রাঙিয়ে দিলে মন
রাঙিয়ে দিলে মন
আজ দোল তাই চারিদিকে নানা রঙের খেলা। সবাই মুখে বিভিন্ন রঙের আবির মেখে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে। কতো সুন্দর করে সবাই সেজেছে পলাশ ফুলের মালা দিয়ে খোঁপা বেঁধেছে। দোলের উৎসবের সাথে সাথে আকাশ বাতাস যেন নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছে। এক পসলা বৃষ্টি হয়ে আকাশে রামধনু ফুটে উঠেছে। সবাই যেন আজকে একসাথে রঙ খেলায় মেতেছে। আমি গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বার করে সমস্ত কিছু দুচোখ ভরে দেখছি। কি সুন্দর লাগছে সবকিছু।
হঠাৎ করে বাবি বলে উঠলো কি.... হলো তোর.... দিদিয়া কথা বলছিসনা কেন?
আমি গাড়ির মধ্যে মুখটা ঢুকিয়ে বললাম কই কিছু হয় নি তো!!
বাবি বলল দেখনা মা কি বলছে??
আমি বললাম কি বলছে না বললে জানবো কি করে??
বাবি বলল দেখনা দিদিয়া..... মা বলছে আমি যেন রঙ খেলার জন্য বেশি হুটোপুটি না করি!!
আমি বললাম কেন করবিনা নিশ্চয়ই করবি, তবে সাবধানে। আমাকেতো দেখছিস এই রকম কিছু যেন আর না ঘটে! কথাটা বলতেই সবার মুখ ভার হয়ে গেল।
আমি বললাম আমাকে সাথে নিবিতো রঙ খেলার সময়।
সাথে সাথে বাবি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল তোকে ছাড়া আমি রঙ খেলতে পারি। আগে তোকে বেশি করে রঙ মাখাবো, তারপর আমি খেলবো
আমি বাবিকে কাতুকুতু দিয়ে বললাম তাই নাকি?
বাবি হো... হো... করে হাসতে শুরু করলো সাথে সাথে মা বাবার মুখে হাসি ফুটে উঠল।
আমি আবার জানলার বাইরে মুখটা বার করে চারিদিকে দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলাম সেইদিন এই রকম দোলের দিন ছিল। আমি মা বাবা আর বাবি মিলে শান্তিনিকেতনে এসে ছিলাম দোল উৎসব দেখব বলে। সকাল সকাল উঠে হলুদ শাড়ী পড়ে পলাশ ফুলের মালা দিয়ে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে ছিলাম। প্রভাতি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। বাবি তখন অনেকটা ছোট আট বছর বয়স। সারাদিন সবার সাথে রঙ খেলেছিলাম। চেনা অচেনা কিছুই ছিলনা। সবাই সবাইকে রঙ লাগিয়েছিল।
সরাদিন ধরে রঙ খেলে বিকেলে ক্লান্ত শরীরে যখন হটেলে ফিরছি তখন ঘটে যায় আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দূর্ঘটনা। যার জন্য আজ আমার জীবন থেকে কিছুটা হলেও খুশি বাদ চলেগেছে।
আমাদের হোটেল টা ছিল মেন রাস্তার উল্টোদিকে। বাবি ছোট থেকেই আমার সাথে থাকতে খুব ভালোবাসে। বাবা রাস্তা পার হয়ে ওপারে চলে যায়। মা বাবির হাত ধরে আর বাবি আমার হাত ধরে আছে। আমরা রাস্তা পার হচ্ছি হঠাৎ একটা বাইক ফুল স্পিডে আমাদের সামনে চলে আসে আমি বাবির হাতটা ছেড়ে দিই মা বাবিকে টেনে নেয় আর আমি বাইকের সামনে পরে যাই। বাইকটা আমাকে ধাক্কা মেরে আমার পায়ের ওপর দিয়ে চালিয়ে চলে যায়। যন্ত্রণায় আমি জ্ঞান হারাই।
যখন জ্ঞান ফেরে জানতে পারি আমার পা দুটো বাদ চলেগেছে। সেই থেকে আমি হুইল চেয়ারে বসে আমার জীবন কাটাচ্ছি। সেইদিন যদি আমি বাবির হাতটা না ছাড়তাম তাহলে এই ঘটনাটা বাবির সাথে ঘটতো বাবিকে আর বাঁচানো যেতোনা। তারপর থেকে আমরা আর শান্তিনিকেতনে আসিনি। আজ আবার বহু বছর পর বাবির ইচ্ছায় আজ আমরা শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি। যদিও মা আর বাবা প্রথমে রাজি হয়নি আমার কথা ভেবে। কিন্তু বাবির জন্য আমি মা আর বাবাকে রাজি করিয়েছি।
বাবি আনন্দে বলে উঠল ঐ দেখ দিদিয়া আমরা শান্তিনিকেতনে চলে এসেছি।
আমি চোখের কোনে জমে থাকা জলটা মুছে বললাম হ্যাঁ।
বাবি বলল এইবার খুব আনন্দ হবে দিদিয়া।
আমাদের গাড়িটা এসে হোটেলের সামনে দাঁড়ালো। বাবি, মা, বাবা গাড়ি থেকে নেমে হুইল চেয়ার বার করে আমাকে বসালো। আর বাবি চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে বকবক করতে করতে চলল আমাকে নিয়ে। রুমে ডুকে ফ্রেস হয়ে বাবি আর আমি সুন্দর করে সেজে রেডি হয়ে নিলাম। সবাই মিলে একসাথে আসলাম যেখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে সেখানে। বাবি আমাকে রঙ মাখিয়ে খেলতে শুরু করে দিল সবার সাথে। বাবা, মা,আর আমি দেখতে থাকলাম সবকিছু।
হঠাৎ একটা ছেলে মুখে রঙমেখে ভূত হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল তুই সোহিনী না?
আমি একটু অবাক হলাম আমার নামটা শুনে, কিন্তু ওর মুখটা রঙে ঢাকা তাই চিনতে পাড়লামনা।
ছেলেটা আবার বলল কিরে হা করে কি দেখছিস চিনতে পারছিসনা নাকি?
আমি ঢোক গিলে বললাম না ঠিক চিনতে পারছিনা
ছেলেটা তখন হাসতে হাসতে বলল আরে আমি আবীর। মনে আছে তুই আমার রোগা চেহারা দেখে আমাকে বলতিস সুরবীর।
আমি এবার আনন্দে উৎসাহিত হয়ে বললাম সুরবীর তুই..... এতো মোটা হলি কি করে? কতদিন পর তোকে দেখলাম। কি করছিস? কোথায় থাকিস এখন?
আবীর বলল তুই একটুও পাল্টাসনি সোহিনী পেঁচি। সেই আগের মতোই একসাথে হাজার টা প্রশ্ন। আমি উত্তর দিতে দিতে হাফিয়ে যাবো।
আমি হো.... হো.....করে হেসে উঠলাম। বহুদিন পর আজ আমি প্রানখুলে হাসলাম। আমার হাসি দেখে বাবা মার মুখটা আনন্দে ভরে উঠল। বাবা বলল তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না?
আমি একটু অভিমানের সুরে বললাম চিনবে কি করে? ও আর আমি একসাথে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি। তারপর যে ও..... কোথায় চলেগেল আর কোনো খোঁজ পাইনি। অনেক খুঁজেছি।
আবীর বলল সোহিনী পেঁচির মনে হচ্ছে আমার ওপর খুব রাগ আছে।
আমি বললাম আছেইতো আমি তোর সাথে কথা বলবোনা।
আবীর হাসতে হাসতে বলল ঠিক আছে বলতে হবেনা আমি যেগুলো বলবো সেগুলো শুনবি তাহলেই হবে।
আমি হেসে ফেললাম। বরাবর আমি আবীরের ওপর রাগ দেখতে পারিনা ও ঠিক আমাকে হাসিয়ে দেয়।
আবীর মা আর বাবাকে প্রনাম করলো। মা, বাবা বলল থাক বাবা থাক আর্শিবাদ করি অনেক বড়ো হও।
আবীর বলল চল রঙ খেলবো এখানে চুপচাপ বসে আছিস কেন? তুইতো বসে থাকার মেয়ে নোস।
আমি বললাম তুই মনে হয় আমাকে ঠিক করে লক্ষ্য করিসনি এখন আমার জীবন বসেই কাটে।
আবীর আমার কথা শুনে ভালো করে আমার দিকে চেয়ে দেখে বলল কি হয়েছে সোহিনী তুই হুইল চেয়ারে কেন? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা!
আমি বললাম কি করে বুঝবি চলে যাবার পর আর খোঁজ নিয়েছিস কোনদিন? সে সব অনেক ঘটনা ওসব থাক, তোর কথা বল।
আবীর আমার বাবা আর মাকে বলল কাকু কাকিমা যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে তাহলে আমি সোহিনীকে নিয়ে একটু ঐ দিকে যাবো ওর সাথে অনেক কথা আছে।
বাবা বলল হ্যাঁ যাও বাবা। তোমার সাথে কথা বলে ওর কষ্টটা যদি একটু কম হয়।
আবীর আমাকে নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে আমার সামনে বসে বলল সোহিনী আমাকে সব বল।
আমি বললাম তুই আগে আমার প্রশ্নের উত্তর গুলো দে না হলে আমি বলবোনা।
আবীর বলল জানি তোর খুব জেদ শোন আমার বাবার চাকরি বদলি হয় তাই আমরা কন্যাকুমারি চলে গিয়েছিলাম। ওখানে বাকি পড়াশোনা করি এখন শান্তিনিকেতনে পড়াই বুঝলি?
আমি বললাম কাকু, কাকিমা সব ভালো আছে? তুই বিয়ে করেছিস?
আবীর বলল এবার তুই আগে বল তারপর আমি বলবো।
আমি বললাম কি আর বলবো বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে........ সমস্ত ঘটনাটা আবীরকে বললাম। এই স্মৃতি মনে করলে কষ্টে আমার চোখে জল ভরে আসে।
আবীর আমার চোখের জলটা মুছিয়ে দিয়ে বলল কাঁদিসনা কাঁদলে তোকে সত্যি সত্যি পেঁচি লাগে।
আমি হাসতে হাসতে বললাম আমি কিন্তু আগের মতো তোকে ঘুষি মারবো।
আবীর বলল মার, কতদিন তোর হাতের ঘুষি খাইনি। আমি তোকে খুব মিস করতাম সোহিনী পেঁচি।
আমি বললাম আর প্রশ্নের উত্তর গুলো দিলি নাতো?
আবীর বলল পাঁচমাস হলো বাবা মারা গেছে আমি আর মা এখন এখানেই থাকি আর তোর মতো কোনো পেঁচি পাইনি তাই বিয়ে করা হয়নি! আচ্ছা তুই বিয়ে করেছিস?
আমি ব্যাঙ্গের সুরে বললাম তুই যে কি বলিস সুরবীর কে আর আমার মতো বোঝাকে বিয়ে করবে, তবে বাবা মা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আবীর হাসতে হাসতে বলল আমাকে বিয়ে করবি পেঁচি আমি কিন্তু ফ্রি আছি।
আমি বললাম দূর তুই ইয়ারকি করা বন্ধ কর।
আবীর ওর গালটা আমার গালে ঘষে ওর গালের রঙ আমার গালে লাগিয়ে দিয়ে বলল এই দেখ তোকে আমার রঙে রাঙিয়ে নিলাম।
আমার মধ্যে অদ্ভূত রকমের একটা অনুভূতি হলো। আমি কিছু বলতে যাব দেখি বাবি, মা বাবা এসে বলছে চল এবার হোটেলে ফিরতে হবেতো......।
আমি আবীরকে বললাম এই হচ্ছে আমার ছোটো বোন বাবি না মানে রোহিনী।
আবীর বলল খুব রঙ খেলেছো রোহিনী তোমার মুখ বোঝাই যাচ্ছে না।
বাবি উৎসাহের সঙ্গে বলল আমার খুব আনন্দ হচ্ছে এখানে এসে।
আবীর আমার বাবাকে বলল কাকু আপনারা কালকে থাকছেন তো?
বাবা বলল না ভোর ভোর বেড়িয়ে যাবো।
আবীর বলল তাহলে সন্ধ্যে বেলায় আপনারা আমাদের বাড়িতে আসুন। আমি হোটেল থেকে আপনাদের নিয়ে আসব।
বাবা বলল পরে না হয় আসব কোনো.... একদিন।
আমি বললাম চলোনা যাই.....।
আমার কথায় সবাই রাজি হয়ে গেল। আমাদের হোটেলে ছেড়ে দিয়ে আবীর বাড়ি চলে গেল। মনটা আজ আমার ভীষণ খুশি। আবীরের দেখা পেয়ে। আমাদের বন্ধুত্বটা ছিলো টম আ্যান্ড জেরির মতো। সব সময় দুজনের সাথে দুজনের ঝগড়া আবার দুজনের দুজনকে ছাড়া চলতো না। স্কুলে সবাই বলতো আমরা দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসি।
সন্ধ্যা বেলায় আবীর এসে আমাদেরকে নিয়ে গেল ওদের বাড়ি। কাকিমা মা, বাবার সাথে কথা বলতে লাগল। আর বাবি আমি আর আবীর বসে গল্প করতে লাগলাম।
আবীর আমার কানে কানে বলল বাড়ি পছন্দ হয়েছে পেঁচি এর পরতো এখানেই থাকতে হবে তোকে?
আমি বললাম তুই ইয়ারকি করাটা বন্ধ কর সুরবীর না হলে কিন্তু আমি ঘুষি মেরে তোর নাক ফাটিয়ে দেবো।
আবীর বলল, ভালোতো নাকফাটা বর নিয়ে ঘুরে বেড়াবি। কথাটা বলে আবীর উঠে দাঁড়িয়ে বলল কাকু মা আপনাদের সাথে একটা কথা বলবে।
আমার মা সাথে সাথে বলল হ্যাঁ বলুননা দিদি?
কাকিমা বলল আসলে আবীরের সোহিনীকে খুব পছন্দ যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে তাহলে আমি সোহিনীকে আমার বৌমা করতে চাই।
মা বলল কি বলছেন দিদি.....! আপনি সোহিনীর ব্যাপারে সব জানেন?
কাকিমা বলল হ্যাঁ জানি। আবীর আমাকে সব বলেছে।
আমি কথাটা শুনে অবাক হয়ে যাই।আর লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে যায়।
আবীর আমার কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে বলে কিরে লজ্জা পাচ্ছিস? । আবীর বলল তোমরা কথা বলো আমি সোহিনী আর বাবিকে নিয়ে ভিতরের ঘরে যাচ্ছি।
বাবি বলল আবীরদা তুমি আমার জিজু হবে?
আবীর বলল যদি তোমার দিদিয়া রাজি হয় তাহলে হবো।
আবীর আমার সামনে বসে আমার হাতটা ধরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল কিরে পেঁচি আমাকে বিয়ে করবি?
আমি লজ্জায় চোখটা নামিয়ে নিলাম।
আবীর আমাকে হুইল চেয়ার থেকে কোলে তুলে নিয়ে বলল হুর...রে আমার পেঁচি রাজি।
আমি লজ্জায় আবীরের বুকের মধ্যে নিজের মুখটা লুকালাম আর মনে মনে ভাবলাম আজ থেকে আবার আমার জীবন রঙে ভরে উঠলো। আমি তোর রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিলাম সুরবীর।

