Keya Chatterjee

Drama

3  

Keya Chatterjee

Drama

রতনের রবিঠাকুর

রতনের রবিঠাকুর

4 mins
3.1K


দালানে উবু হয়ে বসে নখ খুটছে রতন। একটু দূরে বটিতে আনাজ কাটছে তার মা লক্ষ্মী। মাঝে মধ্যেই বিড়বিড় করে কিছু বলছে আর মাথা চাপড়াচ্ছে। রতন মুখ গোঁজ করে বসে আছে অপরাধীর মতো। ঘর থেকে সবটাই দেখছে পিয়ালী। লক্ষ্মী রান্না ঘরে চলে যেতেই রতনের কাছে একটা চেয়ার টেনে বসে বলল, “কি রে আজ আবার স্কুল পালালি?”

রতন তেমনি মুখ গুঁজে বলল, “আমি তো বলেই দিয়েছি নতুন মামী আমার পড়তে ভাল লাগেনা। স্কুল ছাড়িয়ে দিতে। না শুনলে কি করবো বলো?”

কথা শেষ হতে না হতেই ধূমকেতুর মতো লক্ষ্মী রান্না ঘরে থেকে ছুটে এসে গরম খুন্তি দিয়ে দিল এক ঘা রতনের পিঠে। পিয়ালী ধমকের সুরে বলল, “কি করছ লক্ষ্মী দি। এত বড় ছেলের গায়ে কেউ হাত তোলে?”

“তুমি জানো না বৌদি, কোন আগুনে জ্বলছি আমি।রোজ সকাল সাড়ে পাঁচটায় বেরোই বাড়ি থেকে। তখন বাপ বেটা তে অঘোরে ঘুমোয়। রোগ জ্বালা কিচ্ছুটি মানিনা। শুধু এই আশায় বাঁচি যে একদিন ছেলে লেখাপড়া শিখে বড় মানুষ হবে। সেদিন সুখের মুখ দেখবো। কিন্তু সে কপাল নেই গো বৌদি। বরটা আলসে। আর এই জানোয়ারটা..”

কথা শেষ না করেই আরেক ঘা কষাল সে ছেলের পিঠে। রতন কোনো প্রতিবাদ করেনা। চুপচাপ মার খায়। মার খেতে সে অভ্যস্ত এখন। ক্লাস এইটের পর থেকেই তার অধপতন শুরু হয়েছে। স্কুল পালানো, মারামারি, গালাগালি, পরীক্ষায় ফেল করা। তার আগেও যে সে দারুন মেধাবী ছেলে ছিল তা নয় তবে নিয়ন্ত্রণের মইধ্যে ছিল। দানা গজাতেই মা এর মাথায় আকাশ ভাঙল। তার বাবা ক্লাস ফোরের পরেই রিক্সা চালাতে শুরু করে। মা ক্লাস সিক্স অব্দি পরেই অভাবের তাড়নায় কাজে নেমে পরে। বাপ মা এর থেকে নিজেকে সে একটু বেশি শিক্ষিত বলেই ভাবে। এই স্কুলের গন্ডি পেরোতে চলল। কিন্তু দুবার ফেল মেরেছে। তা নাহলে অনেক আগেই কোনো এক কারখানায় ঢুকে পড়ত। বাধ সাধল বোস বাড়ির নতুন বউ পিয়ালী।

বোস বাড়িতে প্রায় আট বছর ধরে রান্নার কাজ করে লক্ষ্মী। বছর খানেক আগেই বোস বাড়ির ছোট ছেলের বিয়ে হয়। নতুন বৌমা পিয়ালী অবাধ্য রতনকে বাধ্য করার যজ্ঞে নেমে পড়ল নিজে থেকেই। প্রতি সন্ধেবেলা পড়তে বসানো, পড়া ধরা, পরীক্ষা নেয়া। রতন শৃঙ্খলায় আবদ্ধ হতে থাকল। কিন্তু যে নিজের ব্যাপারে সচেতন নয় তার দায়িত্ব স্বয়ং ভগবান নিলেও হয়তো কোনো কাজ হবে না। এবং ঘটল ঠিক তাই। রতন আবার ফেল করল ক্লাস টেনের টেস্টে। পিয়ালীর আগ্রহ স্বভাবতই কমতে শুরু করল। রতন আবার ফিরে গেল তার ঘুড়ি লাটাই, স্কুল ছুটদের দলে। আজও তেমনি একটি দিন। কোনো এক পুকুর ধারে দুপুর বেলায় রতনের মা রতনকে আবিষ্কার করে ছিপ হাতে। আর তখন থেকেই শুরু হয়েছে মারের পর্ব। লক্ষ্মীর হাত থেকে রতনকে কোনো রকমে ছাড়িয়ে পিয়ালী তাকে নিয়ে গিয়ে বসায় ভিতরের ঘরে। যতই উড়ণ চন্ডী ছেলে হোক না কেন, পিয়ালীর কেমন এক মায়া জন্মেছে ছেলেটার উপর।

একদিন রান্না ঘরে কাজ করতে করতে লক্ষ্মী শুনতে পেল ভেতর ঘর থেকে গানের শব্দ। এ বাড়িতে আগে কখনো কেউ গান করেনি। কৌতূহল বশত গুটি গুটি পায়ে সে এসে দাঁড়ালো পিয়ালীর ঘরের সামনে। দেখল পিয়ালী হারমোনিয়াম বাগিয়ে আপন মনে গান করে চলেছে, “চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে…” সামনে পাড়ার আরো কটি মেয়ে বসে আছে। তারাও সমস্বরে গান ধরল। কিছু বুঝে উঠল না লক্ষ্মী। নতুন বৌদি কি গানের স্কুল খুললো নাকি! এসব ভাবতে ভাবতেই পিয়ালীর গলা পেল সে। “এই লক্ষ্মী দি কাল একবার রতনকে পাঠিওনা। ওকে একটা কবিতা শিখিয়ে দেব।” “কেন গো বৌদি? কিছু আছে?” বলল লক্ষ্মী। “হ্যাঁ কিছুদিন পরেই তো ২৫শে বৈশাখ। পাড়ায় রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন হবে। রতনকে নিয়ে এসো কিন্তু।” লক্ষ্মী শঙ্কিত হয়ে বলল, “ও গমুক্ষু কি পারবে এসব বৌদি? দেখবে তোমাদের অনুষ্ঠানটি মাটি হবে।” পিয়ালী হেসে বলল, “সে আমি দেখে নেবখন। তুমি পাঠিয়ে তো দাও।”

পরেরদিন রতন এল। লক্ষ্মী ঘরে ঢুকে দেখলও না সে কি কবিতা শিখছে। ছেলের প্রতি সমস্ত আশা সে জলাঞ্জলি দিয়েছে। কদিন পরেই আবার ডুব দেবে। কিন্তু লক্ষ্মীকে অবাক করে রতন রোজই আসতে শুরু করল। কখনো কখনো নির্ধারিত সময়ের আগেই আসতে থাকল।

২৫শে বৈশাখ এল তার নিজস্ব ছন্দে। পাড়া ময় সাজ সাজ রব। মাইকে ঘোষণা। সকাল থেকে রবীন্দ্র সংগীতে ভরে গেছে গোটা পৃথিবী। সন্ধ্যে বেলা আলোর মালায় সেজে উঠল সংসার। উদ্বোধনী সংগীতের পর চিত্রাঙ্গদা নৃত্য নাট্য, তার পর সমবেত সংগীত। লক্ষ্মী কেমন যেন উদ্বেগ বোধ করল নিজের মধ্যে। যথাসময়ে রতন উঠল স্টেজে। হলুদ পাঞ্জাবি, সাদা পাজামায় ছেলেটাকে মানিয়েছে ভাল। লক্ষ্মী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। রতন বলতে শুরু করল, “নমস্কার কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা বীরপুরুষ…” শুনতে শুনতে লক্ষ্মীর চোখের কোলে জল এল। মুছল না এসে। এই অশ্রুর অপেক্ষায় সে বহুদিন ধরে।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই চমকে গেল লক্ষ্মী। রতন পাশে নেই। দরজা খোলা। এত সকালে বেরিয়ে গেল! মাথাটা চড়াম করে গরম হয়ে গেল লক্ষ্মীর। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল ঘর থেকে। এসেই আরো অবাক হল। রতন দাওয়ায় বসে আছে বই নিয়ে। মাকে দেখে একগাল হেসে বলল, “তোমার জন্য চা মুড়ি রেখেছি। খেয়ে নাও।” লক্ষ্মী মন্ত্র মুগ্ধের মতো চেয়ে রইল ছেলের দিকে।

সাইকেল নিয়ে বেরোল লক্ষ্মী। পিছন ফিরে ছেলেকে বলল খাবার খেয়ে নিতে। রতন ঘর নাড়ল। আলতো করে বলল, “আমিও তোমায় নিয়ে একদিন বিদেশ যাবো মা। দেখো।” লক্ষ্মী কিছু বলল না। নীরবে পিছন ফিরে চলে গেল। চোখটা কেমন ঝাপসা হয়ে গেল। অঙ্কটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না রতন। চোখ বন্ধ করে নতুন মামীর কথাটা মনে করল একবার, “তোর মায়ের বীরপুরুষ হয়ে দেখা তো রতন।” আবার পড়ায় মন বসাল সে। কেউ যেন ওদের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে । তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে, জানলাখানি একটুকু ফাঁক করে…”

সমাপ্ত।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama