Mitali Chakraborty

Drama Tragedy

3  

Mitali Chakraborty

Drama Tragedy

রাক্ষস গণ:-

রাক্ষস গণ:-

5 mins
703



ধনাঢ্য, অভিজাত, সুউচ্চ মুখোপাধ্যায় বংশের দুই নাতবউকে সুনীপাদেবী নিজেই পছন্দ করে এনেছিলেন মুখার্জী ভিলাতে। এই সংসারের সর্বময় কর্ত্রী সুনীপাদেবীই। ওনার মতামতকে অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস কেউই দেখায় না মুখোপাধ্যায় পরিবারে। ওনার ছেলে-বৌমা এবং নাতি-নাতবৌরাও খুব মান্যগন্য করে সুনীপাদেবীকে। ওনার বলা সকল কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গোটা পরিবার। এহেন পরিবারে গোল বাঁধলো তখন, যখন সুনীপাদেবীর কনিষ্ঠ নাতি শ্রীমান শঙ্খ জেদ ধরে বসলো সে তার মেডিকেল কলেজের এম.ডি পাঠরতা সহপাঠী তথা প্রেমিকা রক্তিমা মৈত্রকে নিজের ধর্মপত্নী করতে ইচ্ছুক। শঙ্খ সব সময়ই পরিবারের সকলের ভালোবাসা আর মনোযোগ একটু বেশিই পেত বয়সে ছোট বলে। কিন্তু ভালোবাসা পেতে পেতে সে যে এমন একটা দাবি করে বসবে সেটা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি। সুনীপাদেবী প্রথম প্রথম একটু নিমরাজি ছিলেন বটে কিন্তু শঙ্খ অবশেষে রাজি করিয়ে নিয়েছে তার আদরের ঠাকুমা সহ পরিবারের সবাইকে। এক ছুটির দিন দেখে রক্তিমা তথা তার বাবা মা উভয়ের সঙ্গেই আলাপ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন সুনীপাদেবী। সেই মতোই স্থির করা হয় যে আগামী রবিবারে মৈত্র পরিবারকে আমন্ত্রণ জানানো হবে মুখার্জী ভিলাতে আসার জন্য।


********************


মুখার্জীদের বড় আলিশান ড্রয়িংরুমে বসে আছে মৈত্র পরিবার। শঙ্খও ওখানে উপস্থিত আছে বাকিদের সঙ্গে। দুই পরিবারের সকলের মধ্যে চলছে কিছু সৌজন্যতা মূলক কথাবার্তা আর চায়ের কাপের টুং টাং শব্দ আর দুই এক টুকরো হাসির আওয়াজ। ড্রয়িংরুমের পরিবেশটা একটু ভাব গম্ভীর। রক্তিমার সঙ্গে বার দুয়েক চোখাচোখিও হয়েছে শঙ্খের। রক্তিমা একটু আড়ষ্ট। একবাড়ি লোকের সামনে বসে আছে সে। শঙ্খের চোখে মুখে দুষ্টু মিষ্টি লাজুক হাসি কিন্তু রক্তিমা খুব শান্ত। তার টুকটুকে গাল দুটোয় লজ্জার রাঙা আবিরের ছাপ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কেমন যেনো একটা জড়তা রক্তিমার মধ্যে।

বেশ কিছুটা সময় অতিক্রান্ত। সুনীপাদেবী নিজের অভিজ্ঞতার চক্ষু দিয়ে বার কয়েক খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছেন রক্তিমাকে।

মনে মনে শঙ্খের পছন্দ করা রক্তিমাকে প্রশংসা না করে থাকতে পারলেন না। অত্যন্ত শান্ত, নম্র, মৃদুভাষী, সু-মুখশ্রীর অধিকারী রক্তিমাকে বেশ পছন্দ হয় সুনীপাদেবীর। শঙ্খের বাবা মায়েরও বেশ ভালো লাগে শান্ত-সৌম্য রক্তিমাকে। এখন শুধু সুনীপাদেবীর মুখ ফুটে হ্যাঁ বলার অপেক্ষা। কিন্তু শঙ্খ আর রক্তিমার বিয়ের কথা অগ্রসর করার আগেই সুনীপাদেবী সকলের সামনেই রক্তিমার মাকে জিজ্ঞেস করলেন কুষ্ঠী অনুসারে রক্তিমার "গণ" কি? রক্তিমার মা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, মুহূর্তে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে খুব শান্ত ভাবে বলেন যে রক্তিমার রাক্ষসগণ।

মৈত্র গিন্নির উত্তর শুনে মুখের চোয়াল শক্ত করে সুনীপাদেবীর উত্তর "কিন্তু আমাদের শঙ্খ তো নর গণ।"


সুনীপাদেবীর উক্তি শুনে ঘরের সবাই চুপ। নীরবতা ভাঙলেন তিনিই। রক্তিমার বাবা-মায়ের দিকে চেয়ে বললেন,

"রক্তিমাকে দেখেই আমার মনে ধরেছিল কিন্তু...কিন্তু নরগণ ছেলের সঙ্গে রাক্ষসগণ মেয়ের বিবাহ যে অশুভ সেটা বোধ করি আপনারা জানেন। আমার নাতির প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা থাকবে এমন মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে। আমি জেনে বুঝে আমার নাতির বিয়ে রক্তিমার সঙ্গে দিতে পারি না। আমি পুরনো দিনের মানুষ, নাতি যতোই ডাক্তার মোক্তার হয়ে যাক না কেনো আমি আমার নিজের আচার সংস্কার ছাড়তে পারব না।

শঙ্খ যদি দেব গণ হতো তাহলে আপত্তি ছিল না....কিন্তু!"

এই বলে সুনীপাদেবী একটু থামলেন। কয়েক সেকেন্ড পর আবার বলতে শুরু করলেন,

"ক্ষমা করবেন আপনারা আমি এই বিয়েতে মত দিতে পারলাম না।" ড্রইংরুমে তখন স্তব্ধতা। কোন আওয়াজ নেই। শঙ্খের মুখ দেখে মনে হচ্ছে রক্তবিন্দু আর অবশিষ্ট নেই। এই সামান্য একটি কারণে বিয়ে বাতিল করার মতন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে সে ভাবে নি। রক্তিমার মনের অবস্থা আরো সঙ্গীন। একবার বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই টের পায় সুনীপাদেবীর কথায় কেমন গুরুতর আঘাত পেয়েছেন তার বাবা মা। মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে রক্তিমার। এইভাবে অপমানিত হতে হলো আজ তাদের। শঙ্খ বিহ্বলের মত নিজের বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বাবা মায়ের মুখ নির্বিকার। রক্তিমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মুখ নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে শঙ্খ। রক্তিমার মনে তখন প্রশ্ন "এইটাই বুঝি ভালোবাসার পরিণতি!" না আর দেরী করে না সে। আলতো ভাবে মায়ের হতে চাপ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। করজোড়ে নমস্কারটুকু সেরে ধীর পায়ে বাবা মাকে সঙ্গে নিয়ে অভিজাত মুখার্জী ভিলা থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয় রক্তিমা। শঙ্খ পেছন পেছন আসছিল যদিও কিন্তু রক্তিমার ব্যাথাতুর দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আর কিছুই বলতে পারলো না।


*****************

সময় পেরিয়ে যায় নিজ নিয়মে।

রক্তিমা তখন নিজের চেম্বারে। নার্স এসে খবর দেয় যে ইমারজেন্সিতে একটা অক্সিডেন্ট কেস এসেছে এইমাত্র। ক্রিটিক্যাল কেস। অপারেশন করতে হবে হয়ত। পেশেন্টের নাম ডাক্তার শঙ্খ মুখার্জী। নার্সের মুখে নামটা শুনে একটু চমকে ওঠে রক্তিমা। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে যায় ক্যাজুয়াল্টি ওয়ার্ডের দিকে। রক্তাক্ত অবস্থা শঙ্খের। হাইওয়েতে বাইকে সাওয়ার শঙ্খ, বেসামাল হয়ে এক লরির ধাক্কায় ছিটকে পড়ে গিয়ে গুরুতর জখমী হয়। তাকে ঘিরে কান্নাকাটি করছেন তার মা জ্যাঠিমারা। ছেলে বৌমাদের সঙ্গে বয়স্কা সুনীপাদেবীও সেখানে উপস্থিত। পুরনো মানসিক কষ্ট গুলো মনের মধ্যে উঁকি দিলেও এক নিমিষে সেগুলো ঝেড়ে ফেলে শঙ্খ কে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রক্তিমা। শঙ্খের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে দেখে আর দেরি করে না। তরিঘড়ি নার্স আর ওয়ার্ড বয়কে বলে ও.টি রেডি করতে। খবর দেওয়া হয় সার্জনকে।

বেশ কয়েক ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ও.টি থেকে বের হয় রক্তিমা। মুখার্জী পরিবারের সকলের দিকে এগিয়ে যেতেযেতে মনে পড়ে পুরনো কথা গুলো। সেদিন ঐভাবে চলে আসার পর আর তেমন বিশেষ কথা হতো না রক্তিমা আর শঙ্খের। শঙ্খ যোগাযোগ রাখতে চাইলেও রক্তিমার ইচ্ছে হয়নি সম্পর্কটিতে জড়িয়ে থাকতে। মেডিকেল কলেজ থেকে এম.ডি পড়া শেষ হতেই রক্তিমা ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেকে নিয়ে। তারপর আর শঙ্খের সঙ্গে কথা হয়নি। বন্ধুদের মারফত টুকরো টাকরা খবর পেয়েছিল শঙ্খের যে সে নাকি ভিনরাজ্যের কোন হাসপাতালে চাকরি নিয়ে চলে গেছে। ভাবতে ভাবতে সে পৌঁছে গেছে সেখানে, যেখানে সুনীপাদেবী সহ সকলে বসে আছেন। সবাইকে আশ্বস্ত করে রক্তিমা বললো যে শঙ্খ জীবন যুদ্ধে জয়ী। এখনও তার জ্ঞান ফেরেনি কিন্তু বিপদের আশংকা আর নেই। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সকলে। মুখার্জী পরিবারের কর্ত্রী ধীর পায়ে রক্তিমার কাছে এসে বলেন "আমাদের বংশের প্রাণ ফিরিয়ে দিলে তুমি মা, সবে মাত্র পাঁচদিন হল ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিল শঙ্খ। আর আসতে না আসতেই আজ এই বিপত্তি..."

কথা কটি বলে আঁচলে চোখ মুছলেন তিনি। একটু পরে আবার বলতে শুরু করলেন, "আমি নির্বোধ... সেবার তোমাদের অপমান করেছিলাম। আমি খুব বড় ভুল করেছি। ভুলেই গেছি গণ দিয়ে নয়, মানুষের পরিচয় মানবিকতা দিয়ে। তোমার প্রচেষ্টায় আমার নাতিটা আবার প্রাণ ফিরে পেলো আর আমি তোমাকেই না কতো কটু কথা বলেছিলাম সেবার।

কুসংস্কারের কালো পর্দা এঁটে রয়েছিল আমার চোখে। আজ সেই পর্দা উঠে গেছে। বুঝতে পারছি আমি নিজের ভুল....তুমি কি এই বুড়িটিকে ক্ষমা করবে না মা?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama