রং
রং




পতপত করে উড়ছে লাল শাড়ির আঁচলটা, খোলা চুলগুলো হাওয়ার দাপটে কালবৈশাখী মেঘের মতোই চঞ্চল, পাতলা ছিপছিপে শরীরটা খানিক বেঁকে দাঁড়িয়ে আছে খাদের ধারে… শিঞ্জিনী ওর মুখটা দেখতে পাচ্ছেনা, কিন্তু সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে মেয়েটা সাংঘাতিক কিছু একটা করতে চলেছে। এসময় ওকে ডেকে সাবধান করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে, তাই গুটিগুটি পায়ে সে এগোতে লাগলো ওর দিকে… আর একটু… আর একটু… এই তো শিঞ্জিনী ছুঁয়ে ফেলবে ওকে। কিন্তু…
নাআআআ… প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠে চোখ দুটো খুলল শিঞ্জিনী। টের পেল ওর সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজব করছে। মাথার ওপর ফ্যানটা চলছে ফুল স্পিডে, তাও ঠিক যেন স্বস্তি পাচ্ছে না সে। পাশেই দিদি ঘুমাচ্ছিলেন অকাতরে। শিঞ্জিনীর চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর, "কিরে কি হল?"
লজ্জা পেল শিঞ্জিনী, "সরি, একটা খারাপ স্বপ্ন দেখছিলাম। তোর ঘুমটা ভেঙে গেল আমার জন্য।"
"পাগলী, আবার সরি বলছিস! নে ঘুমিয়ে পড়।"
বোতল থেকে খানিকটা জল গলায় ঢেলে আবার শুয়ে পড়ল সে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর অবশেষে ঘুম নামল চোখে।
★★★★★
আজ ঘুমটা ভাঙতে বেশ দেরী হল মৈত্রেয়ী দেবীর। চোখ দুটো খুলতেই জানালার দিকে চোখ গেল তাঁর, দেখলেন মেঘলা করেছে। একটা ঠান্ডা বাতাস বইছে বাইরে, সেই বাতাসের তালে বাগানের নিম গাছটাও দুলছে জোরে জোরে। এই শীতে ওর সব পাতা ঝরে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মৈত্রেয়ী দেবী। ওই নিম গাছটার মত আজ তাঁর জীবনটাও এমনি ফাঁকা। যে অতি যত্ন করে ওই নিম গাছটা লাগিয়েছিল বাগানে সেই আজ আর নেই। তখন কত বয়েস হবে সৌরভের! চৌদ্দ কি পনেরো। অরণ্য সপ্তাহ উপলক্ষ্যে একটা আঁকার প্রতিযোগিতায় এই গাছটা পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিল সে। নিজের পাওয়া গাছ, কি যত্ন করেই না লাগিয়েছিল। গাছটাকে নিয়ে সে সময় কি মাতামাতিটাই না করত। কেউ এই নিয়ে কিছু বললেই তাকে গড়গড় করে নিম গাছের উপকারিতা বুঝিয়ে দিত একেবারে পয়েন্ট করে। সে কথা মনে পড়তেই চোখের কোণ দুটো ভিজে এলো মৈত্রেয়ী দেবীর। ঘটনাটার পর ছ'মাস কেটে গেল দেখতে দেখতে। আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই অফিস বেরিয়েছিল ছেলেটা কিন্তু সেদিন বাড়ি ফেরেনি আর। পরের দিন ফিরেছিল, বরফের ঘরে সারারাত কাটানো একটা বিবর্ণ নিষ্প্রাণ দেহ। এইটুকু বয়েসেই আচমকা হার্ট এটাক... মৈত্রেয়ী দেবী প্রায়ই ভগবানকে বলেন তাঁর মত হার্টের রোগীর হার্ট এটাক হল না কিন্তু ছেলেটা ওতে চলে গেল!
বিছানাতেই বসেছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী, বড় বৌমা কঙ্কনা চা নিয়ে ঢুকল ঘরে।
"তুমি আবার ঘরে কেন চা আনতে গেলে? আমি তো যাচ্ছিলাম টেবিলে।"
"বাকিদের সবার চা খাওয়া হয়ে গেছে তাই ভাবলাম তোমাকে রুমেই দিয়ে যাই।"
"ওহ…" মাথা নাড়লেন মৈত্রেয়ী দেবী।
"জানোতো ঠাম্মি", কথাগুলো বলতে বলতে ঘরে ঢুকল নাতনি ঝিল, "আজ না আমিও চা খেয়েছি। সকালে কি ঠান্ডা লাগছিল! তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে তাই বোধহয় টের পাওনি।"
নাতনির কথা শুনে মৃদু হাসলেন মৈত্রেয়ী দেবী। বৌমা সেটা দেখে আস্তে আস্তে বলল, "মা ছোটো কি আর বাড়ি ফিরবে না?"
বোমার কথায় মুহূর্তের জন্য চমকে উঠলেন মৈত্রেয়ী দেবী, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, "বাড়ি তো আনতেই হবে। নয়তো থাকবে কোথায়!"
"সেই। ওর দিদির কথা না হয় বাদ দিলাম, নিজের দিদি বোনের জন্য করবেই কিন্তু বাকি আত্মীয়দেরও ভালোই বলতে হয়। সবাই নিয়ে গিয়ে রাখল কিছুদিন করে। বাপের বাড়ি বলতে তো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।"
"হুমম। এখন তো সৃজনীর বাড়িতে আছে, যে কোনো একদিন গিয়ে নিয়ে আসতে হবে।"
"ইয়ে কাকিমণি আবার বাড়িতে ফিরবে, আমার সঙ্গে খেলবে।" আনন্দে এক পাক ঘুরে নিল ঝিল। তারপর ঠাম্মির দিকে তাকিয়ে বলল, "আইডিয়া ঠাম্মি, আজ তো ছুটি। আজই চলো না কাকিমণিকে বাড়ি ফিরিয়ে আনি।"
ঝিলের কথা শুনে মৈত্রেয়ী দেবী আর কঙ্কনা একবার একে অন্যের দিকে তাকালেন। তারপর কঙ্কনা মেয়েকে বলল, "আজ নয়, আমরা অন্যদিন যাবো।"
"কেন গো? প্লিজ আজকেই চলো না। কাকাই তো নেই, এবার কাকিমণিকেও ছাড়া আমি কার সাথে রং খেলবো! প্লিজ চলো না।" ঝিল ঠাম্মির আঁচল ধরে টানল। বুকের ভেতর চেপে থাকা কান্নাটা আবার হঠাৎ করে দলা পাকিয়ে উঠল। কঙ্কনা মেয়েকে মৃদু ধমক দিলেন। মৈত্রেয়ী দেবী ইশারায় বৌমাকে চুপ করতে বলে কান্না ভেজা কণ্ঠে নাতনিকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, " শোনো দিদিভাই, কাকিমণি আর কোনোদিনও রং খেলতে পারবে না তোমার সঙ্গে।"
ঠাম্মির উত্তরে কিছুক্ষণের জন্য যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল ঝিল, কারণটা জিজ্ঞাসা করতেও যেন ভুলে গেল। নাতনির মুখ দেখে মৈত্রেয়ী দেবী নিজেই বললেন, "আসলে তোমার কাকাই তো আর নেই, তাই কাকিমণির আর রং খেলবে না।"
"আহা আমি তো আছি। আমার সঙ্গে ঠিক খেলবে দেখো।" বলল ঝিল। কঙ্কনা মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, "আসলে ঝিল… কাকিমণির আর রং খেলা চলবে না। এটা একটা নিয়ম।"
আবার অবাক হয়ে ঝিল জিজ্ঞেস করল, "নিয়ম! তাহলে কেন বড় দাদাই সকাল হতেই বন্ধুদের সঙ্গে রং খেলতে চলে গেল? বড় ঠাম্মিও তো আর নেই। তাহলে বড় দাদাই যদি খেলতে পারে তাহলে কাকিমণি কেন নয়?"
আট বছরের নাতনির প্রশ্নে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মৈত্রেয়ী দেবী; কঙ্কনা কোনো মতে বলার চেষ্টা করল, "আসলে নিয়মটা শুধু মেয়েদের জন্য।" কিন্তু নিজের অজান্তেই গলাটা কেঁপে উঠল তার। ঝিল বলল, "এ আবার কেমন কথা। এই তো গতকালই নারী দিবস উপলক্ষ্যে সবাই যে বলছিল মেয়ে হোক কি ছেলে হোক সবার সমান সমান অধিকার। তাহলে রং খেলার বেলায় অন্য রকম কেন?"
এবার আর ঝিলের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না কেউ। কারণ উত্তরগুলো হয়তো জানা নেয় তাদেরও। ছোট্ট মেয়েটা ভাবছে শুধু রং লাগানোয় বারণ, কিন্তু ওকে কে বলবে যে বিধবা হলে রঙিন শাড়ি পরাও বারণ, দশমীতে সিঁদুর খেলাও বারণ, আমিষ খাওয়াও বারণ, এমনকি কোনো শুভ অনুষ্ঠানে যাওয়াও বারণ! অথচ এতো বারণের প্রাচীর শুধুই মেয়েদের জন্য, ছেলেদের জন্য কিচ্ছু নয়। কিন্তু এসব বারণ কেন? কেউ জানে না। যুগের পর যুগ এইসব বারণের কাছে মাথা নত করে আসছে মেয়েরা, কখনও স্বেচ্ছায় তো কখনও সমাজের ভয়ে। কিন্তু কেউ প্রশ্ন তোলেনি কোনোদিনও, জানতে চায়নি এই বৈষম্যের পেছনে যুক্তি কি!
মৈত্রেয়ী দেবীর মনে পড়ে গেল সৌরভ আর শিঞ্জিনীর বিয়ের ঠিক হওয়ার পর জন্মের পরেই মা হারানো মেয়েটাকে তিনি বলেছিলেন তাঁকে মা বলে ডাকতে, তাঁকে নিজের মা বলে ভাবতে…
★★★★★
আজ সকাল থেকে ওপরের ঘর ছেড়ে বেরোয়নি শিঞ্জিনী। দিদির শ্বাশুড়ি বারবার করে বলে দিয়েছেন আজ যেন সে নীচে না নামে। পাড়ার ছেলেপুলেরা সব বাড়িতে রং দিতে আসবে। ভুল করে যদি শিঞ্জিনীকেও দিয়ে দেয় তাহলেই "সর্বনাশ"। আশেপাশ থেকে অনেক কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছে, সবাই মেতেছে রং এর উৎসবে। এই তো গত বসন্তেও মানুষটা সকাল সকাল এক মুঠো লাল আবির দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছিল শিঞ্জিনীকে। আর এ বছর সেই মানুষটাই ফাঁকি দিয়ে যেন কোথায় চলে গেল, আর সঙ্গে নিয়ে গেল শিঞ্জিনীর জীবনের সব রং।
নীচে কলিংবেলের আওয়াজ হল। সকাল থেকে অনেকবার হচ্ছে, কিন্তু এবারের আওয়াজটা হতেই কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি হল শিঞ্জিনীর। সে চুপিসাড়ে সিঁড়ির মুখে আসতেই শুনতে পেল একটা পরিচিত গলা, ঝিল!
তড়িঘড়ি সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলো শিঞ্জিনী। ওকে দেখতে পেয়েই ঝিল এসে ছুটে জড়িয়ে ধরল ওকে। তারপর হঠাৎ করেই এক চিলতে আবির নিয়ে দাগ কেটে দিল ওর গালে। চমকে উঠল শিঞ্জিনী। দিদির শ্বাশুড়ি হাঁ হাঁ করে উঠলেন, "এ কি করলে গো! সর্বনাশ!"
এই বলে তিনি মৈত্রেয়ী দেবীর দিকে ঘুরে বললেন, "ও নাহয় ছেলে মানুষ জানেনা কিন্তু আপনাদের তো ওকে বলে আনা উচিৎ ছিল।"
"বলেই এনেছি তো দিদি। ওর আবদার ও ওর কাকিমণিকে ছেড়ে রং খেলবে না, আর শিঞ্জিনীও বিয়ের পর থেকে ঝিলকে ছাড়া রং খেলেনি। তাই তো আনলাম ওকে।"
"আপনাদের কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি! বিধবা মানুষ রং খেলবে?"
"কেন মাসিমা? বিপত্নীক মানুষ যদি খেলতে পারে তাহলে কেউ বিধবা হলে কেন পারেনা?" জিজ্ঞেস করল কঙ্কনা।
"এটাই নিয়ম। শাস্ত্রে আছে…"
"যে নিয়ম আর শাস্ত্র আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগের সমাজকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছিল সেই সব নিয়মকানুনের আজকের সমাজে কতটা প্রাসঙ্গিকতা আছে বা আদৌ আছে কিনা না বিচার করে অন্ধের মত সেটা পালনের কি কোনো যুক্তি আছে দিদি?" খুব শান্ত গলায় কথাগুলো বললেন মৈত্রেয়ী দেবী। সৃজনীর শ্বাশুড়ি একটা ঢোঁক গিলে বলল, "কিন্তু আমাদের তো একটা সমাজে বাস করতে হয় নাকি?"
"সে তো একশোবার। আর তাই তো সমাজকে শতাব্দী প্রাচীন গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করতে শুরুটা নাহয় আমার পরিবার থেকেই হোক।
জানেন তো দিদি আজ সকাল অবধি আমিও আপনার মতোই ভাবতাম যে এসব রীতিনীতি পালন করতেই হয়, কেন করতে হয় সে প্রশ্ন করিনি কোনোদিনও। কিন্তু আমরা বড়রা যা পারিনি সে প্রশ্ন অনাসায়ে করে ফেলেছে আমার এই দিদিভাই। আজ আমার দিদিভাই আমার নতুন করে চৈতন্যদয় ঘটিয়েছে।
আমার ছেলেটা তো চলেই গেছে কিন্তু তা বলে আমার মেয়েটার জীবনের রংও কি আমি কেড়ে নিতে পারি! নাহ, পারিনা আমি। সেটা উচিৎও নয়। আমারও উচিৎ নয়, কারুরই উচিৎ নয়। একটা মানুষের চলে যাওয়ার অজুহাতে মেয়েদের জীবন থেকে সব আনন্দ কেড়ে নেওয়ার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। শিঞ্জিনী একজন স্বতন্ত্র মানুষ, ওর পরিচয় শুধু আমার ছেলের স্ত্রী হিসেবে নয়, ওর আরও অনেক পরিচয় আছে। আর তাই আজ কারুর বিধবার হিসেবে নয়, একজন স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে শিঞ্জিনী রং খেলবে নিজের মত করে…"
বিকেল বেলায় দুই বৌমা আর নাতনিকে নিয়ে ফিরলেন মৈত্রেয়ী দেবী। বাড়িতে ঢোকার মুখে খেয়াল করলেন নিম গাছটার শুকনো ডালে গজিয়ে উঠছে নতুন পাতা...