পুতুল
পুতুল
এই কিছু দিন আগে যে বিশালাকার ঝড় হয়ে গেল সেই ঝড়ের প্রভাব কিছুটা কালীনগর এর উপর গিয়ে পড়ে। ঝড়ে সব কিছু প্রায় তছনছ হয়ে যায়, বাড়ি ঘর দোকান পাঠ, গাছ পালা সবই প্রায় উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। সেই গ্ৰামে এমনই একটা পরিবার ছিল রমেশ বাবুর। রমেশ বাবু তার পরিবার নিয়ে থাকত, রমেশ বাবুর পরিবারে সে নিজে তার বৌ ছেলে মেয়ে এবং তার ভাই এর পরিবার ছিল তারা সবাই এক সাথে থাকত। একে এই ভীষণ ঝড় তার মধ্যে নদীর বাঁধ ভেঙে গিয়ে নদীর জল গ্ৰামে ঢুকে পড়ে। রমেশ যতক্ষণে তার পরিবার নিয়ে বেরোয়, ততক্ষণে তারা তাদের বাড়ি সমেত ভেসে যায়।
সকালে যখন সে চোখ মেলে তখন সে দেখল চার দিকে কোনো কিছু ঠিক নেই, সে পাশে তাকিয়ে দেখে তার ভাই এর ছেলে সৌম্য অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে, রমেশ তার পরিবারের আর কাউকে খুজে পেল না। সে মনের দুঃখে সেখানে বসে হাউ হাউ করে কাদতে থাকল তার পরিবারের জন্য। সে তার ভাইপো সৌম্যর হাত ধরে সেই দিন তারা সেখান থেকে চলে আসে এবং তারা পাশের গ্রামে এক পোরো বাড়িতে চলে আসে। কোনো এক সময় এই বাড়িতে লোকের বসবাস ছিল। আগে যারা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে তারা সেই বাড়িতে অনেক জিনিস রেখে গেছে। যেমন খাট, আলমারি আরও অনেক কিছু। কিন্তু অনেক জিনিস তাদের কাজে লাগত না। সেই সব গোছাতে তার অনেকটা সময় লাগে। এদিকে সৌম্য তার পরিবার হারানোর ফলে কেমন যেন একটা কষ্টের মধ্যে থাকত। রমেশ একটু অন্য ধরনের সে সব সময় চাইত স্বাধীন ভাবে বাঁচতে ।কিন্তু তার কিছু করার ছিল না কারণ সে ওই বাচ্চা টিকে একা ছাড়তে পারত না। তারপর তাদের যে পারিবারিক ব্যাবসা বানিজ্য ছিল সে সবই ঝড়ের ফলে নষ্ট হয়ে যায়। সেই জন্য সেও একটু মানসিক অবসাদ এর মধ্যে থাকত।
সৌম্য যখন তার ঘর পরিস্কার করছিল তখন সে তার খাটের তলায় একটি পুতুল খুজে পায়। সে পুতুলটার ধুলো পরিষ্কার করে নেয়। পুতুলটা প্রায় নতুন এর মতো মনে হচ্ছিল। সে পুতুলটা পেয়ে খুব খুশি হয় এবং সে ওই পুতুলটার নাম দেয় সোনু সে পুতুলটা নিয়ে আনন্দ করতে থাকে। সে পুতুল পাওয়ার পর তার পরিবার হারানোর কষ্টটা অনেকটা কমে যায় আর সে আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এর ফলে রমেশ এর অনেকটাই সুবিধা হয়। কারণ তাকে সৌম্য এর প্রতি নজর রাখতে হত না। সৌম্য সারাদিন পুতুল নিয়ে খেলা করে, আর তার কাকুকে বলে কাকু কাকু দেখো সোনু খাবার নষ্ট করেছে, কাকু দেখো সোনু পড়ে গেছে সে সব সময় এই সব করতে থাকত। তাদের এভাবে দিন কাটতে থাকে।তারপর থেকে রমেশ প্রায় সময়ই রাত করে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে, তারপর সে তার ঘরে শুতে চলে যায়,
যার জন্য সৌম্যকে না খেয়ে থাকতে হত। এমনই একদিন রমেশ বেশ রাত করে বাড়ি ফেরে, আর প্রতিদিন এর মতো রমেশ সেদিনও মদ খেয়ে নিজের ঘরে শুতে চলে যায়। তারপর হঠাৎ রমেশ কিছু কথার আওয়াজ শুনতে পায়। রমেশ উঠে দেখে সৌম্য এর ঘর থেকে আওয়াজ আসছে। সে তাকে এক ধমক দিয়ে বলে, কী করছো তুমি? চুপ করো আর ঘুমাতে দাও আমায়। সৌম্য বলে কাকু আমার খুব খিদে পেয়েছে। রমেশ ঘুমে ঢলে পড়া চোখ মুছতে মুছতে বলল ও হ্যা আচ্ছা ঠিকাছে তোমায় কাল খেতে দেব আমি। এই কথা বলে রমেশ নিজের ঘরে শুতে চলে গেল। তারপরও সৌম্য এর ঘর থেকে ফিস ফিস করে কথার আওয়াজ আসছিল কিন্তু সেই কথা গুলি রমেশ এর কান পর্যন্ত পৌছায় না।
পরদিন সকালে যখন রমেশ ঘুম থেকে ওঠে তখন সে দেওয়ালে দেখে বড়ো বড়ো করে লেখা, আমার খিদে পেয়েছে, আমায় খেতে দাও। রমেশ এই সব কান্ড দেখে খুব রেগে গেল। সে সৌম্য সৌম্য বলে ডাকতে থাকে। রমেশ নীচে পা ফেলতেই একটা ব্যাথা অনুভব করে । রমেশ তার পায়ের দিকে তাকাতেই চিৎকার করে উঠল। সে দেখল তার পায়ের দুটি আঙুল কে ছিড়ে নিয়েছে। রমেশ যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে ডাইনিং এ এসে দাঁড়ায় আর সৌম্য কে ডাকে, সৌম্য ঘর থেকে তার পুতুল হাতে করে নিয়ে বেড়িয়ে এল। তার মুখের চারপাশ রক্তে ভর্তি রমেশ দেখে আৎকে উঠে পিছনে সরে এল। সেই পুতুল টার সারা গায়ে রক্তের দাগ। রমেশ ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলো, এগুলো কী? কী হচ্ছে এসব? তো... তোমার মুখে রক্তের দাগ কেন? কী হয়েছে তোমার? সৌম্যর চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে, আর সে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত ভাবে হাসছে, আমি কি করব কাকু আমার খিদে পেয়েছিল। এই কথা শুনে রমেশ মেঝেতে পড়ে গেল আর সে লক্ষ্য করলো সৌম্য এর পাশে তার পুতুলটা দাঁড়িয়ে আছে এবং পুতুলটা তার দিকে এগিয়ে আসছে ও তার চোখ দুটো জলজল করছে। সেই পুতুলটা এসে তার বুকের উপর উঠে দাঁড়িয়ে পরল তখন রমেশ অনুভব করল যে তার বুকের উপর একটা গোটা পাহাড় রয়েছে। আর চার দিক থেকে একটাই আওয়াজ আসছে আমার খিদে পেয়েছে আমায় খেতে দাও। রমেশের চারদিক থেকে অসংখ্য হাত উঠে এল, আর সেই হাত গুলো ভিজে আর কংকাল সার। রমেশ কে সেই হাত গুলো যখন চেপে মারছিল তখন সৌম্য হাত তালি দিচ্ছিল আর আনন্দে হাসছিল। তারপর কিছুক্ষণ পর রমেশকে মেরে ফেলে ও তাকে মেঝের মধ্যে টেনে নেয়। সৌম্য তখন তার পুতুল সোনুকে বলল আমার আর কেউ নেই সোনু তুই আমায় নিয়ে চল।
প্রায় তিন চার মাস পর ওই বাড়িতে অন্য আর একটা পরিবার থাকতে আসে। তারা তাদের জিনিস পত্র গোছানোর সময় খাটের তলায় দুটি পুতুল খুঁজে পায়।