Manasi Ganguli

Romance Fantasy

1  

Manasi Ganguli

Romance Fantasy

রঙহীন দোল

রঙহীন দোল

3 mins
449



   আজ দোল,রঙে রঙে রঙিন হবার দিন। আনন্দে মাতোয়ারা হবার দিন। বারান্দায় বসে বসে দেখে নুপুর,রাস্তা দিয়ে রঙ মেখে ছেলেপুলেরা যাতায়াত করছে,কিছু বাচ্চা রাস্তায় খেলছে পিচকারী নিয়ে। পাড়ায় কারো বাড়ী সত্যনারায়ণ পুজো হচ্ছে,শাঁখ-ঘন্টার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নুপুর হারিয়ে যায় তার অতীতে।

    "কত আনন্দে কাটত আমাদের এই দিনগুলি। ছোট থেকেই খুব আমুদে,ছটফটে ধরনের মেয়ে ছিলাম আমি। ছয় ভাইবোন,রক্ষণশীল পরিবার,দোলের দিন বাইরে বেরনোর অনুমতি ছিল আমাদের,আর প্রয়োজনও হত না। পিঠোপিঠি চারবোন,খুব বন্ধুত্ব ছিল আমাদের নিজেদের মধ্যে। গল্পগুজব,খেলাধুলোয় আমরা মেতে থাকতাম। বাড়ীর নীচে কিছু ভাড়াটিয়া থাকার সুবাদে কিছু সমবয়সী বন্ধুও ছিল। সবাই মিলে হুড়োহুড়ি করে রঙ খেলা চলত দোলের দিন বাড়ির উঠোনেই। আনন্দ হাসির ফোয়ারা ছুটত। বাড়ীতে দোলপূর্ণিমায় সত্যনারায়ণ পুজো হত। সব মিলিয়ে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। পুজোর প্রসাদ,সিন্নি খেয়ে আমাদের দোল খেলা শুরু হত। ছোটবেলায় দাদু আবার গরমজলে রঙ গুলে দিতেন, ছ্যাঁকছ্যাঁকে ঠান্ডায় আমাদের যাতে ঠান্ডা না লাগে। আর ঠাকুমার ধবধবে সাদা কাপড়ে রঙ দেবার মজাই ছিল আলাদা।" দাদু কলকাতা থেকে ভ্যানিস রঙ কিনে আনতেন,যাতে কাপড়ে রঙের ছোপ না লেগে থাকে। ওদের ভাইবোনদের বলতেন, "ঠাকুমার কাপড়ে রঙ দিয়ে দে,দেখ না কেমন রেগে যাবে।" ওরা একটু ইতস্তত করত সাদা কাপড়ে রঙ দিতে,দাদু বলতেন, "দে না, কিচ্ছু হবে না,এ হল ভ্যানিস রঙ, কাপড় কেচে রোদ্দুরে দিলেই রঙ ভ্যানিস হয়ে যাবে। ঠাকুমা দেখবি অবাক হয়ে যাবে।" দাদুর কথায় সাহস করে ওরা সবাই রঙ দিত ঠাকুমাকে। দিদি আবার চুপিচুপি ঠাকুমাকে বলে দিত সেকথা। 

    "দিদির একজন 'ফাগ' ছিল। দোলের দিন বন্ধুত্ব পাতিয়ে দুজনে দুজনকে ফাগ বলেই সম্বোধন করতে হয় সারাজীবন। ঠাকুমাই ফাগ পাতিয়ে দিয়েছিলেন ওদের। সেদিন ওরা দুজন দুজনকে নতুন জামা দিত,তাছাড়াও নানারকম উপহার। প্রতিবছরই হত এই উপহার দেওয়ানেওয়া। সেসবও থাকত এই আনন্দ উৎসবে। রঙ খেলা হলে গায়ে দুধের সর মেখে রঙ তোলার চেষ্টা করতাম আমরা। স্নানের পর সবাই আমরা নতুন জামাকাপড় পরতাম। রঙ সবটুকু উঠত না,উৎসবের কিছু ছাপ রেখে দিত প্রায় সপ্তাহ খানেক।" ঠাকুমা ডাকতেন সবাইকে,"আয় সব,মঠ,ফুটকড়াই খেয়ে যা"। ওরা সব হাজির হত,"ঠাকুমা ঐ মঠটা আমায় দাও",কেউ বা বলে,"গোলাপীটা আমায় দাও,হলুদটা আমায়"। তারপর কড়মড় করে সেসব চিবিয়ে খাওয়া। ঠাকুমা ওদের মজা দেখতেন আর হাসতেন। কত মধুর স্মৃতি সেসব। ওদের সঙ্গে উঠোনও রঙ মেখে রঙিন হয়ে উঠত। সে যে কত রকমারি রঙ,চোখের সামনে ভাসে নুপুরের। দুপুরে পাশের বাড়ি থেকে 'মালসাভোগ' দিয়ে যেত,সেই খাবার জন্য ওরা বোনেরা হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিত। 

    রাতে বাড়ীর উঠোনে হত পিকনিক,মাংস,ভাত,চাটনি,মিষ্টি। বাড়ীর বড়রাই রান্না করতেন। ওরাও থাকত হাজির সেখানে। সবাই মিলে উঠোনেই মাটিতে বসে কলাপাতায় খাওয়া হত,শেষ শীতের ঠান্ডা আমেজে,থালার মত পূর্ণিমার চাঁদের আলোয়,হৈ হৈ করতে করতে। দারুণ আনন্দে মুখর ছিল দিনগুলো।

    বিয়ে হবার পরেও সব বোনেরা এবং নীচের বন্ধুরাও সবাই দোলে বাড়ী আসত আর খেলাও চলত আগের মতই। এমনকি বাচ্চা হবার পরও একইভাবে চলেছে এই দোল উৎসব। বাচ্চারাও থাকত সেই খেলায় মায়েদের সাথে। সকলে মিলে সে ছিল নির্মল আনন্দের দিন।

   সে উৎসবের দিন আর ফিরে আসে না নুপুরের জীবনে। আনন্দ কি ভুলে গেছে নুপুর সেদিন থেকে যেদিন তার প্রিয়দিদি,প্রিয়বন্ধু,প্রিয়সখী তার সাথে ফোনে দোলের প্ল্যান করে রাতে শুয়ে সকালে আর উঠলো না। এত ঘুম ওর কোথায় ছিল যে আর ভাঙ্গলো না!!! এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। সবাই হতভম্ব,কারণ কোনো রোগ ওর ছিল না,অসম্ভব খাটতে পারত। সে রাতেও কত রান্না করে খাইয়েছে তার ভোজনরসিক স্বামীকে,ছেলেকে। হঠাৎ করে এমন উবে গেলো কিভাবে? 

   বাড়ীর সে দোল উৎসবও সেদিন থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। সেদিন থেকে নুপুর আর কখনো রঙ মাখেনি। দিদির সাথে ওর জীবনের রঙও মুছে গেছে চিরতরে। নুপুরের চোখ দিয়ে জলের ধারা নামে নিজের অজান্তে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance