রকস্টার (ধারাবাহিক উপন্যাস)
রকস্টার (ধারাবাহিক উপন্যাস)
পর্ব::২
প্রথম অধ্যায় :: নূতন মানুষ
নজরুল মঞ্চের একটাও সিট ফাঁকা নেই আজ, কাতারে কাতারে সঙ্গীতপ্রেমী উপস্থিত । থাকবে নাই বা কেন? আজ কলকাতার ব্যান্ড পারফর্মেন্সের ডার্বি ম্যাচ । একদিকে রয়েছে ফোক ফিউসনের রাজা অনুনয় চট্টরাজের ব্যান্ড আরেক দিকে একা কুম্ভ 'ঘোস্ট'।
রজত ঘোষ ওরফে ঘোস্ট, বেহালার অন্ধগলির রকবাজ থেকে বাংলার নতুন রকস্টার। গত সাত বছর ধরে একটু একটু করে ও হয়ে উঠেছে বাংলার ইউথ আইকন। কলেজ ফেষ্ট, প্রতিবাদ মিছিল, কম্পিটিশনে গাইতে গাইতে এত বড় নাম হয়ে ওঠা চাট্টিখানি ব্যপার নয়। ২০০৯ তে রূদ্র ইসলাম মুম্বাই চলে যাওয়ার পর বাংলা যে আর কোনো হিট ব্যান্ড পাবে এটা অনেকেই ভাবেনি। কিন্তু তার দীর্ঘ চার বছর পর বাংলা রকমিউজিক জগতের অন্ধকারের বুক চীরে উদিত হল এক নতুন নক্ষত্র, রজত ঘোষ ওরফে "ঘোস্ট"।
ঘোস্ট নামটা ওকে দিয়েছিলেন অঙ্কন দত্ত, ৮০-৯০ এর দশকের বাংলা ব্যান্ড এবং রক মিউজিককে যিনি পপুলার করে তুলেছিলেন গোটা ভারতে।তার "মালা বোস" গানটা এখনও একই ভাবে জনপ্রিয় । ২০১৩তে টিভিতে একটা ব্যান্ড কম্পিটিশনের ফাইনালে জাজ হয়ে এসেছিলেন অঙ্কন দত্ত , সেই কম্পিটিশনে ফাইনালিস্ট ছিল পরমাত্মা ।
রজত সেদিন গেয়েছিল, "তুমি আসবে কথা ছিল, আমি স্বপ্নে তোমাকে পাই, আর চলতে চলতে জীবন কেটে যায় ..." অঙ্কন বাবুর বিখ্যাত সেই গান।
অঙ্কনবাবু সহ সমস্ত জাজ সেই গানে সেদিন মুগ্ধ, নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শক হাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে আবেগে ভাসছে। অঙ্কন বাবু বলেছিলেন,"এরকম ইমোশন দিয়ে এই গানটা একমাত্র আমিই গাইতে পারতাম, তোমার মধ্যে আমি আমার অতিতকে নতুন করে খুঁজে পেলাম, ইউ আর দ্য স্যডো অফ মাই পাস্ট, ইউ আর ঘোস্ট।"
সেই কম্পিটিশনে থার্ড হলেও পরমাত্মাকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি। আর বেহালার এক বিপজ্জনক বাড়ির রিহার্সাল প্যাড থেকে বিশ্বের মঞ্চে এসে দাঁড়াল বাংলা রক মিউজিকের 'নূতন মানুষ' , 'ঘোস্ট' ।
আর আজ পরমাত্মার জন্মদিন, রজত আর পরমা ছাড়া আর কেউ যদি মনে রেখে থাকে, সে হল জ্ঞান সিং,
নজরুল মঞ্চে আসা থেকে যাকে একমুহূর্ত কেউ চুপ করে বসে থাকতে দেখেনি।
“বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে কি করছিস এতক্ষণ? ঘোস্ট!" চিৎকার করে ওঠে জ্ঞান সিং।
নজরূল মঞ্চে আসা থেকে গ্রীনরূমের বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে রজত। সমস্ত ব্যান্ড মেম্বাররা স্টেজে সাউন্ড চেক করছে, শুধু রজত নেই ।
-"ঘোস্ট, নিকল শালে, শো করনেকা হ্যা য়া নহি? ঘোস্ট?"
জ্ঞান সিং 'পরমাত্মা'র ম্যানেজার । আর রজতের পারসোনাল অ্যসিটেন্ট, লইয়ার, অকাউন্টেন্ট, ম্যানেজার, বডিগার্ড এবং ফ্রেন্ড, ফিলোসফার, গাইড মানে এককথায় রজতের গার্ডিয়ান এঞ্জেল ।
জ্ঞান সিং রজতের কলেজের বন্ধু, বয়সে চার বছর বড়, কিন্তু একই সাথে কলেজ পাস করেছিল ওরা, বলা ভাল রজতের টুকে পাস করেছিল জ্ঞান। আট বছর ধরে আশুতোষ কলেজে একচেটিয়া কালচারাল সেক্রেটারি ছিল ও, আর তাই রজতের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতেও সময় লাগেনি।
কলেজের প্রতিটা ফেস্টে, ছাত্র-যুব প্রতিবাদ মঞ্চে রজতকে গাওয়ার সুযোগ করে দিত জ্ঞান ।কিন্তু রজতের থেকে টুকলি করে পাস করার পর থেকে ওর যেন কৃতজ্ঞতা বেড়ে যায়, কলেজ ছাড়া থেকে আজ অবধি ওই রজতকে সামলে এসেছে, আগলে রেখেছে, একমাত্র ওই হয়ত রজতকে কখনও ছেড়ে দেয়নি । বাবার মদের দোকান, সেখান থেকে টাকা ঝেরে রজতের সমস্ত নতুন গান রেকর্ড করিয়েছে সে। সমস্ত কম্পিটিশনের জন্য তৈরি করা থেকে শুরু করে পাড়ায় পাড়ায় শো ধরা, সবটা জ্ঞান একা করেছে। তাই আজ রজত যদি ঘোস্ট হয়, ও পরমাত্মার স্পিরিট, নিঃশব্দ তাল, যে না থাকলে ছন্দ পতন ঘটত এই ব্যান্ডের।
আর পরমাত্মার বাকি মেম্বাররা মানে, ভম্পু, রকেট, বিজন, প্রসুন আর পাভেল ওকে যমের মত ভয় পায়। শেষ সাত বছরে কম করে বারোজন ব্যান্ড ছেড়েছে জ্ঞান এর জন্য, কারন ওর অসম্ভব বদ মেজাজ আর রজতের প্রতি একচোখোমি । এমনিতে ওর পাঁচ ফুট হাইট, কিন্তু মেজাজটাই আসল রাজা, হবে নাই কেন, ওতো রাজার ছেলেই বটে!
"আরে সাউন্ড চেক কোন করেগা ভাই। ঘোস্ট, আবে নিকল ভাই!...ঘোস্ট বেরোনা।" দরজা ধাক্কা দিতে দিতে রজতকে ডাকতে থাকে জ্ঞান ।
পরমাত্মার জন্মদিন উপলক্ষে আজ স্পেশাল শো অরগনাইজ করেছে জ্ঞান, স্পনসরর জোগাড় থেকে শুরু করে টিকিট বিক্রি সবটাই ও সামলেছে দক্ষ হাতে, কিন্তু রজতকে সামলাতে ওকে মাঝে মধ্যেই এরকম নাকানি চোবানি খেতে হয় ।
-"দেখ ঘোস্ট, আমার কথা শোন, সাউন্ডটা চেক করে আবার ঢুকিস বাথরুমে, কেউ ডিসটার্ব করবে না একঘন্টা, বেরিয়ে আয় ভাই, এই শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা?"
-"দাদা, এনেছি!"- শুকনো পাতার মত চেহারার একটা লোক গ্রীনরুমে ঢুকে এল, "এক'শ লাগবে...", জ্ঞানকে বলল সে।
ওকে দেখে জ্ঞান একটু স্বস্তি পেল," কাঁহা হ্যায়? নিকাল!"
পকেট থেকে একটা গাঁজার পুরিয়া বার করল লোকটা।
-"জলদি সে এক সিগারেট মে রিফ বানা, ফটাফট.."
-"আরে কী দাদা, এখন আমি কি করে..."
-"দু'শো দেবো", ওর কথা থামিয়ে বলে জ্ঞান,"জলদি বনা দে, টাইম নেই।"
-"আচ্ছা",
বলেই লোকটা চেয়ার নিয়ে বসতে যায় , তখনই জ্ঞান খ্যাক করে ওঠে, "দরওযা়জা মেরা বাপ বন্ধ করেগা ভোসরিকা?!"
দশ মিনিটে লোকটা নিজের কাজ সেরে টাকা নিয়ে চলে যায়, তখন জ্ঞান আবার দরজা ধাক্কা দিয়ে রজতকে ডাকে।
-"ঘোস্ট, দেখ তোর ওষুধ আনিয়েছি, এবার বেরো ভাই। প্লিজ । আমি জানি তোর ভয় করছে, কিচ্ছু হবেনা, সব ঠিক হবে, বেরিয়ে আয়, ঘোস্ট!"
গত দেড় ঘণ্টা ধরে রজত বাথরুমে বসে আছে; ভয়ে। হ্যাঁ, রজত ভয় পায়। ভয় পায় মানুষের ভিড়কে আর ভয় পায় অন্ধকারকে। অগোরাফোবিযা় ওর আগেই ছিল, এখন আস্তে আস্তে ও নিক্টোফোবিযাতেও আক্রান্ত হচ্ছে । ছোটবেলা থেকেই ভিড় ভয় পায় রজত, কিন্তু এখন নতুন ফ্ল্যাটে একা থাকতে আর অন্ধকারে শুতে ও ভয় পায় আজকাল। নজরুল মঞ্চটা এয়ার কন্ডিশন করার পর বাইরের আলো ঢোকেনা, আর পরমাত্মার লাইটের এরেঞ্জমেন্টও খুব ডার্ক, আর সেসবই যে রজত ভয় পাচ্ছে, জ্ঞান জানে।
আজকের শোটা করতেই হবে, আর সেটা করতে হলে রজতের ভয় কাটাতেই হবে। তাই এটা ছাড়া উপায় নেই।
-"রজত, বেরিয়ে আয়, দেখ, আমি ওষুধ এনেছি।"
গাঁজাই এখন রজতের নতুন ওষুধ, আগে ছিল মদ, জন্ডিস আর প্যনক্রিযাটাইটিস হবার পর থেকে জ্ঞান ওর মদ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে একেবারে । কিন্তু ভয় না কাটালে তো শো হবে না; মঞ্চ বড় আগ্রাসী, তার কাছে সবই ছোটো, ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, দর্শক না মাতলে অন্ধকারেই হারিয়ে যাবে রজত। তাই এই নেশাটাকে জ্ঞান অপরাধ মনে করে না, কারণ কথায় আছে, ..'দ্য শো মাস্ট গো অন।'
* * * *
নজরূল মঞ্চের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামলো পরমা। তারপর ফোন বার করে কল করার আগেই দেখতে পেল গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে রিমি।
-" শো শুরু হয়ে গেছে?" রিমির দিকে এগিয়ে আসতে আসতেই জিজ্ঞেস করে পরমা।
-"জানিনা রে, আমি তো ঢুকিনি, চল ..." রিমি ওর হাত ধরে জোরে হাটতে শু
রু করে হলের গেটের দিকে।
-"থ্যাঙ্ক ইউ রিমি, তুই না থাকলে..."
-" পরমা কোনো থ্যাঙ্কস নয় ।"
-" কেউ জানেনা তো?"
-" পাগল তুই? কাকে বলব আমি?"
রিমি পরমার ছেলেবেলার সাথি, একই পাড়ায় বাড়ি, এক সঙ্গেই ওরা পড়া শোনা করেছে, খেলেছে, বড় হয়েছে। প্রিয় বন্ধু বললেও কম বলা হয়, ওরা এক আত্মা দুই প্রাণ । রিমি জানে পরমার সব কিছু । আজকের শো'র টিকিট ওই জোগাড় করে রেখেছিল।
হলে ঢুকেই পরমা দেখল কিছুই আর আগের মত নেই নজরুল মঞ্চের, টিন দিয়ে ঢাকা চাল, চারদিক খোলা সেই নজরুল মঞ্চ এখন অনেক বেশী কমার্সিয়ল, কর্পোরেট গোছের। ও শেষবার এসেছিল আটবছর আগে।
এখন মঞ্চে গান করছে "ব্ল্যক ওয়াটারস", অনুনয় চট্টরাজের ফোক ব্যন্ড, ২০১৩র সেই ব্যান্ড কম্পিটিশনে এই ব্যান্ডই প্রথম হয়।পরমাত্মার আর রজতের সবচেয়ে বড় কম্পিটিটর এই ব্যান্ড । যেকোনো দিন পরমাত্মার লাইমলাইট কেড়ে নিতে পারে "ব্ল্যক ওয়াটারস।" তাই পরমা অবাক হয়ে গেল ওদের দেখে, ভাবে পরমাত্মার আগে ওরা কেন? এতো প্রায় সুইসাইড!
দর্শক এরই মধ্যে উদ্বেলিত, অনুনয় একটার পর একটা গান গেয়ে চলেছে, সবকটাই ওদের চার্ট বাস্টার। মনেই হচ্ছে না আজকের শো'টা পরমাত্মার। পরমার মন খারাপ হয়ে গেল, দর্শক রজতের গান মন দিয়ে শুনবে তো? একবার ফোকের তালে মেতে গেলে যে কেউ রক শুনতে চায় না। একটার পর একটা গানের অনুরোধ আসছে অনুনয়-এর কাছে। গানের তালে নাচতে নাচতে দুটো ছেলে হুমরি খেয়ে পড়ল পরমা আর রিমির গায়ের উপর। এসি হলেও নাচতে নাচতে ঘেমে গেছে ওরা।
-"আহ! আস্তে ভাই, কি হচ্ছেটা কি?", খ্যঁক করে উঠল রিমি।
অথচ পরমা আশ্চর্য রকম শান্ত, যেন কিছুই হয় নি।
-"কিরে পরমা, কি হল তোর?"
-"কিছু না। ভালোলাগছে না।"
রিমি ঠিক বুঝতে পারে না পরমার কি হয়েছে।
-"আমি একটু জল খাবো, আছে তোর কাছে?" রিমিকে বলে পরমা।
"এবার আমাদের স্টেজ ছাড়তে হবে পরমাত্মার জন্য, কিন্তু তার আগে পরমাত্মাকে জানাই শুভ জন্মদিন।" অনুনয় বলে ওঠে স্টেজ থেকে, "আর এবার আমাদের শেষ গান, এই গানটা ট্রিবিউট টু পরমাত্মা। আমাদের আর তোমাদের সকলের তরফ থেকে। সবাই গাইবো তো?"
-"হ্যাঁ...",গোটা নজরুল মঞ্চ যেন ফেটে পড়ল। প্রতিটা দর্শক সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, সমুদ্রের গর্জনের মত শব্দ হল যেন।
পরমা মাথা নীচু করে বসে রইল, যে উচ্ছ্বাস নিয়ে ও এসেছিল, সবটাই যেন নিভে গেল এক লহমায় ।
অনুনয় গান ধরল, " ধন্য ধন্য বলি তারে... সবাই মিলে...ধন্য ধন্য বলি তারে...", সমস্ত দর্শক একসাথে গেয়ে উঠল," ধন্য ধন্য বলি তারে ..."
গ্রীনরুমে বসে জ্ঞান ঠিক এই জিনিসটার অপেক্ষাতেই ছিল, ও জানত আজ অনুনয় চেষ্টা করবে সমস্ত লাইম লাইট কেড়ে নেওয়ার। আর মাস্টার প্ল্যান ছিল এটাই। শো হিট হবে, দর্শকও নাচতে নাচতে হাঁপিয়ে যাবে, আর তারপর ওরা স্টেজ থেকে নামলে ক্লান্ত দর্শক যখন একটু শান্ত হবে, শরীর ঠান্ডা হবে, তখনই শুরু করবে রজত।
জ্ঞান জানে পাবলিক নাচানো পরমাত্মার জ্যঁ নয়, পরমাত্মা পাবলিককে নাচায় না। পরমাত্মার গান শুধু পরমাত্মার নিজের নয়, পরমাত্মার গান শ্রোতারও নিজের গান, তাদের মনের কথা।রজত গাইবে মঞ্চে আর শ্রোতা গাইবে মনে মনে। শ্রোতা হাসবে, কাঁদবে, রেগে যাবে, বাড়ি গিয়ে ভাববে। তাহলেই তো অ্যালবাম বিক্রি হবে।
জ্ঞান জানে রজত পারফর্ম না করতে পারলে এই ফাটকা খেলাটা অনেক বড় ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু শিকারকে তাড়া করে, এক ঝটকায় মাটিতে শুয়ে দিতে গেলে ওঁত পেতে বসে থাকতেই হবে। টসে জিতে নিজের মাঠে সেকেন্ড ব্যটিং করতে আসার পিছনে যে ঠান্ডা মাথা লাগে, জ্ঞানের সেই মাথা আছে।রজত ভাল গায়ক কিন্তু মাচা পাবলিকদের এই জগতে লড়তে গেলে পাবলিকের পাল্স বুঝতে হয় ।
* * * *
-" মম দুঃখ বেদন..."
হল ভর্তি অন্ধকারে দর্শকের গুঞ্জন যেন হঠাৎই থেমে গেল,
সেন্টার স্টেজের টপ লাইটের নীল আভার নীচে বসে আছে একটা ছায়া মূর্তি।
-" স্মোক, স্মোওওক!" ফিসফিস করে বলে ওঠল জ্ঞান ।
ধোঁয়ায় আবার ঢেকে গেল সেই মূর্তি ।
-" পরমা! রজত!" চাপা কন্ঠে বলল রিমি।
পরমা মাথা তুলে তাকাল মঞ্চে, এ কে? কার কন্ঠ শুনছে পরমা? এতো তার চেনা রজত নয়!
-"মম সফল স্বপন..."
পরমা অনুভব করল যে দর্শক এতোক্ষণ উন্মাদ হয়ে গেছিল, তারা সব চুপ। যারা মাঝখানে বাইরে গেছিল আর আবার গেট খুলে সবে ঢুকেছে, তারাও পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন একটা অন্য জগত, সব অন্য মানুষ ।
-"তুমি ভরিবে...সৌরভে... নিশীথিনি-সম..."
কিন্তু রজত রবীন্দ্র সংগীত কেন গাইছে? ওতো কখনও ভালোই বাসত না গাইতে, পরমা কতবার ওকে রিকোয়েস্ট করত, তাও কোনোদিন রজত গায়নি, বলত,"যেটা বুঝতে পারছি না, অনুভব করছি না, সেটা গেয়ে গানটাকে অপমান করব কেন?'
-"তুমি রবে নীরবে..."
কি বোর্ডে একটু আলতো ছুঁল পাভেল।
-"হৃদয়ে মম... তুমি রবে নীরবে..."
না, এই রজতকে কেউ দেখেনি আগে, এ ঘোস্ট নয়, এক নতুন মানুষ । ওর গানে সেই অশান্ত মনের কোনও ছাপ নেই, না পাওয়ার যন্ত্রণাও নেই। আছে শুধু শান্তি, বিরহ আর প্রেম!
-"রিমি! এই গানটা শুনে আমার কান্না পাচ্ছে কেন?" রিমির দিকে তাকিয়ে পরমা দেখে রিমির দুচোখ ভরে গেছে। তারপর খেয়াল করে একটা মানুষও নরছে না।
গানটা ওটুকু গেয়েই শেষ করল রজত, একটাও হাততালি পরল না, সবাই কেমন গুম মেরে গেছে। জ্ঞান বুঝতে পারল ওর প্ল্যান সফল!
তারপরই রজত বলে ওঠে,
" আমি জানি তুমি আছো,
আছো কাছাকাছি চোখের আড়াল করে,
যদি ভাবো ছুঁতে পরবো না,
তবে তুমি ভালোই বাসোনি।
তোমাকে না দেখেও দেখে নি,
না ছুঁয়েও ছুঁয়ে নি,
শুধু তুমিই বোঝোনা স্বপনচারিনী...."
চিৎকারে ফেটে পরে দর্শক, আর চমকে যায় পরমা, ও ভাবতেই পারেনি এতো মানুষ ভালোবাসে এই গান, এত মানুষ ভালোবাসে রজতের স্বপনচারিনীকে! আনন্দে ও রিমির হাত চেপে ধরে। তারপরই অনুভব করে, ও এখনও, এখনও ভালোবাসে রজতকে। আনন্দ, উৎকন্ঠা, দুশ্চিন্তা, আফসোস একসাথে ঘিরে ধরে ওকে। আর চুপ করে বসে থাকতে পারে না পরমা, গানটা শুরু হতেই হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করে ও। সমস্ত দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ, আর মন্ত্রবলে আবদ্ধ স্বয়ং সেই দেবী, যার অনুপ্রেরণায় তৈরী এই গান।
বিড়ম্বনা বোধহয় একেই বলে। রজত গেয়ে উঠল পরমাকে নিয়ে লেখা ওর গান, পরমার চোখ বন্ধ। আর চোখের জলে ভেসে গেল সেই মুখোশটা যেটা পড়ে ও পাঁচ বছর কাটিয়ে দিল। নতুন করে তৈরী করা এই পরিচয়টাকেই পরমা সত্যি বলে ধরে নিয়েছিল, কিন্তু আসল সত্যিটা আজ এই নীলচে অন্ধকারে বেরিয়ে পরল, পরমা আজ এক নতুন রূপ দেখল নিজের ।
তোমায় ছুঁতে পারি আমি একবারও না ছুঁয়ে,
স্বপনচারিনী।
মনের মধ্যে থেকে যেও শুধু ভালোবাসা হয়ে,
স্বপনচারিনী।
রোজই কত মানুষ মরছে
পাচ্ছে না ভালোবাসা,
আমিও না হয় তাদের দলে লেখাব আমার নাম।
তাতে ক্ষতি কি?
রোজই কত স্বপ্ন ভাঙছে,
ভাঙছে বুক আর আশা,
আমিও নাহয় স্বপ্নগুলোর পাবো না কোনো দাম।
তাতে ক্ষতি কি?
তোমায় ভালোবাসতে পারি কোনদিন না পেয়ে,
স্বপনচারিনী।
তোমায় নিয়ে বাঁচতে পারি একটা স্বপ্ন হয়ে,
স্বপনচারিনী।
ক্রমশ:~