন বলে উঠলো....মিহির কে ডেকে দিতে। দিনু বলল...সাহাবজি ঘর পে নেহি হে মেমসাব আপ থরি দের বাদ মে আইয়ে...। ক্যাথলিন বলল... আই কেন নট কাম এগেন.... আই টু লিভ ফর দা প্লেস সো প্লীজ ক্যান ইউ গিভ দিশ হ্যান্ড কার চিপ এন্ড লেটার তু হিম ওয়েনেভের ই কামস। দিনু মাথা নেরে বলল ঠিক আছে...মেমসাব।হ্যান্ড কার চিপ আর লেটার টা দিয়ে ক্যাথলিন একটা বেশ লম্বা গাড়ির ভেতরে ঢুকে বেরিয়ে গেল।
রাত্রি প্রায় দশটার সময় বাড়ি ফিরল মিহির। গরম জলে হাত মুখটা ধুয়ে এসে খাবার টেবিলেই বসল গরম গরম হাতে করার রুটি আর কচি পাঁঠার ঝোল দিয়ে রাত্রের খাবার শেষ করল।
খেয়েদেয়ে উঠতেই হ্যান্ডকার চিপটা আর লেটার টা দিনু মিহিরের হাতে দিয়ে বলল...আপনার জন্য একটা ফরাসি মেম দিয়ে গেছে আর আপনাকে এটা দিতে বলেছিল।
আপনি যখন বাড়িতে ছিলেন না তখন তিনি এসে এটা আপনার উদ্দেশ্যে দিয়ে গেছেন। তাই আপনাকে দিয়ে দিতেছি আপনি ফিরতেই।
হ্যান্ড কার চিপ টা হাতে নিতে তাঁর নাকে একটা খুব চেনা গন্ধ ভেশে উঠলো। এই গন্ধটা...মিহিরের ফেভরিট পারফিউমের। যখন সে কলেজে পড়তো তখন এই পারফিউমটা সে খুব ব্যবহার করত আর এই পারফিউমটা দিয়েছিল তার গার্লফ্রেন্ড ক্যাথলিন...। হ্যান্ড কার চিপ টা উল্টাপাল্টে দেখল.... হ্যান্ড কার চিপটার একটা কোনায় ক্যাথলিন এর 'কে' লেখা আছে। ক্যাথলিন খুব পছন্দ করত তার নামের প্রথম অক্ষরটা তার হ্যান্ড কার চিপ বা তার অন্য কোন আসবাব পত্র লেখাতে।
অক্ষরটা দেখেই মিহির চটকরে লেটার টা খুলে ফেলল চিঠিতে কিছু এমনটাই লেখা আছে...
প্রিয় মিহির, হ্যান্ডকারচিপটা পেয়ে তুমি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে হ্যান্ড কারচিপটা কার....।আমি জানি তুমি আমার কথা ভোলোনি আর কোনোদিনই ভুলতে পারবে না তেমনি আমিও তোমার কথা কোনদিন ভুলিনি আর কোনোদিনও ভুলতেও পারবো না। অনেক বছর হয়ে গেছে আমরা একসঙ্গে দেখা করিনি তাই যখন এখানে এসে শুনলাম যে তুমি এখানে আছো তাই ভাবলাম যে একবার দেখা করা যাক পুরনো স্মৃতিগুলোকে আবার করে বাঁচিয়ে তোলা যাক...।
প্রায় আঠ বছর হয়ে গেছে আমাদের কোনো দেখা সাক্ষাত নেই অনেকটা তোমার স্মৃতি আমার চোখ থেকে মুছে গেছে। কিন্তু মন থেকে মুছে যায়নি আশা করি তোমার সঙ্গে ঠিক এমনটাই হয়েছে আমাদের প্রেমের সম্পর্কটা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। কিন্তু তার জন্য আমার কোনো আক্ষেপ নেই একটা আক্ষেপ রয়ে গেল যে তোমার কোলে মাথা রেখে আমি আমার সব দুঃখ কষ্ট ব্যথা যন্ত্রনা ভুলে যেতে চাই ভাবলাম যে যখন তুমি এখানেই আছো আমার এই অসম্পূর্ণ সেটা কিছুটা পূরণ হোক তাই তোমাকেএই চিঠিটা লিখা আশাকরি তুমিও সবকিছু বুঝতে পারছ আমি তোমাকে জোর করব না তুমি যদি চাও তাহলে এই চিঠির দেওয়ার জানিয়ে দিও যে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক কিনা তাহলে আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা সর্বোচ্চ উপত্যকায় দেখা করব। কিছু না ভেবেই এই চিঠির উত্তর লিখতে বসলো...সে খাগের কলম টা নীল কালিতে ডুবিয়ে লিখল হ্যাঁ আমি দেখা করব ক্যাথলিন....।
আজ থেকে ঠিক তিন দিন পরে দেখা করার দিন ঠিক হল গোলাপি রঙের একটা গাউন পরে মাথার খোপায় একটা গোলাপ ফুল আটকে তার উপর একটা কালো রঙের ওভারকোট নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো....।সূর্যের আলোটা তার খোঁপায় গোলাপ ফুলের উপরে পড়ে সোনালী রঙের চুলকে আরো আকর্ষণ পূর্ণ তৈরি করে তুলল।কাঞ্চনজঙ্ঘার উপত্যকায় পৌঁছে অপেক্ষায় অধীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাথলিন।
সাদা বরফের উপর সূর্যের সোনালী রং পরিবেশটা আরো রোমান্টিক করে তুলেছে।ক্যাথলিন তার আর মিহিরের পুরনো সব স্মৃতি মনে করতে লাগলো হঠাৎ.... একটা বিকট আওয়াজে মোহভঙ্গ হল ক্যাথলিন এর সে ডান দিকে তাকিয়ে দেখল একটা সাদা ঘোড়া বরফের উপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। তার উপরে বসে থাকা সুগঠিত বাহুর মালিকের চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে।ঘোড়াটা কাছে আসতেই সেই সুগঠিত বাহু হাত বাড়ালো হাত বাড়াতেই ক্যাথলিন চিনতে পারল এই হাতটা কার কারণ মিহিরের ডান হাতে আঙুলে একটা সোনার আংটি আছে সেটি দেখেই চিনতে পারল মিহিরকে ক্যাথলিন । ক্যাথলিন হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ঘোড়া থেকে নামতে সাহায্য করল মিহির কে। কিছুক্ষণের জন্য.... দুজন একে অপরের চোখের দৃষ্টিতে হারিয়ে গেল।কতটা সময় পার হয়ে গেছে তাদের খেয়াল নেই তারপরে ইচ্ছা হল মিহির বুঝতে পারল না কখন তার পুরুষ্ট ঠোঁট ক্যাথরিনের কোমল ঠোটের চুম্বন নিতে থাকল। তার খেয়াল নেই সূর্য যখন অস্ত যাবে তখন তাদের খেয়াল পরল।সূর্য তাদের দীর্ঘ অপেক্ষার সাক্ষী হয়ে থাকলো....।এত বছর পর তাদের অপেক্ষার অবসান হল মিহিরের ভালোবাসায় করে উঠলো ক্যাথলিনের সারা মুখ তার মুখের সেই হাসি তাদের হৃদয় স্পন্দন এর আওয়াজ পাহাড়ের কোনায় কোনায় শোনা যাচ্ছে তাদের দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার পর তাদের ভালোবাসা কিছুটা হলেও জয়ী হলো....।