STORYMIRROR

Arka Basak

Horror Fantasy Thriller

3  

Arka Basak

Horror Fantasy Thriller

পিশাচ

পিশাচ

11 mins
235

নমস্কার, আমি মলয় রাজবংশী, কলকাতার এক নামকরা কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। জন্মসূত্রে কুচবিহারের বাসিন্দা হলেও অধ্যাপনার কাজে আমার কলকাতায় আসা। প্রচণ্ড ব্যস্ততার পর পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতন কিছুদিনের ছুটি কিভাবে কাটানো যায়, সেই বিষয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করার পর ঠিক করি যে জলপাইগুড়িতে মামার বাড়িতে একবার হলেও কয়েকদিনের জন্য ঘুরে আসি কারণ প্রায় কয়েক বছর হতে চলল, মামার বাড়িতে একবারও যাই নি। সেই কয়েক বছর আগে একবার গিয়েছিলাম কিন্তু রাস্তাঘাট পুরোটা মনে নেই। এখন কিছুদিনের ছুটি আর হাতে অঢেল সময়- তাই টিকিট বুক করে শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চড়লাম। ট্রেন যখন নিউ ময়নাগুড়ি স্টেশনে থামল, রাত ঠিক একটা। যাত্রীদের স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেল। আমার সহযাত্রীদের বেশিরভাগই তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে যে যার বাসায় চলে গেল। আমি মামাদের সারপ্রাইজ দেব বলে আর ফোন করিনি। সঙ্গে থাকা ব্যাগ দুটোর একটা কাঁধে ঝুলিয়ে আর অন্যটা হাতে নিয়ে স্টেশন মাস্টারের ঘরের দিকে গেলাম।ভিতরে ঢুকতে দেখি সেখানে একজন ব্যক্তি বসে আছেন। তার পোশাক-আশাক দেখে বুঝলাম যে তিনিই এখানকার স্টেশন মাস্টার। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এখান থেকে জলপাইগুড়ি কত দূর? তিনি উত্তর দিলেন এখান থেকে জলপাইগুড়ি ৫০ কিমি। আমি তাকে বললাম যে এখন কোনও গাড়ি পাওয়া যাবে কি না? তিনি বললেন বেশ কিছুক্ষণ আগেই একটা গাড়ি জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে, এতরাতে এখান থেকে জলপাইগুড়ি যাওয়ার আর কোনও গাড়ি পাওয়া যাবে না, পরের গাড়ি সকাল ছ’টায়। তাই রাতটা কষ্ট করে এখানেই কাটাতে হবে। এই এলাকায় গভীর রাতে চলাফেরা করা একদম নিরাপদ না। পদে পদে অনেক রকম বিপদ-আপদ এসে উপস্থিত হয়। তাছাড়া লোকে বলে যে গভীর অন্ধকারে এই এলাকায় নাকি পিশাচ আর অপদেবতা ঘোরাঘুরি করে আর যাদের সামনে পায়, তাদের প্রাণে মেরে ফেলে। তাদের লাশগুলো নাকি আর পাওয়া যায় না। অনেকের সাথে এরকম হয়েছে শুনেছি, তাই আপনাকে সাবধান করে দিলাম।আমি- "ধুর! আজকের যুগেও দাঁড়িয়ে আপনি এসব অপদেবতা, ভূতপ্রেত, পিশাচের কথা বিশ্বাস করেন। আমার তো মনে হয় এসব মানুষের মনের অলীক কল্পনা। ভূতপ্রেত, পিশাচ বলে আজকের যুগে কিস্যু হয় না সেটা আমি প্রমাণ করে দেব।" এই বলে আমি উনার ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।বাইরে এসে দেখি চারপাশটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা কোথাও কোনও মানুষজন নেই, শুধুমাত্র দুটো কুকুর প্রচণ্ড কষ্টে কুঁইকুঁই করছে। পাশের ওয়েটিং রুমে গিয়ে একটা কাঠের চেয়ারে বসলাম কিন্তু বসতেই মশককুল আমাকে চারপাশ থেকে ছেঁকে ধরল। ভাবলাম মামাদের ফোন করে জানিয়ে দিই, তারা যেন আমাকে নিতে আসে কিন্তু কি ঝামেলা, মোবাইলেরও চার্জ শেষ। সামনে দু-তিনটে চার্জার পয়েন্ট আছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো কোনও কাজের নয়। কোনও উপায় না দেখে ভাবলাম যে কোনওমতে আজ রাতটা এখানে কাটিয়ে কাল সকালের প্রথম গাড়িতেই জলপাইগুড়ির উদেশ্যে রওনা হব। দেওয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দুটো বেজে গেছে। আর মাত্র ৩-৪ ঘণ্টা কোনওমতে কাটিয়ে দিলেই হল। ট্রেন যাত্রার ফলে এমনিতেই ক্লান্ত ছিলাম, তাই চোখে একটু একটু ঘুমঘুম ভাব আসতে লাগল। চোখ বন্ধ করে চেয়ারের ওপর শুয়ে রইলাম।কতক্ষণ এভাবে শুয়েছিলাম জানি না, তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাটা কাটল একজন লোকের গলার কর্কশ আওয়াজের চোটে। চোখ মেলে দেখলাম ময়লা কাপড় পড়া একটা লোক, গালভর্তি দাড়ি, পানখাওয়া দাঁত, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে- দেখলে গাড়িচালক গোছের মনে হয়। লোকটার মুখটা শুধু দেখা যাচ্ছে কিন্তু বাকি শরীরটা ময়লা কাপড়ে ঢাকা আর কাপড় থেকে বিচ্ছিরি একটা গন্ধ বেরুচ্ছে- কি জানি কতদিন ধরে স্নান করে নি আর কতদিন জামাকাপড় কাচে নি! আশ্চর্য, আমি তো এতক্ষণ ধরে এখানেই ছিলাম কিন্তু কোথাও কাউকে তো দেখতে পাইনি। তাহলে এই লোকটা কোথা থেকে এল? হতে পারে, আমার চোখ লেগে গিয়েছিল আর সেই সময় সে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল অথচ আমিই খেয়াল করিনি।সে একটু কর্কশ গলায় বলল- “বাবু, কোথায় যাবেন?”আমি- “জলপাইগুড়ি যাব কিন্তু তুমি কে? এখানে তো এতক্ষণ ছিলাম কাউকে তো দেখিনি!”লোকটা- “বাবু, আমার নাম সোমনাথ, এই এলাকায় গাড়ি চালাই। আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তো, তাই আমাকে দেখতে পান নি। আমি কিছুক্ষণ আগেই এখানে এসেছি।“আমি- “ও, তাই নাকি! আচ্ছা তুমি কি আমাকে জলপাইগুড়ি নিয়ে যেতে পারবে? যা ভাড়া লাগে নিয়ে নিও।“সোমনাথ- “হ্যাঁ বাবু, নিশ্চই যাব, আসুন আমার গাড়িতে।“মনে মনে চিন্তা করলাম কষ্ট করে স্টেশনে রাত কাটানো আর মশার কামড় খাওয়ার চেয়ে গন্তব্যে চলে যাওয়া ঢের ভাল। অন্ততঃ সেখানে গিয়ে একটু বিশ্রাম তো নিতে পারব আর মশার কামড়ও খেতে হবে না। ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে ব্যাগদুটো হাতে নিয়ে সোমনাথের সাথে ওর গাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। মনে মনে ভাবলাম যাক ভালোই হল। হাটতে হাটতে সোমনাথের গাড়ির সামনে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি আরও একজন লোক আগে থেকে সিটের উপর বসে আছে। লোকটার সমস্ত শরীর চাদর দিয়ে ঢাকা। চেহারাটা পর্যন্ত ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। আমি আর কোনও কথা না বলে লোকটার পাশে গিয়ে বসলাম।সোমনাথ এবার গাড়ি চালাতে শুরু করে। প্রায় ২৫ মিনিট চলার পরে আমরা পিচের রাস্তায় উঠলাম। সেই রাস্তার দুই পাশে ছিল বিস্তৃত ধানক্ষেত আর তাজা হিমেল হাওয়া। আমার মনে হচ্ছে এই জায়গাটার নাম বেলাকোবা। যত দূরে চোখ যায় শুধু হলুদ পাকা ধান আর চাঁদের রূপোলী আলোয় সুন্দর লাগছে ওগুলোকে দেখে। আহা কি মনোরম দৃশ্য! চোখ আর মন জুড়িয়ে যায়। কতকাল আসি নি এই দিকে।মাঝে মাঝে রাস্তার দু’পাশে কিছু গাছপালাও আর হাল্কা জঙ্গল দেখা যাচ্ছে, তার সাথে আসন্ন খরার মরসুমে চাষাবাদের জন্য একপাশে একটা বড় খাল খনন করা আছে। জঙ্গলটা যতদূর জানি টোপাগুড়ির জঙ্গল নামে পরিচিত। আকাশে হালকা চাঁদের আলোর পরেও চারপাশটা বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আশেপাশে কোনও জনবসতি নেই, তাই চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। মাঝেমাঝে জঙ্গল থেকে খেঁকশেয়াল আর নেকড়ের ডাক কানে ভেসে আসছে যা মনে এক অনাহূত আতঙ্কের জন্ম দিচ্ছে। কার্তিক মাসের শেষের দিক, তাই হালকা একটু শীতের আমেজ এসেছে। মাঝে মাঝে হিমেল হাওয়া শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। তাই ব্যাগ থেকে জ্যাকেট নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিলাম।একটু পরে সোমনাথ জিজ্ঞেস করল- “স্যার জলপাইগুড়িতে আপনার কোনও আত্মীয় থাকেন নাকি?”আমি- “হ্যাঁ, জলপাইগুড়িতে আমার মামার বাড়ি। কিছুদিন পরে আমার এক আত্মীয়ের বিয়ে, তাই ওখানে যাচ্ছি।“মাঝপথে আসার পরে সোমনাথ গাড়ি থামিয়ে বলল- “বাবু, আপনারা একটু বসেন, আমি একটু হাল্কা হয়ে আসি।“বুঝতে পারলাম সে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়েছে। সোমনাথ পিছনে গিয়ে রাস্তার থেকে নীচে নেমে যায়। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর আর তাকে দেখা যায় না।অনেকক্ষণ এভাবে বসে থেকে আমার হাত-পা-কোমরে ব্যথা হয়ে গেছে। তাই গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার মধ্যে চলাফেরা করতে লাগলাম।


প্রায় ৪৫ মিনিট হয়ে গেছে কিন্তু সোমনাথ এখনও ফিরছে না। আমি তখন তার নাম ধরে কয়েকবার ডাক দিলাম কিন্তু কোনও উত্তর পেলাম না। আমার মনে কেমন একটা উত্তেজনার চোরাস্রোত বইছে কিন্তু আমার পাশে বসা লোকটার কোনও সাড়া-শব্দ নেই- সে আগেও যেমন চুপচাপ ছিল, এখনও ঠিক সেরকমই চুপচাপ বসে আছে।সোমনাথ না আসাতে ব্যাগ থেকে টর্চলাইটটা নিয়ে আস্তে আস্তে আলপথ ধরে নীচের দিকে গেলাম কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না। আস্তে আস্তে আরও একটু সামনে এগিয়ে গেলাম। সেখানে একটা বড় খাল খনন করা। সেইখানটা লক্ষ্য করতেই আমার পুরো শরীরে আতঙ্কের চোরাস্ত্রোত বয়ে গেল। এক অনাহূত বিপদের আশঙ্কায় আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল আর গা গোলাতে লাগল- বলতে গেলে আমার শরীরটা কেমন জানি আনচান করতে লাগল।লক্ষ্য করলাম খালের জলের রঙ কেমন যেন লাল হয়ে আছে। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আমার মনে হল খালের পাশে যেন একটা লাশ পড়ে আছে- কাছে গিয়ে দেখি সোমনাথের লাশ।


কে যেন তাকে পৈশাচিক নৃশংসতায় হত্যা করে মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে দিয়েছে আর সেখান থেকে শোণিত প্রবাহ খালের জলে মিশে লাল হয়ে গেছে। আরও দেখলাম যে সোমনাথের শরীর থেকে হৃৎপিণ্ডটা কেউ প্রবল জিঘাংসায় ছিঁড়ে বার করে অন্য কোথাও ফেলে দিয়েছে। পুরো দৃশ্য়টা দেখে আমি আপাদমস্তক শিউরে উঠলাম- বুঝতে পারলাম যে এই কাজ কোনও সাধারণ মানুষের হতে পারে না, এই নৃশংস কাজ কোনও অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন পিশাচেরই কারণ আমি ছোটবেলায় গল্পের বইতে এরকম পিশাচের গল্প পড়েছিলাম যারা মানুষকে অবলীলায় নৃশংসভাবে হত্যা করত। আমি সামনের দিকে ঘুরতেই যাব, এমন সময় শুনতে পেলাম যে ধানক্ষেতের মাঝখান থেকে কিছু একটা শব্দ হচ্ছে। একসময় শব্দের তীব্রতা বাড়তে থাকে। বুঝতে পারলাম ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে ভয়ঙ্কর কিছু একটা এদিকে ধেয়ে আসছে। ভয়ে তখন পড়িমড়ি করে দৌড়ে গাড়ির সামনে চলে আসার চেষ্টা করলাম কিন্তু বিধি বাম! দৌড়বার চেষ্টা করতেই মনে হল কোনও এক অদৃশ্য হাত যেন আমার পা-দুটো কিছু দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। অনেক কষ্টের পর যাও বা সেই অদৃশ্য হাত ছাড়িয়ে পিচের রাস্তায় এসে উঠলাম, মনে হল কেউ যেন একবার আমার গলা টিপে ধরার চেষ্টা করছে আবার পরক্ষণেই মনে হল কেউ যেন আমাকে ঘাড় মটকানোর চেষ্টা করছে- আমাকে যেনতেন প্রকারে প্রাণে মারতে পারলেই তার শান্তি। অসীম সাহসে ভর করে আমি তার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করলাম।


স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে আমার বাঁচার আর কোনও পথ নেই- প্রাণপণে সেখান থেকে ছুট দিলাম। ছোটবার সময় শুনতে পেলাম পিছন থেকে কারও যেন পৈশাচিক অট্টহাসির আওয়াজ, যেন আমার এই অসহায় অবস্থা দেখে কারও খুব আনন্দ হচ্ছে কিন্তু পিছন ফিরে দেখলাম কেউ নেই। সেই আওয়াজের তীব্রতা এতটাই যে পুরো জায়গাটা কেঁপে উঠল। কিছুদূর এগোনোর পর দেখি একজন লোক রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে কিন্তু তার অবয়বটা রক্ত-মাংসের বদলে ধূমায়মান কোনও জিনিস দিয়ে তৈরী আর সেই অবয়ব থেকে একটা নীল আলো বের হচ্ছে। আমি কিছু বলতে যাব, দেখি সেই অবয়বটা মন্ত্রবলে কোথাও গায়েব হয়ে গেল। এসবই যে পিশাচের মারণ খেলা, তা বুঝতে আর বাকি থাকল না। রাতের বিভীষিকা কি জিনিস, সেটা এবার পুরোপুরি টের পেলাম। এও বুঝতে পারলাম কেন সেই স্টেশন মাস্টার আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন রাতের বিভীষিকার ব্যাপারে। এখন মনে হচ্ছে সেই স্টেশন মাস্টারের কথা শুনলেই ভাল হত, শুধু শুধু এতরাতে এরকম বিপদে পড়তে হত না। নিজের ওপরেই রাগ হতে লাগল আর নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বোধ মনে হতে লাগল।যাই হোক, সেই বিভীষিকা কাটিয়ে কোনওমতে গাড়ির সামনে এসে দেখি চাদর গায়ে দেওয়া সেই লোকটা নেই- যেন কোথাও ভোজবাজির মতন উবে গিয়েছে। আমি চারপাশ ভাল করে দেখলাম কিন্তু কোথাও তার দেখা পেলাম না। হঠাৎ দেখলাম দূর থেকে কতকগুলো কুকুর ঘেউঘেউ শব্দ করতে করতে এদিকে ছুটে আসছে।


ওদের দেখে আমি দ্রুত গাড়ির ওপর উঠে বসলাম। ওরা গাড়ির সামনে এসে এমন করুণ সুরে ডাকতে শুরু করল, যেন মনে হল কোনও আগাম বিপদের পূর্বাভাস দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ওরা কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে। তাই সামনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এমন সময় দেখলাম সামনের দিকে আলের নীচ থেকে কেউ একজন রাস্তার ওপরে উঠেছে। হাতে থাকা টর্চলাইটটা সে দিকে ধরলাম- দেখি রাস্তার উপর এক মাঝবয়সী মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।মানুষটার মুখে আর পোষাকে তাজা রক্তের দাগ লেগে, যেন কাউকে এইমাত্র খুন করে এসেছে। চোখদুটো যেন ভাটার মতন জ্বলছে আর একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার বুঝতে পারলাম যে বিপদ একদম শিয়রে। কে জানে এই লোকটাই হয়ত সোমনাথকে খুন করে মাথা কেটে লাশটা খালের জলে ফেলে দিয়েছে। লোকটাকে দেখেই কুকুরগুলো ভয়ে সামনের দিকে দৌড় দিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি তখন কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এদিকে এই ভয়ানক দৃশ্য দেখে আমার হৃদস্পন্দন খুব বেড়ে গেছে। শেষে মামার বাড়ীতে ঘুরতে এসে আচ্ছা পিশাচের পাল্লায় পড়া গেল তো!চিন্তা করলাম ভাগ্যে যা থাকে থাকুক, ভগবানের নাম নিয়ে ব্যাগটা নিয়ে সামনের দিকে প্রাণপণ দৌড়ব কারণ এই ব্যাগটাতেই আছে মামীর জন্য এক বিশেষভাবে গড়া সোনার গয়না। তাই ব্যাগটা হাতে নিয়ে দিলাম এক দৌড়। কিছুদূর আসার পরে দেখলাম সামনে দিয়ে একজন লোক হেঁটে যাচ্ছে- দ্রুত পায়ে তার কাছে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি গাড়ির সেই চাদর গায়ে দেওয়া লোকটা। তাকে দেখে মনে এবার কিছুটা সাহস পেলাম। লোকটাকে বললাম- “দাদা, আপনি তো সেখান থেকে চলে এলেন আর ওদিকে কে বা কারা যেন সোমনাথকে নৃশংসভাবে খুন করে লাশটাকে খালের জলে ফেলে দিয়েছে। উফফ! সে কি নারকীয় দৃশ্য, আপনি দেখলে শিউরে উঠতেন!“লোকটা গম্ভীর গলায় উত্তর দিল- “তাই নাকি! বলেন কি?” এই প্রথম আমি লোকটার গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম কিন্তু আওয়াজটা আমার কাছে অতি পরিচিত মনে হচ্ছে।


মনের মাঝে কেমন একটা খটকা লাগল। তাই লোকটাকে বললাম- “দাদা, আপনি চাদর দিয়ে এভাবে মুখ ঢেকে রেখেছেন কেন? আপনার চেহারা তো একদম দেখাই যাচ্ছে না।“আমার কথা শেষ হওয়ার পরে লোকটা এক ভয়ঙ্কর হাসি হেসে বলল- “দেখবেন আমার চেহারা? এই দেখুন তাহলে।“ এই বলে তার মুখ থেকে চাদর সরালো। তার চেহারাটা দেখে আমার পিলে চমকে গেল। আমার সেখানেই মূর্চ্ছা যাওয়ার অবস্থা হতে লাগল।এটা কিভাবে সম্ভব! একটু আগেই যে সোমনাথের মুন্ডকাটা আর হৃদপিণ্ড বার করা লাশ দেখেছিলাম, সেই সোমনাথ তার এক হাতে কাটা মুন্ডটা ধরে আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আর সেই দুটো জায়গা থেকে অঝোর ধারায় রক্ত পড়ছে। সোমনাথ তখন আর কোনও মানুষ নয়, সাক্ষাত এক নরপিশাচ যার সামনে পড়া মানেই মৃত্যু অবধারিত- তার চোখে এক আদিম হিংস্রতা আর শরীরে এক বন্য নিষ্ঠুরতা। আমার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে যাচ্ছিল, মুখ থেকে আর কোনও কথা বের হচ্ছিল না, সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটছিল যে আমার সমস্ত বুদ্ধি পুরোপুরি লোপ পেয়ে গিয়েছিল। শেষে কিনা বেড়াতে এসে মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হবে। সাক্ষাত মৃত্যুকে সামনে দেখে আমি গোঙাতে গোঙাতে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। তারপর আমার সাথে আর কি ঘটেছিল, কিছু মনে নেই।জ্ঞান ফিরে আসার পরে দেখি দিনের আলো পুরোপুরি উঠে গিয়েছে আর আমি মামাবাড়ির বিছানায় শায়িত অবস্থায় আছি। মামাবাড়ির সবাই আমার চারপাশে বসে আছে আর একজন আমার মাথায় জল ঢালছে।মামা- “তোর কপাল ভাল যে তুই সেই পিশাচের হাত থেকে বরাতজোরে রক্ষা পেয়েছিস। তোকে রাস্তায় অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকেরা পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে তোকে সেখান থেকে উদ্ধার করে তোর মোবাইল সার্চ করে আমাদের নম্বরে ফোন করে। আমরা সেখান থেকে তোকে এখানে তুলে নিয়ে আসি। ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ যে তোর কিচ্ছু হয় নি, না হলে আজ পর্যন্ত সেখান থেকে কেউ বেঁচে ফিরতে পারে নি। তোর কিছু হলে আমি যে দিদিকে মুখ দেখাতে পারতাম না। আচ্ছা, আমাকে একটা ফোন তো করতে পারতিস, তাহলে আমরা গাড়ি নিয়ে চলে আসতাম তোকে নিতে।“মোবাইলে চার্জ না থাকার কথাটা এড়িয়ে গিয়ে আমি মামাকে রাতের ঘটনাটা পুরোপুরি খুলে বলার পর জানতে পারি, কাল রাতে আমার সঙ্গে যা কিছু হয়েছে, সেটা আসলে এক পিশাচের মারণ খেলা। কয়েক বছর আগে এক রাতে সোমনাথ পাকড়াশী নামের এক ড্রাইভার রাতের কয়েকজন যাত্রী নিয়ে স্টেশন থেকে জলপাইগুড়িতে যাচ্ছিল। ঠিক ৪৫ মিনিট যাওয়ার পরে সেই জায়গাতেই গাড়ি থামিয়ে ও হাল্কা হওয়ার জন্য নীচে নেমে ধানক্ষেতের দিকে যায় কিন্তু তারপর আর ফিরে আসেনি। পরদিন সকালে ধানক্ষেতের খালের জলে তার মুন্ডকাটা রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার হয়। তার মৃত্যুর পর সেই গাড়ির যাত্রীদেরও আর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। স্থানীয় থানার পুলিশ এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্ত শুরু করেছিল ঠিকই কিন্তু কোনও সমাধান সূত্র খুঁজে না পাওয়াতে কেস ফাইলটা বন্ধ করে দেয়। সোমনাথকে কে বা কারা নৃশংসভাবে খুন করে সেখানে ফেলে দিয়েছিল, সে ব্যাপারে পুলিশ তখনও অন্ধকারে ছিল মানে পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও খুনীদের ধরতে পারে নি। সেই থেকে সোমনাথ ড্রাইভারের গাড়িটা ষ্টেশনের গোডাউনেই রাখা ছিল। যেহেতু তার তিনকূলে কেউ ছিল না, সেহেতু কেউই তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেনি। যার ফলস্বরূপ সে আজও পিশাচরূপে রাতের যাত্রীদের সামনে সেই ভয়ংকর রাতের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। অনেকেই তার এই মারণ খেলার শিকার হয়ে নিজের প্রাণ ত্যাগ করেছে কিন্তু তোর ভাগ্য খুবই ভাল যে সেই পিশাচ তোকে মারবার চেষ্টা করলেও কোনও এক অজানা কারণে তার সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তার মানে এই নয় যে সে আবার সেই চেষ্টা করবে না। সে উপযুক্ত সময়ের সন্ধানে আছে। হতভাগ্য সোমনাথের অতৃপ্ত আত্মা আজও মুক্তির খোঁজে সেখানে ঘুরে বেড়ায়।ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে কয়েকটা দিন ছুটি কাটাবার পর আমি আবার কলকাতায় ফিরে যাই। এই ঘটনার পর বেশ কয়েক মাস কেটে গেলেও আজও যখন সেই ভয়ানক রাতের কথা মনে পড়ে, তখন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সত্যি তো, এই দুনিয়ায় এমন অনেক ঋণাত্মক শক্তি আছে যাদের কথা আমরা শুনতে পাই ঠিকই কিন্তু আমাদের বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক মন সেসব মানতে চায় না বা বিশ্বাস করতে চায় না। যখন কোনও বিপদে পড়ি, ঠিক তখন থেকে এদের ওপর আমাদের বিশ্বাস জন্মায়। এই ঘটনার কয়েক মাস পরে মামার কাছে শুনেছিলাম যে সোমনাথের অতৃপ্ত আত্মা এখনও নাকি সেখানে ঘুরে বেড়ায় মুক্তিলাভের আশায়- কবে আর কিভাবে তার মুক্তি সম্ভব, সেটা একমাত্র ভগবানই জানেন।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror