রজনীগন্ধা
রজনীগন্ধা
ঠিকানা অনুযায়ী এই বাড়িটাই হওয়া উচিত। এক অজানা আকর্ষণে জয় সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। চারিপাশের বাড়িগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে এপাড়াটা নেহাতই শান্ত-শিষ্ট মধ্যবিত্ত পাড়া। তার সামনে নীচু পাঁচিল ঘেরা ছোট্ট একটা একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় বাগান। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জয় ফিরে গেল মাসখানেক আগের এক অলস দুপুরে।
" সুরমা ছাত্রাবাস", বাড়িমালিক জিতেনবাবু স্ত্রীর প্রতি নিজের প্রেমের বহিঃপ্রকাশ করতে নাকি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মত রাগী স্ত্রীকে ঠান্ডা রাখতে স্ত্রীর নামে মেসবাড়ির নাম রেখেছেন সেটা নিয়ে অনেকেরই মনে ধন্দ থাকলেও ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে তাঁর মেসবাড়ি অদ্বিতীয় এটা নিয়ে দ্বিমত নেই। কোনও আলতু-ফালতু, বখাটে ছেলে তাঁর মেসবাড়িতে জায়গা পায় না। মূলত কলেজ-ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া ছেলেরা থাকে এই মেসে। জয় আর শুভম ছাড়া সপ্তাহান্তে মেস ফাঁকা। সবাই বাড়ি গেছে আর জয়দের মত থার্ড ইয়ারের ছাত্রদের তো ফাইনাল পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেছে। জয় আর শুভম পদার্থবিদ্যার ছাত্র। আগামী সপ্তাহে ওদের প্রজেক্ট ভাইভা হবে তাই বেচারারা বাড়ি যেতে পারেনি। পড়াশোনা করারও সেরকম কিছু নেই তাই রবিবাসরীয় দুপুর কাটানোর উপায় হিসেবে শুভম বেছে নিয়েছে খবরের কাগজ আর জয় দিবানিদ্রার তোড়জোড় করছিল কিন্তু কারেন্ট চলে গিয়ে তার বিশ্রামের দফারফা করে দিল।
" পেপারটাই একটু দে।" জয় লাফিয়ে শুভমের খাটে চলে এল।
" এই শুভ, একটু সানডে ফান ডে করবি?" জয় চোখ নাচিয়ে বলে।
" মানে?" শুভম ভ্রু কোঁচকায়।
হাতের রবিবাসরীয় কাগজটার দিকে শুভমের দৃষ্টি আকর্ষন করে জয় মজার ভঙ্গিতে বলে," একটু সময়ের জন্য পাত্র-পাত্রীর বাড়ির লোক সাজলে কেমন হয়? মোবাইলে তো
আন লিমিটেড টকটাইম।"
জয়ের প্রস্তাব শুনে শুভমও নিছক একটু দুস্টুমি করার জন্য রাজী হয়ে গেল।
" তোর আইডিয়াটা মন্দ নয় কিন্তু কেউ যদি কলব্যাক করে আরও কিছু জানতে চায়?"
" আরে, ভুজুং ভাজুং করে ঠিক ম্যানেজ করে নেব। চিন্তা করিস না।" জয় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে।
" ওকে। চল দেখি কাদের ফোন নাম্বার দেওয়া আছে।"
দুই বন্ধুতে হামলে পড়ল পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনের ওপর।
" প.ব কায়স্থ, শ্যামলা, এম.এ, গৃহকর্মে নিপুনা, বয়স ২৫। উপযুক্ত পাত্র চাই।" জোরে জোরে বিজ্ঞাপনটা পড়ল জয়।
" বুঝলি মেয়ের বাবা বহুত কিপ্টে। এত শর্টে সেরেছে বিজ্ঞাপনটা! ফোন নাম্বার আছে। এটা দিয়েই শুরু করা যাক।" জয় শুভকে উদেশ্য করে বলে।
" এই রিং হচ্ছে।" জয় ফোনটা স্পিকারে দেয়।
" হ্যালো।" কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বর যে কোনও বয়স্ক মানুষের তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জয় নিজের কন্ঠস্বর যথাসম্ভব গম্ভীর করে বলে," বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করছি। আমার ভাই একজন সরকারী কর্মী। তার জন্যই পাত্রী খুঁজছি।"
" আপনারা কবে আসতে চান বলুন। আমার মেয়ে খুব ভালো। ওর মত মেয়ে হয়না। পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষকেও সুখী রাখতে পারবে ও। ঈশ্বর হয়ত ওকে রূপ ঢেলে দেননি কিন্তু ওর মনটা গড়েছেন নিজে হাতে করে। ওর সাথে আলাপ হলেই বুঝতে পারবেন আপনারা। আমার নাম সুরেশ রায়। আমার বাড়ির ঠিকানা হল...।" ভদ্রলোক গড়গড় করে কথাগুলো বলে গেলেন।
" শুনুন বলছি কি আমি তো এখনই বলতে পারব না কিছু। বাড়িতে আলোচনা করে জানাব।" গম্ভীর ভাবে জয় উত্তর দেয়।
" আপনারা আসবেন তো? আমি অপেক্ষায় থাকবো।" বৃদ্ধ মানুষটির করুণ স্বর ভেসে এল।
" হুম।" ফোনটা কেটে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল জয়। বয়স্ক মানুষটির কথাবার্তার মধ্যে এমন একটা আকুতি ছিল যা জয়কে নাড়িয়ে দিল।
" কি রে কি হল?।"
" কিছু না। আজ বিকেলে চল নদীর ধার থেকে ঘুরে আসি।"
" হ্যাঁ তাই চল।" শুভমও আর দ্বিরুক্তি করে না। বয়স্ক মানুষটির আর্তি তাকেও যেন কোথাও ছুঁয়ে গেছে।
" হ্যালো, কে বলছেন?"
" আমি সুরেশ রায়।"
" কে সুরেশ রায়?"
" আমার মেয়ের জন্য আপনি ফোন করেছিলেন। আপনার ভাই...।"
চমকে ওঠেছিল জয়। পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি চলে এসেছে সে। সেই রবিবারের কথা বিস্মৃত প্রায়। ভদ্রলোককে কি উত্তর দেবে ভেবে কূল পায় নি সে।
" আপনারা কবে আসবেন?"
"এখন একটু ব্যস্ত আছি।" ফোনটা কেটে দিয়েছিল সে। খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে শুভমকে ফোন করে। সব শুনে শুভম পরামর্শ দিয়েছিল," দ্যাখ, এভাবে ওনাকে মিথ্যে আশা দিয়ে লাভ নেই। এরপর ফোন করলে বলে দিবি তোর ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।"
পরের ফোনটা এসেছিল দিন কুড়ি পরে। জয় বাড়ি থেকে মেসে ফিরে এসেছিল। সেভাবে অর্থের প্রয়োজন ওর না থাকলেও নিজের চর্চার জন্যই বেশ কিছু টিউশন করে ও। সেদিনও এরকমই এক ছাত্রকে পড়ানোর মাঝেই ফোনটা এল।
" হ্যালো, আমার বাড়ির ঠিকানা...।"
" আপনি!"
" আমি সুরেশ রায়। আমার মেয়েকে আপনার ভাইয়ের জন্য দেখতে আসবেন বলেছিলেন।"
" আমার ভাইয়ের অন্য জায়গায় বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে।" যাহোক করে এক নিঃশ্বাসে কথাটা শেষ করেছিল জয়।
" ওহ, ঠিক হয়ে গেছে! আমি ভাবলাম আমার বাড়ির ঠিকানাটা বোধহয় ভুলে গেছেন। আচ্ছা, ঠিক হয়ে গেছে তাহলে আমার অভাগীটার...।" নিজের মনেই কথাগুলো বলতে বলতে ফোনটা রেখে দিয়ে ছিলেন ভদ্রলোক।
ফোন আর আসবে না এ বিষয়ে নিশ্চিত হলেও মনের গহনে একটা অপরাধ বোধের কাঁটা ক্রমাগত বিঁধছিল জয়কে। আজ এদিকে এক বন্ধুর বাড়ি এসেছিল। ফেরার সময় জয়ের অবচেতন মন তাকে এই ঠিকানায় উপস্থিত করেছে।
" তুমি কি কাউকে খুঁজছ?" চমকে উঠল জয়। ঈষৎ শ্যামলা, দীর্ঘাঙ্গী, পিঠে একঢাল কালো চুলের ঝর্ণা, মুখশ্রী আর ভাসা ভাসা চোখ দুটো যেন বিষণ্নতার মায়া বিজড়িত। এই কি সে যে নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষকেও সুখী রাখার ক্ষমতা রাখে?
" কি হল?"
" আমি একজনের বাড়ি খুঁজছি টিউশন পড়ানোর জন্য কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না।" এর চেয়ে যুৎসই বাহানা জয়ের মুখে জোগাল না।
" কার বাড়ি খুঁজছ?"
" ছেলেটার নাম পিকলু আর কিছু জানিনা। আমার এক বন্ধুর আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা। ওকেও ফোনে পাচ্ছি না।" নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বাধ্য হয়ে মিথ্যে কথা বলল জয়।
" এভাবে কারোর বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায়!" মিষ্টি করে হেসে বলল সে। কি যেন একটু চিন্তা করে জিজ্ঞেস করল," তোমার সাবজেক্ট কি?"
" ফিজিক্স।"
" কোন ক্লাস থেকে তুমি টুইশন পড়াও? সিক্সের বাচ্চাকে সায়েন্স গ্রুপ পড়াবে?"
এই দুনিয়ায় অনেক সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার সহজবোধ্য কোনও ব্যাখ্যা থাকে না। জয় কোনও দিন ক্লাস নাইনের নীচে কাউকে টিউশন পড়ায় নি কিন্তু আজ নিজের চেয়ে বছর চারেকের বড় একটি মেয়ের চোখে চোখ রেখে সে কোনও রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই সম্মতি জানাল।
" ভেতরে এস।" গেট খুলে দিল মেয়েটি। বাড়ির মধ্যে নিয়ে যেতে যেতে জয় কোন কলেজে পড়ে, রেজাল্ট কেমন হচ্ছে এরকম আরও কিছু প্রশ্ন করে গেল সে আর জয় মন্ত্র-মুগ্ধের মত উত্তর দিয়ে গেল।
" করবী, কে এল রে? আজ কি কেউ তোকে দেখতে আসবে?"
" না, নীলের জন্য টিউশন টিচার এসেছেন।" ঈষৎ কড়া গলায় উত্তর দিল সে। তারপর জয়ের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে হাসল।
সুরেশ রায় অবসর প্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক। পুত্র-কন্যা নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন। ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বয়সের ব্যবধান একটু বড়ই বেশি যাইহোক ছেলে পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি ফার্মে চাকরী শুরু করে। ছেলের বিয়ে দেন। নাতী নীল জন্মায় কিন্তু তারপরেই তাঁর সংসারে প্রথম দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে। ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে এক দানব ট্রাকের তলায় শেষ হয়ে যায় তাঁর পুত্র ও পুত্রবধূর জীবন। সেই ধাক্কা পুরোপুরি সামলানোর আগেই আবার বিপদ আছড়ে পড়ে তাঁর সংসারে। সুরেশবাবুর স্ত্রীর লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে। আর্থিক এবং মানসিক সবদিক দিয়েই দুর্বল হয়ে পড়েন সুরেশবাবু যদিও তাঁর কন্যা করবী নিজের সাধ্যমত সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করে যায়। মায়ের অসুখ, ছোট্ট নীলের দেখাশোনা, নিজের পড়াশোনা সবকিছু নীরবে সামলে গেছে সে যদিও তার বয়স তখন নিতান্তই অল্প। যে বয়সে আজকালকার ছেলে-মেয়েরা নিজের কাজটা নিজে করতে পারেনা সেই বয়স থেকেই করবীকে দশভুজা হতে হয়েছে। সুরেশবাবুকে নিঃস্ব করে দিয়ে তাঁর স্ত্রীও একদিন চিরতরে বিদায় নিলেন। সংসারে পড়ে রইল শুধু ছোট্ট নীল, মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত সুরেশবাবু আর করবী। সুরেশবাবুর পেনশন ছাড়া আর কোনও সম্বল নেই তাই পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন আর টুকিটাকি কাজও শুরু করে করবী। এভাবেই এম.এ পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে চাকরীর চেষ্টা করছে সে কিন্তু এরপরই গোলযোগ দেখা দেয়। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে সুরেশবাবু শারীরিক ও মানসিক দুই ভাবেই সম্পূর্ণ ভঙ্গুর হয়ে গেছেন। ওনার ধারণা উনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না তাই করবীকে পাত্রস্থ করতে চান উনি। করবী অনেক নিষেধ করেছে কিন্তু সুরেশবাবু অনড়। করবীকে লুকিয়ে তিনি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। চেনা পরিচিতদেরও বলছেন। তাঁর এই কর্মকান্ডের ফল হয়েছে একটাই যে কথাটা করবী ওনাকে আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছে কিন্তু মুখ ফুটে বলে উঠতে পারেনি সেইকথাটাই লোকে মুখের ওপর বলে দিয়েছে। এমন কোনও মেয়েকে ঘরের বউ করে কেউ নিয়ে যেতে চায়না যার পেছনে অসুস্থ বৃদ্ধ পিতা আর অনাথ ভাইপো রয়েছে। এটা তো খুব স্বাভাবিক যে সুরেশবাবুর মৃত্যুর পর করবী ছাড়া নীলের আপনজন বলতে আর কেউ থাকবে না। তার মামাবাড়িতেও তাকে দেখার মত কেউ নেই। মুশকিল হল সুরেশবাবু এই সহজ সত্যিটা মেনে নিতে পারছেন না। তিনি মেয়েকে বধূবেশে দেখার অপেক্ষায় থাকেন। জয় নীলকে পড়াতে গিয়ে আস্তে আস্তে সব কথা জেনেছে। যত সবকিছু জেনেছে তত যেন মরমে মরে গেছে সে। খুবই সামান্য টাকায় সে নীলকে পড়ায়। বিনাপয়সায় পড়ানোর কথা বললে ওনাদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগতে পারে তাই অল্প কিছু টাকা সে নেয়। এখন সে এবাড়ির আপনজন হয়ে গেছে। নীলের তো সে ফ্রেন্ড, ফিলজফার অন্ড গাইড হয়ে গেছে আর সুরেশবাবু তাঁর একলা মনের অলীক কল্পনা উজাড় করে দেন জয়ের কাছে। তাতে ভদ্রলোকের অস্থির মন কিছুটা শান্ত হয় আর জয়ের অপরাধবোধ কিছুটা হলেও কমে। তবে জয় যার সাথে সবচেয়ে বেশী কথা বলতে চায় সেই করবী এমনিতেই খুব চুপচাপ থাকে। নিজের কাজে ডুবে থাকে। বোধহয় নিজের চারপাশে একটা আবরণ তৈরি করতে চায় যাতে তার মনের গভীরে জমে থাকা ব্যথা-যন্ত্রণা, একাকীত্বের তল কেউ না পায়। তার একমাত্র শখ বাগান করা বিশেষ করে রজনীগন্ধা ফোটানো। জয় মাঝে মাঝে রজনীগন্ধার কন্দ এনে দিলে করবীর চোখে যে আনন্দ ঝরে পড়ে তার জন্য জয় হাজার মাইল হাঁটতে পারে।
" একটা সত্যিকথা বলবি?" শুভম একদৃষ্টিতে জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে।
" কি?"
" তুই ওবাড়িতে কেন যাস? শুধুই কি একটা অনাথ ছেলের পড়াশোনায় সাহায্য করার জন্য? নিছক মজা করতে গিয়ে একজন অসহায় মানুষকে আঘাত করার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য?"
" হঠাৎ এরকম কথা বলছিস কেন?"
" এড়িয়ে যাস না। আমি তোকে খুব ভালো ভাবে চিনি। প্রায় দুবছর হতে চলল তুই ওবাড়িতে যাস। আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে সুদীপদার সময় ছিল না তাও তুই ওকে ধরে বেঁধে রাজী করিয়েছিস নীলকে ইংরেজি পড়ানোর জন্য। সারা দুনিয়া খুঁজে তুই রজনীগন্ধার কন্দ জোগাড় করিস নাহলে কিনিস। সবই তো আমার জানা। আজ আমি এই জানার পেছনে যে গোপন সত্যিটা আছে সেটা জানতে চাই। "
শুভমের প্রশ্নের উত্তরে জয় চোখ নামিয়ে নিল," আমি করবীকে ভালোবেসে ফেলেছি। প্রথম যেদিন ওকে দেখেছিলাম সেদিনই। লাভ অ্যট ফার্স্ট সাইট।"
" পাগল হয়ে গেছিস তুই? ও তোর চেয়ে চারবছরের বড়।"
" জানি। তাই তো আজ পর্যন্ত ওকে কিছু বলিনি তবে আমি ওকে ভীষন ভালোবাসি।" জয়ের গলা ধরে এল। শুভম উঠে এসে নিঃশব্দে জয়ের কাঁধে হাত রাখল।
"আমার অবশ্য অনেক আগেই সন্দেহ হয়েছিল।" শুভমের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বন্ধুর জন্য। জয়ের এই একতরফা ভালোবাসার পরিণতি কি হতে পারে ভাবতে লাগলো সে।
কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। জয় আর শুভমের মাস্টার ডিগ্রীর পরীক্ষা শেষের মুখে।
" শুভ, একটা কথা বলব?"
" বল না।"
" আমি যদি করবীকে নিজের মনের কথা বলি? মানে বলছিলাম কি আমার তো মাস্টার ডিগ্রী কমপ্লিট হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত কয়েক বছরের মধ্যে আমি কোনও না কোনও চাকরী জোগাড় করে নেবই। ও যদি অপেক্ষা করে আমার জন্য। এমনিতেও তো কেউ ওকে বিয়ে করতে রাজী হচ্ছে না। আমি ওদের সব দায়িত্ব নিতে রাজী। মুখে বলার সাহস পাচ্ছি না তাই একটা চিঠি লিখেছি। ভাবছি এই রজনীগন্ধার গোছাটা আর এই চিঠিটা ওকে আজ বিকেলে দেব। বয়সের ব্যবধানটা আজকাল আর এমনকি। অনেকেই তো আজকাল বয়সে বড় মেয়ে বিয়ে করে। তুই বল না শুভ আমি কি ভুল কিছু করছি? তুই ছাড়া কেউ আমার অনুভূতি বুঝবে না।" জয়ের গলা ধরে এসেছে।
শুভম একটু চুপ করে থেকে বলল," আই থিংক ইউ আর রাইট। তুই যখন ওকে এত ভালোবাসিস তখন বলেই দে। আর এটা তো সত্যি ভালোবাসায় বয়সটা বাধা হওয়া উচিত নয়। দরকার হলে ওদের বাড়ি গিয়ে করবীদিকে আমি বোঝাব।" শুভম আশ্বাস দেয় জয়কে।
" সত্যি শুভ?"
" হুম।" স্মিত হেসে উত্তর দেয় শুভ।
" আসব?" জয়দের আলোচনায় ছেদ পড়ল। দরজায় দাঁড়িয়ে সুদীপ।
" আরে সুদীপদা এসো।" সুদীপ এসে তক্তপোষে বসে। তার চোখে-মুখে অস্থিরতা। কিছু একটা বলতে চাইছে সে কিন্তু কোথাও একটা বাধা।
" সুদীপদা কিছু বলবে?" শুভম জিজ্ঞেস করে।
" হ্যাঁ, মানে জয় তোকে একটা কথা বলতে চাই। তোকে ছাড়া আর কাকে বলব আমি ভেবে পাচ্ছি না।"
" কি কথা?"
" থ্যাংকস জয়।"
" কিসের জন্য?"
" তুই আমাকে নীলকে পড়াতে যাবার জন্য জোর করেছিলি বলে।"
" মানে?" বিস্মিত হয় জয়।
" মানে ওবাড়িতে না গেলে তো আমি করবীর দেখা পেতাম না।" লাজুক স্বরে বলে সুদীপ। জয় বাকরুদ্ধ হয়ে সুদীপের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। শুভমই কথা বলে," তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমরা।"
সুদীপ দুস্টুমি ভরা কণ্ঠে বলে," মাস্টার ডিগ্রী শেষ হয়ে গেল তাও এখনও বাচ্চা আছিস মনে হচ্ছে। আমার কথাটার মানে হল আমি করবীকে ভালোবাসি। ওকে বিয়ে করতে চাই। ওর মত মেয়ে জীবনসঙ্গী হলে আমি বর্তে যাবো রে।"
" তুমি করবীদিকে প্রপোজ করেছো?" শুভমই প্রশ্ন করে। জয় স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।
" না রে। ইচ্ছে করেই আমি এখনও বলিনি। জয় তো সবই জানিস। কি কারণে করবীর সব সম্বন্ধ ভেঙ্গে গেছে কিন্তু আমার কোনও সমস্যা নেই। নীলের কথা ভাবলেই তো খারাপ লাগে আমার। এই বয়সেই জীবনে কত আঘাত পেয়েছে। ওকে ভালোভাবে মানুষ করতে পারলে আমার নিজের খুব ভালো লাগবে। আমি ভালো চাকরী করি। আমাদের আর্থিক অবস্থাও যথেষ্ট ভালো কিন্তু মা-বাবার কি প্রতিক্রিয়া হবে বুঝতে পারছি না। মা কিরকম রাগী জানিস তো। আমি একমাত্র সন্তান তাই ওনাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে করবীকে বিয়ে করা সম্ভব কিনা সেটাও বুঝতে পারছি না তাই আমি করবীকে এখনও কিছু বলিনি। ওকে আমি আঘাত করতে চাই না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না কি করব। জয় তো করবীকে খুব ভালো ভাবে চিনিস তাই মনে হল একবার তোর কাছে আসি। সব খুলে বলি।" সুদীপের কন্ঠস্বর আদ্র হয়ে এল।
বাগানময় রজনীগন্ধার গন্ধ ম ম করছে। এর অনেকগুলোই যে জয়ের সংগ্রহ জানে শুভম। আজ জয়ের সঙ্গে তার ভালোবাসার মানুষটাকে দেখতে এসেছে সে। সুদীপ আর সুদীপ বাবা-মাও এসেছে। সেদিন সুদীপ চলে যাওয়ার পর জয় চিঠিটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলেছিল। রজনীগন্ধাগুলো জানালার পাশে শুকিয়ে গেছিল। শুভম বলেছিল," সুদীপদার মত তুইও তো করবীদিকে ভালোবাসিস। তোদের কারুর ভালোবাসার কথাই ও জানেনা তাহলে তুই নিজের অনুভূতির কথা ওকে জানাবি না কেন?" জয় ভারী অদ্ভুত একটা উত্তর দিয়েছিল," ওকে ভীষন ভালোবাসি তাই জানাবো না। আমি ওর জন্য এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর সুদীপদা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। বহিঃপ্রকাশ না ঘটালেও আমি বুঝতে পারি সংসারের জোয়াল টানতে টানতে ক্লান্ত করবী একটু নিশ্চিন্ত বিশ্রামের জন্য কারুর কাঁধে মাথা রাখতে চায়। আমায় পক্ষে তো এই মুহুর্তে ওকে সেই ভরসার জায়গাটা দেওয়া সম্ভব নয়। আমি চাই ও ভালো থাকুক।" শুভমকে অবাক করে দিয়ে জয় নিজে গিয়েছিল সুদীপের বাবা-মার সঙ্গে কথা বলতে এবং সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার যে সুরমাদেবীর ভয়ে শুধু বাড়ির লোকজনই নয় মেসের ছেলেরাও তটস্থ হয়ে থাকে সেই মানুষটাই সব শুনে এককথায় করবীদের বাড়ি যেতে রাজী হয়ে গেলেন শুধু তাই নয় ওদের অবস্থার কথা শুনে তাঁর মধ্যে যে সহানুভূতি ফুটে উঠল তা দেখে সুদীপও অবাক হয়ে গেল।
জয় ধরে ধরে সুরেশ বাবুকে সামনের ঘরে নিয়ে এল।
"দাদা, আমি আপনার মেয়েকে আমার পুত্রবধূ করে ঘরে নিয়ে যেতে চাই। আমার ছেলে সুদীপকে তো আপনি চেনেন।" জিতেনবাবু বললেন। আনন্দে বিহ্বল সুরেশবাবু যেন ঘোরের মধ্যে আছেন। ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা করবীকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন লাল বেনারসীতে। জয় লক্ষ্য করল করবীর দৃষ্টি গোপনে ছুঁয়ে যাচ্ছে সুদীপকে কিন্তু এখনও তার চেহারায় বিষণ্নতার ছাপ।
"আমার যৌতুকে একটা জিনিস চাই?" সুরমাদেবী বললেন।
" কি জিনিস?" শঙ্কিত সুরেশবাবু প্রশ্ন করলেন।
সুরমাদেবী উঠে গিয়ে নীলের মাথায় হাত রেখে বললেন," আমার নীল দাদুভাইকে চাই। একটাই ছেলে আমার। সেও কবেই বড় হয়ে গেছে। আমি নীল দাদুভাইকে মনের মতো করে মানুষ করব।"
করবীর মুখের বিষণ্নতা একলহমায় বদলে গেল রক্তিম লালিমায়। করবী আর সুদীপ পূর্ন দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকালো। করবী নিজের আনন্দাশ্রু গোপন করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
বাগানে দাঁড়িয়ে জয় দেখতে পেল বারান্দার শেষ প্রান্তে সুদীপ একগোছা রজনীগন্ধা বাড়িয়ে দিল করবীর দিকে। লাজুক মুখে সেটা গ্রহণ করে করবী সলাজে কিছু একটা বলছে সুদীপকে।
যাকে নিজের সমগ্র হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছে আজ তাকে সুখের পথে এগিয়ে যেতে দেখতে পাচ্ছে জয়। একদিন যে মানুষটাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিল আজ সত্যি তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে পারছে সে। জয় আজ তৃপ্ত।
মেল বক্সটা খুলল জয়। সে আর শুভম দুজনেই এখন মুম্বাই আই আই টিতে পি.এইচ.ডি করছে। একটা মেল এসেছে। প্রেরক করবী। ওদের বিয়ের আগেই শহর ছেড়ে চলে এসেছিল জয়। করবী লিখেছে জয় ব্যস্ত মানুষ তাই ফোন না করে মেল করছে সে যাতে জয় সময় করে পড়তে পারে। অনেক কিছু লিখেছে করবী। তার সুখের সংসারের কথা, নীল মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে সে কথা, সুরেশবাবু এখন অনেক সুস্থ সে খবর আর জয়ের জন্য অনেক ধন্যবাদ পাঠিয়েছে। সঙ্গে পাঠানো ফটোটা প্রাণ ভরে দেখল জয়। খুশিতে ঝলমল করবী-সুদীপ আর ওদের ছোট্ট ছেলে। চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিশ্বাস নিল জয় ঘরময় রজনীগন্ধার সুবাস পাচ্ছে সে।

