রকস্টার (ধারাবাহিক উপন্যাস)
রকস্টার (ধারাবাহিক উপন্যাস)
পর্ব :: ১
প্রথম অধ্যায় :: স্বপ্ন
পরমার আজ জন্মদিন, রজত রোজকার মতোই পৌঁছে গেছে ওর কাছে, ওকে দেখতে। পরমা ত্রিশ বছরে পা দেবে আজ, আজ তাই ও মন খুলে রান্না করছে সকাল থেকে। এমনিতে রান্নায় ও খুব একটা পটু নয় এটা রজত জানে। কিন্তু শৈবাল আর শ্বশুরবাড়ির মানুষদের জন্য পরমা সব করতে পারে। শৈবাল ভাট্টাচার্য্য, পরমার হাজবেন্ড। পরমার সাথে ওর অ্যরেঞ্জড ম্যারেজ। ভীষন ব্যস্ত মানুষ। বিদ্যুৎ বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার।পরমার সাথে সময় প্রায় কাটাতেই পারেনা। কিন্তু তাতে পরমার সমস্যা নেই।সারাদিনে সমস্ত কাজ শেষ করে, সবাইকে সময় দিয়ে যতটুকু সময় ওরা বিছানায় একান্তে কাটায় তাতেই সব উজাড় করে দেয় দুজনে। কথায় আদরে ভরে ওঠে দুটো মন। এভাবেই কাটিয়ে দেয় পরমা। পরমা এরকমই ভীষন আন্ডারস্ট্যান্ডিং। চার বছর তো এভাবেই কেটে গেল ওর বিয়ের! গত বছর ওরা এই গরমকালে গেছিল দার্জিলিং, জন্মদিন কেটেছিল টাইগার হিলের শোভায়। "আহাহা! ভাবলেই মন ভাল হয়ে যায়", মাংসটা রান্না করতে করতে চনমন করে উঠল পরমা। গন্ধ বেশ ভালো লাগছে মাংসটার। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রজত মন দিয়ে দেখছিল পরমাকে। কত আনন্দ আজ পরমার মনে। কত সুন্দর লাগছে আজ ওকে। ঠিক যেমন লাগত ওরা যখন একসাথে ছিল...
-"বৌমা, মাংসটা হল?" খাবার ঘর থেকে মিষ্টি করে জিগ্গেস করে উঠল পরমার শ্বশুর মশাই।
-"হ্যাঁ বাবাই, হয়ে এসেছে, আরেকটু অপেক্ষা করো।" পরমা উত্তর দেয় ।
-"মানি, পোলাওটা এসেগেছে!" বলে উঠল পুচি।
-"দাদাকে বলো চারশো টাকা দিতে ।" পুচিকে নির্দেশ দিল পরমা । পুচি শৈবালের বোন। ও আবার পরমার কাছেই পড়ত এককালে, তখন থেকেই পরমাকে মানি বলে, ওর জন্যই অবশ্য পরমা আর শৈবাল কাছাকাছি আসে, ও নাকি জানত পরমাই ওর বৌদি হবে।
রবিবার ছাড়া সকলের একসাথে খাওয়াই হয় না। তাই রবিবার দিনটা খুবই সুন্দর কাটে ভট্টাচার্য পরিবারের ।
তবু কোনো কোনো রবিবার শৈবাল শহরের বাইরে থাকলে তা হয় না । তবে আজ না, পরমা অনেক আগে থেকে শৈবালকে বলে রেখেছিল আজকের দিনটা ওকে থাকতেই হবে। শৈবালও না বলে নি। রবিবার দিনটা ওর ও ছুটতে ভালোলাগেনা । কিন্তু করবে, বিদ্যুৎ বিভাগ বড় জটিল জায়গা, আর সেখানে ওর মত ইঞ্জিনিয়ারকে সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয় । কিন্তু আজ ও ছুটি চেয়ে রেখেছিল, পরমা সচরাচর বায়না করে না, আজ তাই কোন কাজ নয় ।
সবটাই নিঃশব্দে দেখছিল রজত, ঠিক যেন একটা সিসিটিভি ক্যমেরা। ও রোজই এভাবে দেখে পরমার সংসার, আর পরমার ভাল থাকা, নিভৃতে, নীরবে। কেউ জানতেও পারে না ও আছে, না, পরমাও না। তবে আজ ওর আসা উচিত হয়নি। আজ তো ও পরমাকে উইস করতে পারবে না ও।
ফোনটা বেজে ওঠে পরমার, খাবারের টেবিলের অদূরেই টিভি ইউনিটের উপর রাখা ওটা। কিন্তু পরমা ধরে না। কিছুক্ষন পর আবার বেজে ওঠে ফোন। এবারও কেউ ধরে না। সবাই নিজের মতো মন দিয়ে খাচ্ছে ।
তৃতীয় বার বেজে উঠল ফোনটা, কিন্তু কেউ যেন শুনতেই পাচ্ছে না রিংটা। রজত খুব বিরক্ত হয় এটা দেখে। কিন্তু ও কথা বলতে পারছে না, কেউ ওর কথা শুনতে পায় না । ফোনটা আবার বেজে ওঠে, গোটা ঘরে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না সেদিকে। পরমা শৈবালকে পোলাও দিচ্ছে, শৈবাল মুরগীর ঠ্যাংটা চিবোচ্ছে আদিমভাবে, ঠোটের কোন থেকে ঝোল গড়িয়ে পড়ছে। ফোনের অসহ্য রিংটোন টা সেই একইভাবে বাজছে। পাঁচ-ছয়-সাতবার। একটু পর পরই।
রজত পরমাকে বলার চেষ্টা করছে কিন্তু ও কথা বলতে পারছে না এখনও। পুচি আর পরমার শ্বশুর খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে উঠল, ফোনটা হাতের কাছেই ছিল কিন্তু কেউ তুলল না, রজতের রগ ফুলে উঠছে, কিন্তু পরমাকে ডাকতে পারছে না, কেউ যেন ওর গলা টিপে ধরেছে, হাত দিয়ে প্রাণপন ইশারা করলেও পরমা তাকাচ্ছে না রজতের দিকে । ফোনের রিং আবার বেজে উঠল, রজত এবার চিৎকার করে উঠল সজোরে , "আআআআআ!"
দুম করে বিছানায় উঠে বসে পরল রজত। জোরে জোরে শ্বাস নিল, না কিছু হয়নি, স্বপ্ন দেখছিল। ঠিক যেমন ও রোজই দেখে। আর গত পাঁচ বছর ধরে এভাবেই ঘুম ভেঙে যায় ওর। স্বপ্ন দেখে । একটা ভালো স্বপ্ন । পরমার ভালোথাকার স্বপ্ন। তারপর অ্যলার্মের বিচ্ছিরী শব্দে ঘুম ভাঙ্গে , আচম্বিতে ।
একটু জল খেয়ে নিয়ে খাটে বসেই সিগারেট ধরায় সে, তারপর জানালার কাঁচ খানিকটা ফাঁকা করে ধোঁয়াটা বাইরে ছেড়ে দেয় । সকাল ১১টায় ড্রাইভার শিবা আসবে, ১টায় নজরুল মঞ্চে পৌঁছতে হবে ।
আবার ফোনটা বেজে ওঠে, শিবা কল করছে ।
-"দাদা হামি এসে গেছি, আপ রেডি হো?"
-"নহি বে বিহারিবাবু, তু উপর আকে চাবি লেকে যা, গাড়ি সাফ কর, ম্যয় ফ্রেশ হোকে আতা হু।"
ফোনটা কেটে সিগারেটটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে রজত, তারপর আবার ফোনটা তোলে সময় দেখতে।
১০:৪৫, ১৯শে জুলাই ২০১৯, আজ পরমার ত্রিশ তম জন্মদিন, আর ওর ব্যন্ড 'পরমাত্মা'র দশতম, রজত মনে রেখেছে। রজত চিরকাল মনে রাখবে।
* * * *
-"বাবা চা।"
কাপটা বাড়িয়ে দিয়ে, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে পরমা।
-"কিছু বলবে?" না তাকিয়েই পরমাকে প্রশ্ন করে ওর শ্বশুর মশাই।
-"আসলে বাবা, আজ আমার জন্মদিন..." বলেই ঠক করে শ্বশুরকে একটা প্রনাম করে পরমা।
-"থাক থাক, এসবের দরকার নেই, ভাল থেকো।" বলেই আবার খবরের কাগজে চোখ ফেরান শঙ্করবাবু। তারপর বলেন, " তোমার শ্বশুরীকে প্রনাম করে এসো"।
কয়েক সেকেন্ড পর দেখেন পরমা দাঁড়িয়ে আছে তখনও।
-"কি ব্যপার, দাঁড়িয়ে আছো কেন? কিছু বলতে চাও?"
-“আসলে বাবা, আজ একটু মা-বাবার কাছে যেতে চাই ও বাড়ি, তাই আপনার কাছে জিগ্গেস করতে এসেছিলাম, মানে..."
-" ও! আচ্ছা' পেপারে চোখ ফিরিয়ে বললেন," বাবু জানে? আর তোমার শ্বশুরী মা?"
-"হ্যাঁ, জানে।"
-" তাহলে আমাকে বলতে এসেছ কেন? চলে যাও।"
-"না মানে আপনার পারমিশন না পেলে..."
পেপারটা খচমচ করে মুখের সামনে থেকে সরিয়ে রিতিমত বিরক্তি ও ব্যঙ্গের সুরে বললেন,"সবই তো ঠিক করে রেখেছো, তাহলে আর আমার পারমিশন দরকার কি? যাও।"
মাথা নিচু করে 'আচ্ছা' বলে বেডরুমের দিকে এগিয়ে যায় পরমা, এতক্ষন আতঙ্কে থাকলেও এবার একটু মুচকি হাসে।
শৈবাল এখনো ঘুমাচ্ছে, কাল পার্টি করে প্রচুর মদ খেয়েছে। খাটের পাশের টেবিলে লেবুর জলটা রেখে, এসিটা চালিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরোয় পরমা।
শ্বশুরী তখন টিভি চালিয়ে বসে আছে, সকাল থেকে মৌনব্রত রেখে সিরিয়াল দেখাই তার কাজ। কাজের বৌটাও
ঝাঁটা হাতে নিয়ে বসে হাঁ করে সিরিয়াল গিলছে।
-"মামনি, আসছি।"
মুখে পান গুঁজে বসেছিলেন মৌসুমী, সারা দিলেন, "উঁ", ককন আবে?"
-"সন্ধ্যার মধ্যেই চলে আসব।"
-"রান্না হয়ে গেছে বৌ?" কথা বাড়িয়ে দিল কাজের বৌ।
-"হ্যাঁগো মাসি হয়েছে, শুধু তোমার কাজটা তুমি ঝটপট্ করে দিলে মানুষগুলো খেয়ে নিতে পারে ।"
-"আমি করে নেব, তুমি কোথায় যাচ্ছিলে যেন?"
একটু রাগ হয় পরমার,একটু বিরক্ত হয়ে বলে "মা বাবার কাছে।" তারপর ভাবে এবার বেরোনো দরকার নয়ত দেরী হয়ে যাবে। দেওয়াল ঘড়িতে দেখল দুপুর ১:০৫।
-"মামনি আসছি আমি।"
-"উঁ"।
-'কবি সুভাষ থেকে রবীন্দ্র সরোবর মেট্রোয় লাগে কুড়ি মিনিট মতো । কিন্তু বাকি রাস্তাটা হাঁটতে হবে এই রোদে?' মনে মনে ভাবে পরমা। বাড়ি থেকে রিক্সা করে মেট্রো স্টেশন আসতে আসতেই ও দেখতে পেল একটা মেট্রো বেরিয়ে গেল।
'যাঃ; মানে আরো পনের মিনিট দাঁড়াতে হবে!',হতাশ হয়ে যায় পরমা। তাহলে তো দেরী হয়ে যাবে? না, তা করা যাবে না।
রিক্সাওয়ালাকে বলে, "দাদা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড আছে না এখানে কাছে? নিয়ে চলো না।"
-"যাবো আট টাকা বেশী লাগবে।"
-"আট টাকা!" অবাক হলেও বেশী তর্ক করে লাভ নেই বুঝে পরমা বলল,"চলো, একটু তাড়াতাড়ি ।"
তিন দিন পর বাইরে বেরোলো পরমা, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কত যুগ ও পৃথিবী দেখেনি । কি ভাল লাগছে সব কিছু ।মুক্ত বিহঙ্গী যেন এক।
ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে নেমেই দাঁড়িয়ে থাকা এক ড্রাইভারের দিকে দৌড়ে এগিয়ে যায় পরমা, "দাদা যাবেন?" উৎকন্ঠিত হয়ে জিগ্গেস করে পরমা ।
"হ্যাঁ যাবো দিদি, বসুন।" বলে ট্যাক্সি চালক।
কোনো কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসে পরমা, "চলুন! একটু তাড়াতাড়ি চালাবেন দাদা।"
"হাঁ দিদি, কোথায় যাবেন বলুন?"
"নজরুল মঞ্চ!"
"আচ্ছা"।
ট্যাক্সি ছুটল, জানলার ধারে বসে মুক্তির শ্বাস নিল পরমা।
আজ ওদের জন্মদিন, ওর আর 'পরমাত্মা'র। আজকের শো ও মিস করবে কিভাবে? এটাই তো ওর এতদিনের স্বপ্ন ছিল, ওর জন্মদিনে হাজার হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে রজত গাইবে ওকে নিয়ে লেখা প্রথম গান,
'তোমায় ছুঁতে পারি আমি একবারও না ছুঁয়ে,স্বপনচারিনী!'
চলবে:~