Kumar Archita

Drama Romance Classics

4.0  

Kumar Archita

Drama Romance Classics

মধুচন্দ্রিমা

মধুচন্দ্রিমা

5 mins
518


 যদিদং ইৃদয়ং তম

তদিদং ইৃদয়ং মম….।


 গত বছর মাঘ ফাগুন মাসে….নীলাদ্রি আর নীলাঞ্জনার বিয়ের কথা হয়েছিল। কিন্তু নানান কারণেই হয়ে ওঠেনি সেটা। এক বছর পরে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো। সেই শুভ দিনে সম্পন্ন হল নীলাদ্রির নীলাঞ্জনার বিয়ে। নীলাদ্রি আর নীলাঞ্জনা দুজন দুজনকে ছোটবেলা থেকেই চেনে। নীলাঞ্জনার পাশের বাড়ি নীলাদ্রির বাড়ি।তাই তাকে বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি যাতায়াত করতে কোন কষ্ট হবে না। এক লাফে বাপের বাড়ি এক লাফেই শ্বশুরবাড়ি। 

কেমন মজা….!

বলুন তো…? 

এরকম মজা তো সবার কপালে জোটে না…. কিন্তু নীলাঞ্জনার কপালটা খুবই ভালো….। ছোটবেলা থেকেই ওরা বিয়ে বিয়ে খেলতো...আর সেটা দেখেই তাদের বাবা-মা ঠিক করে ফেলেছিল যে তারা বড় হলে তাদের একেঅপরের সাথে বিয়ে দেবে….। 

কিন্তু তারা কেও জানতেও পারেননি যে নীলাদ্রি আর নীলাঞ্জনা একে অপরকে পছন্দ করে। কিন্তু পরে জানতে পারল….তাই তাদের ঠিক করা দিনে ঠিক কথা মতো তাদের বিয়ে হল 14 ই ফেব্রুয়ারি 2015। নীলাদ্রিই প্রথম প্রপোজ করেছিল নীলাঞ্জনাকে নীলাঞ্জনার কলেজে….প্রথমে মানা করাতে নীলাদ্রি একটু দুঃখ পেয়েছিল….। কিন্তু সে দমেনি…. বরং নতুন করে নীলাঞ্জনাকে পটিয়ে বিয়ে করার জন্য রাজি করে ফেলল। নীলাঞ্জনার ছোটবেলা থেকেই খুব ঘুরতে যেতে পছন্দ করে। ওর ঘোরার সবথেকে পছন্দের জায়গা হল পাহাড় পর্বত। নীলাঞ্জনা আর নীলাদ্রি বিয়ের আগেই ঠিক করে ফেলেছিল তারা ইম্ফলে বিয়ের পরে ঘুরতে যাবে।ইম্ফলের হোটেল ওরা আগে থেকেই বুক করে রেখেছিল শুধু বিয়েটা হওয়ার দেরি ছিল….।


ইম্ফলে এই সময় আনারসটা খুবই সস্তা তাই ওরা ঠিক করেছিল যে তারা ইম্ফলে গিয়ে ওটাই সবথেকে বেশি করে খাবে। কারণ এখানে আনারস পাওয়া যায় কিন্তু অনেক বেশি দাম নেয়। ইম্ফলে ঘুরতে যাওয়ার উৎসুকটা নীলাঞ্জনার মুখে বেশি বেশি করে ফুটে উঠেছিল। নীলাদ্রি আর নীলাঞ্জনার বিয়ের দিনে নতুন লাল বেনারসি আর সোনার গয়নায় কি অসাধারণ দেখাচ্ছিলো নীলাঞ্জনাকে। তারওপের ইম্ফলে ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারটা সে চেপে রাখতে পারছিল না….।যে ওর সঙ্গে দেখা করতে আসছিল তাকেই ও বলছিল। প্রায়…. অনেকেরই জানা হয়ে গেছিল নীলাঞ্জনা আর নীলাদ্রি বিয়ের পরের দিন ঘুরতে যাচ্ছে ইম্ফলে। কলকাতা থেকে ইম্ফল অনেকটাই দূরে….।ওদের পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল।তাই তারা মুখটা ধুয়ে কোনমতে রাতের খাবারটা খেয়ে শুয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি। রাতের খাবারে ওরা আনিয়েছিল গরম গরম পাঁঠার মাংসের ঝোল আর রুটি আর স্যালাড।পরেরদিন সকালবেলা উঠে স্নান করে ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা কাছেপিঠে ঘুরতে গিয়েছিল। দুপুরবেলা ফিরে এসে গরম গরম ছোলার ডাল আলু ভাজা মাছের তরকারি আর আনারসের আচার দিয়ে ভাত খেলো।রাত্রিবেলা ওরা কিছু খায়নি কারণ ওরা বাইরে যেখানে ঘুরতে গেছিল….সেখানকার কোনো ছোটখাটো হোটেলে আনারসের নানান পদ খেয়ে ফিরে ছিল। পরেরদিন খুব ভোর বেলায় উঠে ওরা বেরিয়ে গেছিল তারপর দুপুরে ফিরে মাংসের ঝোল আর ভাত আর আনারসের চাটনি খেয়ে….আবার বিকালে বেরিয়েছিল।এরাম করে প্রায় তিন দিন কেটে গিয়ে ছিল ওদের ইম্ফলে গিয়ে। একদিন খুব ভোর বেলায় ইম্ফলের অনেক ভেতরে ঘুরতে চলে গিয়েছিল আর সেখানেই হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয় এমন যে ওরা একটা জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ওরা বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ছিল কিন্তু বৃষ্টি আর থামেই না….। নীলাঞ্জনার অনেক আপত্তি সত্ত্বেও নীলাদ্রি ওরএকটা কথায় শুনেনি বরণ ওকে কোলে করে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চলে এসেছিল।এখানে রীতিমতো নীলাদ্রি নীলাঞ্জনাকে জোর করেই ইম্ফলের এই ভিতরে জায়গায় ঘুরতে নিয়ে এসেছিল। অনেক দোনামোনা সত্ত্বেও নীলাদ্রি আর নীলাঞ্জনা বেরিয়ে পড়ে ওই ভারী বৃষ্টির মধ্যে কারণ অনেকটা পথ যেতে হবে….. মাঝ রাস্তায় গিয়ে ওরা আটকে পরে। নীলাঞ্জনা খুব দূরে একটা ছোট্ট বাল্ব জ্বলছে দেখতে পেয়ে নীলাদ্রি কে বলে….?। তারা কোনমতে সেই দিকেই চলে যায় দৌড়ে….। কিছুক্ষণের জন্য নীলাদ্রি আর নীলাঞ্জনা একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেল ওরা একে-অপরের হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন হঠাৎ ওদের চমক ভাঙলো একটা ক্ষীণ কর্কশ গলার আওয়াজে। নীলাদ্রি মাথা ঘোরাতেই দেখতে পেল একটা বয়স্ক ভদ্রলোক হাতে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে ওই ছোট্ট বাড়ির ভেতর দিয়ে। সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক তো বলো….


তোমরা ভেতরে এসো বাছা…?

ভেতরে এসো তোমরা যে পুরো ভিজে গেছে….।

 তোমাদের ঠান্ডা লেগে যাবে তোমরা ভেতরে এসো আর একটা গামছা দিচ্ছি সেটা নিয়ে মাথা মুছে নিয়ে কিছু একটা মুখে দাও।নীলাঞ্জনা একটু ভয় পেল…. ইতস্তত বোধ করল কিন্তু অনেক অনিচ্ছা সত্ত্বেও নীলাদ্রি আর নীলাঞ্জনা গুটি গুটি এগুলো বৃদ্ধির পেছনে পেছনে। ঘরে ধুকতে একটা বয়স্ক বৃদ্ধ মহিলা তাদের হাতে দিয়ে দিল দুটো গামছা। তারা মাথা মুছে মুখ ধুয়ে গরম গরম তেলে ভাজা আর মুড়ি আর চা খেলো।ওই ছোট বাড়িতে মানুষ বলতে দুজন ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক আর বৃদ্ধ ভদ্রমহিলা।সে বৃদ্ধ দম্পতির আতিথিয়তায় নীলাঞ্জনা আর নীলাদ্রি খুব খুশি হলো এবং তাদের সঙ্গে বেশ জমিয়ে গল্প করতে লাগল। নীলাঞ্জনা অনেকক্ষণ বাদে লক্ষ্য করলো.... যে বৃদ্ধ মহিলাটি ঘরের এক কোনায় চেয়ারে বসে কিছু একটা করে চলেছে অনাবরাত। সে গিয়ে জিজ্ঞেস করল....

 আপনি কি করছেন মাসিমা...? 

সে বলল....

মা, ওনার তো অনেক বয়স হয়েছে আর এখানে খুবই ঠাণ্ডা তার ওপরে বৃষ্টি পড়ছে আর ওনার তো খুব ঠান্ডা লাগার ধাত তাই ওনার জন্য একটা সোয়েটার বুনে দিচ্ছি। সেই দেখে নীলাঞ্জনা আর কিছু বলল না চুপ করে রইলো আর তার কিছুক্ষণ পরে নীলাঞ্জনার নজরে পড়ল বৃদ্ধ লোকটিক খল নুড়িতে কিছু একটা বাটছে.... 

তখন নীলাঞ্জনা ওই বৃদ্ধ লোকটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল....মেসো মশাই....

আপনি এটা কি করছেন...?

সে বলল....

মা ওর তো খুব পেটের সমস্যা তাই ওর জন্য কিছু আয়ূরবেদিক ওষুধ তৈরি করছি গাছপালা দিয়ে। দুজনের কথা শুনে সে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। বৃষ্টি থামতেই নীলাঞ্জনা আর নীলাদ্রি বেরিয়ে পড়লো তাদের হোটেলের জন্য। আরও দু-তিন দিন থাকার পর যেদিন বেরিয়ে যাবে সেদিন নীলাঞ্জনা ঠিক করলো যে প্রয় বৃদ্ধ দম্পতির বাড়ি যাওয়ার আগে তাদেরকে কিছু উপহার দিয়ে যাবে। কলকাতা ফিরে আসার আগে নীলাঞ্জনা ওখানে গিয়ে দেখে ছোট বাড়িটার সামনে লোকে লোকারণ্য। সে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে সটাং ভেতরে চলে গিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখতে পেল ওই বৃদ্ধ মহিলাটি শুয়ে আছে আর সেই বৃদ্ধ লোকটি তাকে ফুলমালা, চন্দন,সোনার গয়না নতুন শাড়ি দিয়ে সাজাচ্ছে। সে কিছু বুঝতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে ওই বৃদ্ধ লোকটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো...। তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল.... 

মেসোমশাই,মাসিমার কি হয়েছে বৃদ্ধ লোকটি বলল.....

 মা তোমার মাসি মার জন্য স্বর্গ থেকে রথ এসেছে.... তাকে যে অন্য পথে পাড়ি দিতে হবে গো তাই তাকে আমি বধু বেশে সাজিয়ে তুলছি। নীলাঞ্জনা বৃদ্ধ ভদ্রমহিলার শেষকৃত্য শেষ হওয়া অবধি চুপচাপ ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল.....।


 নীলাদ্রি তাকে অনেকবার ফোন করে পাইনি তাই সে চিন্তিত হয়ে ওই বাড়ির দিকে এগোতে লাগলো। আগে এগোতে গিয়ে নীলাদ্রি দেখতে পেল নীলাঞ্জনা ওপাশ থেকে ধীরগতিতে হেঁটে আসছে। নীলাদ্রি নিজের মনে বলল নীলাঞ্জনা যখন গেছিল তার মুখে হাসি খুশিতে ভরা, কিন্তু এখন সেই চোখ দিয়েই দেখতে পাচ্ছি নীলাঞ্জনার মুখে কোনো হাসি নেই তার মুখে শোকের আর স্তব্ধতার ছায়া।সে নীলাদ্রি কে না কিছু বলেই গাড়িতে উঠে পড়ল। কলকাতয় ফেরার পর যখন নীলাদ্রি নীলাঞ্জনার কাছে এসে বোসতে চাইল তার হাত ধরে তখন সে তার হাত ধরতে দিলো না বরং সরিয়ে নিল। নীলাঞ্জনার এরূপ আচরণ দেখে নীলাদ্রি জিজ্ঞেস করলো তোমার কি হয়েছে..... নীলাঞ্জনা....। তখন নীলাঞ্জনা ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করল....


"আমার যখন বয়স হবে আমার সব যৌবন চলে যাবে তখনই কি তুমি ঠিক এরকমই ভালোবাসো আমাকে নীলাদ্রি ".....তুমি কি আমার জীবনের শেষ দিনে বধূ বেশে সাজিয়ে তুলবে......?

 নীলাদ্রি এই প্রশ্নের জবাবে কিছু উত্তর দিল না সেও নিশ্চুপ হয়ে নীলাঞ্জনা চোখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama