রাঙা পিসীমা
রাঙা পিসীমা
এই ঘটনার সাথে আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।সকালবেলা বাজার থেকে ফিরে স্নান সেরে খেয়েদেয়ে অফিস যাবার জন্য তৈরী হয়েছি, এমন সময়নীচের গেটে একটা শব্দ শোনা গেল। মা বলল- “দ্যাখ তো বাবু কে এলো এই সময়?”সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম। একতলায় অ্যাডভোকেট প্রসন্ন চৌধুরী ভাড়া থাকেন। সাধারণতঃ কেউ এলে উনাদেরই কেউ নীচের গেট খুলে দেয়। প্রসন্ন চৌধুরী দু’দিন আগে পরিবার নিয়ে দেশের বাড়ি বেড়াতে গেছেন- আগামীকাল উনাদের ফেরার কথা। স্বপ্নিলকে আমি খুব মিস করছি। স্বপ্নিল প্রসন্ন চৌধুরীর ছেলে- অষ্টম শ্রেণীতে পড়লেও তার সঙ্গে আমার বেশ ভাব। স্বপ্নিলকে ঘুড়ি ওড়ানোর কলাকৌশল শেখাতে শেখাতে ছেলেবেলার স্মৃতিতে চলে যেতাম। সে যাই হোক, উপায়ান্তর না দেখে আমিই গেটটা খুললাম। দেখলাম কাপড়ের বোচকা হাতে একজন বৃদ্ধা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে- পরনে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, ঘোমটার নীচে মুখটা বেশ ফর্সা, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, মুখেচোখে এককালে শ্রী থাকলেও এখন কুঁচকে গেছে আর মাথায় অনেক পাকা চুলও নজরে পড়ল। বৃদ্ধাকে আমি এর আগে কখনও দেখিনি।আমি- “কাকে চান?”বৃদ্ধা খনখনে কন্ঠে বলল- “এটা প্রশান্তর বাড়ি মানে প্রশান্ত মুখার্জী?”আমি- “হ্যাঁ, প্রশান্ত মুখার্জী আমার বাবা। আপনি ভিতরে আসুন।“বৃদ্ধা- “না, তুমি আগে প্রশান্তরে ডাকো।“ আমি কি বলতে যাব, থমকে গেলাম।
আমার বাবা গতবছর মারা গেছে। বৃদ্ধা বাবাকে চেনে অথচ বাবা যে গত বছর মারা গেছে তা জানে না।আমি- “মানে...বাবা তো মারা গেছে।““মারা গেছে? কবে?” বৃদ্ধা তীক্ষ্মকন্ঠে জিগ্যেস করে।আমি- “গত বছর মারা গেছে।““হায় ভগবান, কও কি...আমারে কেউ খবর দিল না”- বৃদ্ধা আর্তনাদ করে উঠল। ততক্ষণে মা দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে।মা- “কে রে?”“আমি চিনি না মা”- মুখ ফিরিয়ে বললাম।“রাঙাদি মনে হচ্ছে না?” বলে মা চেঁচিয়ে বলল।“হ, আমি রাঙাদি”- বৃদ্ধা মাথা নেড়ে বলে।একতলার সিমেন্টের উঠানটা রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা উঁচু। “আপনি ভিতরে আসেন” বলে বৃদ্ধার হাত ধরলাম। ধরেই চমকে উঠলাম। বৃদ্ধার হাত ভীষণ ঠান্ডা আর ভেজা। যেন মরা কিছু ছুঁয়েছি। মা নীচে নেমে এসে বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে বলল- “কত বছর পর তোমারে দেখলাম রাঙাদি। আমাগো একদম ভুইলাই গেছ দেখি।“ বলে আমার দিকে তাকিয়ে মা বলল- “রাঙাদি মনে তোর রাঙা পিসী তোর বাবার এক তুতো বোন। বেহালায় থাকেন।“ আমি ঘড়ি দেখলাম, ওদিকে কাজে যেতে দেরী হলে আমার লেট ফাইন অবশ্যম্ভাবী।আমি- “মা, আমি আসি তাহলে।
আমার কাজে যেতে দেরী হয়ে যাচ্ছে।“মা- “আচ্ছা, সাবধানে যাস। চলো রাঙাদি, ওপরে চলো। তোমারে কতদিন পর দেখলাম। সেই বিয়ের পর একবার দেখছিলাম।“গলিতে নেমে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। বেশ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। সকালের দিকে অবশ্য মেঘলা ছিল। আমার অফিস কাছেই। ভাগ্য ভাল দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মফঃস্বলে পড়াশোনা করবার পর স্নাতক স্তরে কলকাতায় পড়াশোনা করলেও নিজের জায়গাতেই একটা ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছি। বাবা গতবছর মারা যাওয়ার পর ছোট্ট সংসারে আমি আর মা। আমার অবশ্য এক বড় দিদি আছে, নাম মৌমিতা। মৌমিতাদির বিয়ে হয়ে গেছে- শ্বশুরবাড়ি সোদপুর।ফাঁকা ঘরে আমার মায়ের ভালো লাগে না। মা আমার জন্য পাত্রী দেখছে। চাকরির পর মা আমার বিয়ের ব্যাপারে সিরিয়াস হয়েছে। পাত্রী অবশ্য একরকম ঠিক করাই আছে- সে হল রুমেলা, কলকাতার মেয়ে। মৌমিতাদির বান্ধবী জাহ্নবীদির ছোট বোন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে স্থানীয় এক মহিলা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছে রুমেলা। প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসে আর মায়ের সঙ্গে খুব ভাব। রুমেলাকে সঙ্গে নিয়েই মা বিয়ের শাড়ি কিনছে। রুমেলার বড় মামা অস্ট্রেলিয়ায় থাকে- তিনমাস পর দেশে ফিরবে। তখন বিয়ে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে রাঙা পিসীর কথা মনে হল। অফিস থেকে হাঁটতে হাঁটতে বাজারে গেলাম। এদিক-ওদিক ঘুরলাম কিছুক্ষণ। সকালে বাজারে এসে বড় একটা কাতলা মাছ কিনেছি। শাকসব্জী ও ফলমূল মজুত আছে ঘরে। বেছে বেছে দরদাম করে এক ডজন গন্ধ লেবু কিনলাম। হঠাৎ মনে পড়ল মা কালরাতে সুপারি কিনতে বলেছিল। সুপারি কিনে বাজারের বাইরে এসেছি- ঠিক তখনই সৌভিকদার সঙ্গে দেখা। সৌভিকদা পদ্মা পিসীর ছেলে। পদ্মা পিসী আমার বাবার তুতো বোন আর তারা তালতলায় থাকে। অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই। সৌভিকদার সঙ্গেও অনেকদিন পরে দেখা। সৌভিকদা নিউ আলিপুরে পোলট্রির ব্যবসা করে। ওকে দেখতেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম- “আরে সৌভিকদা, কি খবর? অনেকদিন পরে দেখা! বাড়ির সবাই ঠিক আছে তো?”সৌভিকদা- “কি বলি বলতো অর্ক, মা খুব অসুস্থ। আজকালের মধ্যেই মাকে নিয়ে কলকাতায় যাব। ডাক্তার ভাল পেলে সেখানেই মায়ের ট্রিটমেন্ট করাব।“সৌভিকদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গলিতে হাঁটছি। লোডশেডিং চলছিল বলে গলি অন্ধকার। পদ্মা পিসী অসুস্থ শুনে খারাপ লাগছিল। আজকাল পদ্মা পিসীদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কমে গেলেও এককালে বেশ ভালই যোগাযোগ ছিল। ছেলেবেলায় পদ্মা পিসী আমাকে আদর করে ঘুড়ি কেনার পয়সা দিতেন। উনার হাতে তৈরী আমের আচার আর লেবুর শরবতের ব্যাপারই ছিল আলাদা। অনেক সময় রবিবার দিন উনার বাড়ি গেলে ভালমন্দ খাওয়াও জুটে যেত। বাড়ির সামনে আসতেই কারেন্ট এল।বাড়িতে ঢুকেই মাকে বললাম- “আজ বাজারে সৌভিকদার সঙ্গে দেখা হল।“মা- “কি কইল সৌভিক? ওর মা কেমন আছে?”আমি- “শুনলাম পদ্মা পিসী অসুস্থ।
সৌভিকদা উনাকে নিয়ে কলকাতায় ভাল ডাক্তার দেখাবে বলে ঠিক করেছে।“ শুনে মা অস্থির হয়ে উঠল। বলল- “তুই কালই আমারে তালতলা নিয়া চল। পদ্মাদের সাথে একটু দেখা করে আসি। বেশ কয়েকবছর যাইনি ওদের ওদিকে।“আমি- “আচ্ছা, তোমাকে কালই তালতলা নিয়ে যাব।“ঘরে ঢুকে রান্নার চমৎকার গন্ধ পেলাম। রান্নাঘরে এসে দেখলাম রাঙা পিসী আগুনের সামনে বসে। হাতে গন্ধলেবুর ঠোঙাটা দিতেই পিসীর আঙুলের স্পর্শে চমকে উঠলাম- হাত কেমন ঠান্ডা, যেন মরা কিছু ছুঁয়েছি। রাঙা পিসী একটা অদ্ভুত শব্দ করে হেসে উঠল। চশমার কাঁচের ওপাশে চোখ দুটো যদিও নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে। আমার শরীর শিরশির করে উঠল। রাতে খেতে বসে অবাক হলাম। মুগডালের খিচুড়ি আর ধনে পাতা দিয়ে কাতলা মাছের অম্বল- সে এক চমৎকার রান্না।মা- “রাঙাদি রান্না করতে সাহায্য করেছে এগুলো। তোর বাবা মুগডালের খিচুড়ি আর ধনে পাতা দিয়ে কাতলা মাছের অম্বল খেতে খুব পছন্দ করত।"সেই রাতে আমার খুব একটা ভাল ঘুম এল না- বারবার এক অদ্ভুত স্বপ্নে ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছিল। রাত এগারোটার দিকে একবার রুমেলা মিসড কল দিয়েছিল। মোবাইলে রুমেলার সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ উষ্ণ প্রেমালাপ হল। মোবাইলের কল্যাণে এখন মফঃস্বলেও এরকম প্রেম সম্ভব। তারপর ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।ঘুম ভাঙার পর মনে হল ঘরে আমি একা নই, আরও কেউ আছে আর যে আছে সে অন্ধকারে ঘরের ভেতরেই হাঁটছে। ঘর অবশ্য একেবারে অন্ধকার নয়। জানলা দিয়ে চাঁদের ম্লান আলো ঢুকছে ঘরে। দেখতেই যাব কে ঘরে ঢুকেছে, এমন সময় খুট করে একটা শব্দ হল- মনে হল কেউ যেন কিছু খুঁজছে। এবার আমি বেশ ভয় পেলাম। আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। সাহস করে উঠে বসে আলো জ্বালালাম। নাহ, ঘরে কেউ নেই। আবার আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। তার আগে ঘড়ি দেখলাম- রাত দুটো। জানালায় হিমেল বাতাস আর জোছনার আলো। একটা সিগারেট ধরালাম আর সেই সময় আমার নাকে একটা অসহ্য গন্ধ এলো। মনে হল কেউ পুরো ঘরজুড়ে আলকাতরা ছড়িয়ে দিয়েছে। বিরক্ত হয়ে সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিলাম। ভিতরে-ভিতরে ভীষণ চঞ্চল বোধ করছি কেন জানি না। বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে আসতেই নীচে তাকিয়ে চমকে উঠলাম।দেখলাম বাড়ির উঠোনের ঠিক মাঝখানে স্বপ্নিল দাঁড়িয়ে- তার হাতে ঘুড়ি ওড়াবার লাটাই। ওদের তো আগামীকাল আসার কথা, তাহলে কি আজ রাতেই এসেছে আর আমিই জানি না। এখন রাত প্রায় দুটো বাজে, এতরাতে স্বপ্নিলের তো উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকার কথা না। ওরা তো রাত এগারোটার মধ্যেই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কারণ সকালে ওর বাবাকে কোর্টে যেতে হয় সময় মতন। দ্রুতপদে বারান্দায় এলাম। চোখ কচলিয়ে আরও একবার নীচে তাকিয়ে দেখলাম উঠোনে কেউ নেই। বুঝলাম যে হয়তো স্বপ্নিলের প্রতি আমার ভালবাসাটা একটু বেশী বলে ভুলভাল দেখছি, নয়তো ঘুমটা কাঁচা অবস্থায় ভেঙে যাওয়ার কারণে মস্তিষ্কে এর প্রভাব পড়ছে বলেও ভুলভাল দেখে থাকতে পারি। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে যখন ঘরে গিয়ে আবার ঘুমোবার তোড়জোড় করতে যাব, ঠিক তখনই বসার ঘরে ‘ঘড়ঘড়’ করে একটা শব্দ হল- কে যেন চেয়ারটা সরাল। এবার আমার মনে হল যে নাহ, আমি ভুল নই, সত্যি অনেকক্ষণ ধরে এসব অশরীরি কাণ্ডকারখানা ঘটে চলেছে। দ্রুত বারান্দা থেকে বসার ঘরে এলাম। বসার ঘরে ধূপকাঠির গন্ধ পেয়ে যারপরনাই আশ্চর্য হলাম কারণ এতরাতে আমি কখনও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে শুই না! আর ঠিক তখনই শোওয়ার ঘর থেকে ‘ঘটাং’ শব্দ হল। শোয়ার ঘরের পুরনো লোহার আলমারীটা খোলার সময় এরকম ‘ঘটাং’ করে শব্দ হয়। আশ্চর্য! এতরাতে কে আলমারী খুলল? মার তো ঘুমিয়ে থাকার কথা। দ্রুত শোয়ার ঘরে এলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আলো জ্বালালাম। নাহ, আলমারী বন্ধ। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা বেশ পুরনো আমলের বড় পালঙ্ক। তারই একপাশে মা গুটিশুটি মেরে শুয়ে কিন্তু পাশে রাঙা পিসী নেই। অবাক ব্যাপার, রাঙা পিসী গেল কই? বাথরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। বাথরুম থেকে জল পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। ওহ্, রাঙা পিসী তাহলে বাথরুমে? ঘরের আলো নিভিয়ে আমি ঘরে ফিরে আসি। একবার জানালায় উঁকি দিই। নাহ, নীচের উঠোনে কেউ নেই। কেবল সাদা জোছনার আলোয় ভরে আছে। নাহ্, আমারই মনের ভুল।পরদিন অফিস থেকে অর্দ্ধেক দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। মা তৈরী হয়ে ছিল। জিগ্যেস করলাম- “রাঙা পিসী কি তালতলা যাবে তোমার সাথে?”মা- “না রে, সকাল থেকে রাঙাদির শরীর খারাপ। ঘুমাইতাছে বেঘোরে।“ নীচে নেমে আমি আর মা পাশাপাশি হাঁটছি। বাজারটা কাছে বলে সেখান থেকে কিছু ফল আর মিষ্টি কিনে বাসে উঠলাম। তালতলা জায়গাটা কাছেই বলে পৌঁছতে সময় লাগবে না। সাত কিলোমিটারের মতো বাস রাস্তা।বাসে মাকে বললাম- “রাঙা পিসী আমাদের ঠিক কেমন আত্মীয় হয় বলো তো?”মা- “রাঙাদি তোর বাবার তুতো বোন। তোর বাবার সঙ্গে রাঙাদির সম্পর্ক বেশ ভাল ছিল। রাঙাদি নীচু জাতের একজনের সাথে প্রেম করত কিন্তু উনার বাবা সেই প্রেমিকের সাথে উনার বিবাহ দিতে রাজি হয় নি। তারপর জোর কইরা রাঙাদির বেহালায় বিয়া দেয় উনার বাবা।“আমি- “ওহ, তাহলে রাঙা পিসীর একটা বিষণ্ণতায় ভরা অতীত আছে আর সে তার টানেই এখানে এসেছে? এখন বেশ বুঝতে পারছি বাবার মুখে কেন কখনও রাঙা পিসীর কথা শুনিনি। কেন বাবা কখনও বেহালার কথাও বলেনি।“ তবু খটকা একটা থেকেই গেল। রাঙা পিসী বাড়ি চিনল কি করে? বৃদ্ধা মানুষ একা এলোই বা কি করে? মা বলল- “আমার বিয়ের পর রাঙাদিরে একবার দেখছিলাম। তিরিশ বছর আগে। আমারে খুব হিংসা করে রাঙাদি। একদম সহ্য করতে পারে না।““হিংসা করে কেন তোমাকে?” আমি অবাক।মা- “গতকালই আমারে রাঙাদি জিগ্যাস করল, তোমার বিয়ার গয়নাগাটি সব কি করছ রুক্ষ্মিনী? আমি কইলাম, আমার পোলার বিয়া ঠিক হইছে। গয়নাগাটি আমি ওর বৌয়ের হাতে দিমু। দেখি রাঙাদির মুখটা কেমন কালো হয়ে গেল। কইল, আমার পছন্দের মানুষের লগে আমার বিয়া হইলে গয়নাগাটি সব আমিই পাইতাম।“ মা-এর মুখে সব শুনে আমি তো অবাক হয়ে গেলাম।তালতলা অনেক দিন পরে এলাম। পাঁচ-সাত বছর তো হবেই। কেবল শহর নয়, এখন মফঃস্বলের লোকজনের মধ্যেও দূরত্ব বেড়েছে। তালতলায় পদ্মা পিসীদের টিনশেডের বাড়িটা গাছপালায় ঘেরা, বাড়ির সামনে উঠান, বাঁ পাশে গোয়াল ঘর, জামরুল গাছ, বড় পুকুর। ছেলেবেলায় ওই পুকুরে অনেক দাপাদাপি করেছি। সৌভিকদা পোলট্রির ব্যবসা ছাড়াও মাছ চাষও করে। পুকুর পাড়ে ঘন বাঁশঝাড়, অস্থির বাতাসে শনশন শব্দ। বাসে ওঠার পর আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হতে পারে। উঠোনে সৌভিকদার স্ত্রী সুমনা বৌদি দাঁড়িয়ে। কাপড় তুলছিল। আমাদের দেখে মুচকি হাসল। তারপর দৌড়ে বারান্দায় কাপড় রেখে ফিরে এসে মাকে প্রণাম করে বলল- “আসুন, ঘরে আসুন। কি সৌভাগ্য যে আপনাদের চরণধূলি এত বছর পরে এই গরীবের ঘরে পড়ল।“তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল- “কেমন আছেন অর্কদা?” উত্তর দেওয়ার পর ফল-মিষ্টির প্যাকেটগুলো দিলাম সুমনা বৌদির হাতে। পদ্মা পিসী একটা ঘরে শুয়ে আছে। শরীর আগের তুলনায় অনেক দুর্বল হয়ে গেছে, কালো মুখটা, বিশেষ করে চোখের চারপাশে ঘন কালি জমে আছে, মাথা ন্যাড়া। সৌভিকদা গতকালই ইঙ্গিত দিয়েছিল...ক্যান্সার। মা অনেকক্ষণ ধরে পদ্মা পিসীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। দুজনের অনেক কথা হল- বেশিরভাগই পুরনো দিনের। আমি পিসীর মাথার কাছে বসলাম। পিসী এই অবস্থাতেও আমাকে ঠিক চিনতে পারল। টিনের চালে তখন বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ। ঘরটা অন্ধকার হয়ে এসেছে। সুমনা বৌদি পান নিয়ে এল। তারপর ঘরের আলো জ্বালিয়ে বলল- “আপনার দাদারে ফোন করছি। এখনই আসছে।”মা পান মুখে দিয়ে বলল- “জানো, রাঙাদি আমাগো বাড়িত বেড়াইতে আসছে।““কার কথা কও? কোন রাঙা?” পদ্মা পিসী ক্ষীণ দুর্বল কন্ঠে বলল।মা- “ওই যে রাঙা। অর্কর বাবার তুতো বোন যার বেহালায় বিয়া হইছিল।“পদ্মা পিসী আর্তস্বরে বলল- “হায় হায়। কও কি গো! রাঙা তো পাঁচ বছর আগেই মারা গেছে।““মারা গেছে! কি কও পদ্মাদি?” বলে মা আমার দিকে তাকাল। আমি তো সব শুনে একদম হতবাক।আমি- “রাঙা পিসী মারা গেছে মানে?”পদ্মা পিসী- “হ গো, পাঁচ বছর হইল। সুমনার বাপের বাড়িও বেহালাতেই। আমরা তখন বেহালায় গেছিলাম। সুমনাও রাঙারে চিনে।““হ্যাঁ, উনাকে আমিও চিনি”- বলে সুমনা বৌদি মাথা নাড়ল।এত আলাপ-আলোচনার মাঝেই সৌভিকদা এল, অনেকটা ভিজে গেছে। মাকে প্রণাম করল। তারপর সব শুনে সৌভিকদাও বলল- “রাঙা পিসী মারা গেছেন পাঁচ বছর আগেই। তখন আমিও বেহালায় সুমনার বাড়িতেই ছিলাম। রাঙা পিসীর মারা যাওয়ার সময়টা আমিও ছিলাম সেখানে।“মা আমার দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইল। ফিসফিস করে বলল- “এরা কি কয় অর্ক? তাহলে আমাগো বাড়িতে কে আইল?” আমি আর কি বলব। এতগুলো লোক কি আর মিথ্যে কথা বলবে?হঠাৎ আসা বৃষ্টিটা কমে এসেছে। যত শিগগির সম্ভব বাড়ি যাওয়া দরকার। সৌভিকদাদের বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাসস্টপ পর্যন্ত ছাতা নিয়ে সৌভিকদা আমাদের দিয়ে এলো। ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে বাসে উঠলাম। বাসে মায়ের সঙ্গে তেমন কথা হল না। দু’জনে গভীর চিন্তায় ডুবে ছিলাম।মা কেবল একবার বলল- “এরা কি কইল রে অর্ক। রাঙাদি নাকি মইরা গেছে। তা হইলে আমাগো বাড়িতে কে আইল?”আমি- “বাড়ি না-ফেরা পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না মা।“বাস থেকে নেমে হাঁটছি। ততক্ষণে আবার ঝরঝরে রোদ উঠেছে কিন্তু তখনও আমাদের ঘোর কাটেনি। রাঙা পিসীকে আমি গতকাল দু-বার স্পর্শ করেছি। দু-বারই অত্যন্ত শীতল অনুভূতি হয়েছে। রাঙা পিসীর চোখের দৃষ্টিও কেমন নিষ্প্রাণ। মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছিল- রাঙা পিসী যদি মারাই যাবেন, তাহলে আমাদের বাড়ি যে এসেছে সে কে? কেন এসেছে? রাঙা পিসী বাবাকে খুব ভালোবাসত। বাবা মুগডালের খিচুড়ি আর ধনে পাতা দিয়ে কাতলা মাছের অম্বল খেতে ভালোবাসে বলে রাঁধল। মায়ের কাছে বিবাহের গয়নাগাটির খোঁজও নিল। আশ্চর্য! কাল রাতে ঘরে খুটখাট শব্দ পাচ্ছিলাম। যেন কেউ কিছু খুঁজছে। রাঙা পিসী আমাদের বাড়ি আসার পর থেকেই অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটছে। স্বপ্নিলকে দেখলাম গতকাল মাঝরাতে জোছনার ভিতর নীচের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে অথচ স্বপ্নিলরা গতকাল আসেই নি।এসব ভেবে আমার কেমন শীত-শীত করতে লাগল। আমি আর মা পাশাপাশি হাঁটছি। দূর থেকে দেখলাম বাড়ির গেটের সামনে স্বপ্নিল দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে স্বস্তি পেলাম। স্বপ্নিলর পরনে হলুদ গেঞ্জি আর নীল হাফ প্যান্ট। হাতে লাটাই। স্কুলের মাঠে ঘুড়ি ওড়াতে যাচ্ছে বলে মনে হল। কাছে এসে বললাম- “কি রে, তোরা কখন এলি?”“একটু আগেই এসেছি” বলে মিষ্টি হাসল স্বপ্নিল। তারপর বলল- “দেখো না অর্কদা, বাজার থেকে নতুন লাটাই কিনেছি।“ আমি হেসে মাথা নাড়লাম। একটু পর সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। সিঁড়িতে রুমেলাকে দেখলাম। নীচে নেমে আসছে। মাকে দেখে ভীষণ চমকে উঠল রুমেলা। তারপর ‘ওমা’ বলে হাত দিয়ে মুখ চাপা দিল। চশমা পরা ফর্সা মুখটা কেমন ভয়ে আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে, চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি। মায়ের দিকে চেয়ে খসখসে কন্ঠে রুমেলা বলল- “আপনি! এখানে!”মা- “হ, আমি। ক্যান, কি হইছে?”রুমেলা- “তাহলে ঘরে আমি কাকে দেখলাম?”মা- “কারে দেখলা রুমেলা?”রুমেলা- “আপনাকেই তো দেখলাম। আপনি আমাকে বিয়ের শাড়ি বের করে দেখালেন।“মা- “কও কি? দরজা খুলল কে?”রুমেলা- “কেন আপনি? বললেন এসো মা, অর্ক এখনও অফিস থেকে ফেরেনি।“আমি- “ঘরে আর কাউকে দেখনি? বৃদ্ধা মতন?”রুমেলা- “না তো, এরকম কাউকে দেখিনি তো।“আমরা দ্রুত উপরে উঠে এলাম। ফাঁকা ঘর। কেউ নেই। রাঙা পিসী কই গেল? আশ্চর্য! মা দ্রুত শোওয়ার ঘরে ঢুকল। পালঙ্কের ওপর শাড়ির স্তূপ এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শাড়িগুলি আমার পরিচিত- রুমেলার বিয়ের শাড়ি। ঘরের আসবাবপত্রগুলি সব ওল্টানো, অগোছালো, আলমারী খোলা। মা আর্তচিৎকার করে আলমারীর কাছে ছুটে গেল। তারপর ঝুঁকে বসে আলমারীর নীচের একটা ড্রয়ার খুলল। তারপর ‘হে ভগবান’ বলে চিৎকার করে উঠল।“কি হল!” আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে জিগ্যেস করলাম।মা- “গয়নার বাক্সটা আছে কিন্তু গয়নাগুলো হাপিস! পোড়ারমুখী রাঙাদি নিয়া গেছে। গয়নাগুলো রুমেলারে দিতে দিল না তো দিলই না- পোড়ারমুখীর এত জিদ। ওগুলোর ওপর খুব লোভ ছিল যে। আমার বিয়াতে আমার শাশুড়ি মা দিছিল দেইখা তার কি অভিমান। খালি আমারে ঘুইরা গয়না, ফিরা গয়নার কথাই জিগাইতো। তহনি বুঝছিলাম কোনও মতলব আঁটতাছে। দেইখা নিস, পোড়ারমুখী নরকে গিয়াও কোনওদিন সুখ পাইব না।“কথাটা শুনে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠল কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে- আর কিছু করার নেই। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে তখন জলের মতন পরিষ্কার। রাঙা পিসীর জীবদ্দশায় যেমন গয়নাগুলো তার নয়নের মণি ছিল, তেমনি ঠিক মৃত্যুর পরেও উনি এই গয়নাগুলোর মায়া ছাড়তে পারেন নি। এই ঘটনায় আমরা সবাই হতভম্ব- নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে এই আধুনিক যুগেও এরকম হতে পারে। একটা মানুষ আমাদের সাথে থাকল, আমাদের রান্না করে খাওয়াল, পুরানো দিনের কত কথাও বলল অথচ আমরা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেলাম না যে এতদিন ধরে আমরা একজন অশরীরি আত্মার সাথে বসবাস করেছি যার আসল মতলব ছিল যেনতেন প্রকারেণ আমার বিবাহের জন্য মায়ের রাখা গয়নাগুলো হাতিয়ে নেওয়া আর সেই উদ্দেশ্যে রাঙা পিসী পুরোপুরি সফল।

