পুনর্ভবা পর্ব :-৩
পুনর্ভবা পর্ব :-৩
তুলসি তলায় প্রদীপ জ্বালানোর সাথে সাথেই বাড়ি ফেরে ওরা। ঠিক যেন লক্ষ্মী এলো ঘরে। এই কথাটাই মনে হয় নিখিলেশ বাবুর। এগিয়ে খুকুকে আগে নামান কোলে করে। তারপর মায়ের হাত ধরে সাহায্য করেন নামতে। লালমোহনকে বলেন, __________নে আজ আর বেশি রাত জাগিসনা। ওই অবলা প্রানী দুটোকে সামলেই তোর খাবার খেয়ে শুয়ে পড়িস। তোর বৌঠান রান্না সেরে রেখেছে। সকালেই তো আবার ফিরতে হবে। তবে এবার তোদের সাথে আমিও যাচ্ছি।
কথাটা শুনে লালমোহনের মুখখানা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নীরবে হাসতে হাসতে ও গরুদুটোর গলায় হাত বুলোতে লাগলো।
খুকু একাই বকবক করছিলো ওর দিদিয়ার সাথে। হঠাৎ করে বলে ওঠে " ও বাবা! আমিও যাবো তোমার সাথে।
____আচ্ছা বেশ। কি রে সোনা? তুই যাবি গ্রামের বাড়িতে?
সোনা দুদিকে মাথা নাড়ায়। ডাগর দু চোখে ওর নীরব চাহনি।
আসলে লোকের কৌতুহল আর সমবেদনা অথবা ব্যঙ্গ কোনোটাই সোনার ভালো লাগে না। তাই মায়ের সাথে ছাড়া কোথাও যেতে চায় না মেয়েটা। মায়ের শাড়ির আঁচলটাই ওর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্হান।
রাতের খাওয়া সেরে দুই বোন ঘুমাতে গেছে। মা বললেন, "নিখিল, সুলতা তোমাদেরকে আজ কিছু কথা বলতে চাই" । দুজনেই অবাক চোখে তাকায়, তারপর নিখিলেশ বাবু মায়ের পাশে এসে হাতটা ধরে বলেন,
___ এমন কি কথা মা? যে তুমি বলতে দ্বিধা করছো! তোমার যা বলার মন খুলে বলোতো!
_____সুলতা মা, এখানে বসো।
ধীরে ধীরে সুলতা এসে ওনার বাঁ পাশে বসে পড়ে।
_____আমি জানি মা, আমার ওপর তোমার অনেক অভিমান। তোমার বলা বাঙাল ভাষা আমি পছন্দ করিনা বটে, তাই বলে ভেবোনা যে তোমাকে ভালো বাসি না। আমি মনেপ্রাণে শঙ্করী আর তোমাকে মেয়ে বলেই ভাবি। আমার তো নিজের মেয়ে নেই। কিন্তু জানো খুব শখ ছিল মেয়ে মানুষ করবার। কি আর করা যাবে, মানুষের সব সাধ তো আর পূর্ণ হয়না! তোমরাই আমার মেয়ে, তোমরাই আমার ঘরের লক্ষ্মী।
_______ তুমি কি জানো আমি কেন মাজারে পীরবাবার কাছে গেছিলাম?
দুদিকে মাথা নাড়ায় সুলতা।
______ যেন এবার তোমার কোলে ছেলে আসে।
_____কিন্তু মা, সোনা'র লাইগ্যা তো আমিও গেছিলাম কইতে। মাইয়াডার মুহে রাও তো ফুডেনা।
চোখের জল কাপড়ের আঁচলে মোছে সুলতা।
_____জানিনা মা, ভগবানের কি মর্জি! দেখা যাক।
কিন্তু যদি ভগবান এবারেও মুখ তুলে না চান তাহলে তোমার কাছে আমার একটা আর্জি আছে। ছেলে হলে তো তোমার কাছেই থাকবে। কিন্তু মেয়ে হলে, কানা, খোঁড়া যেমন ই হোক তুমি তাকে শংকরীকে দিও। ছোটোবৌমার মুখের দিকে তাকালে আমার বুকটা টনটন করে ওঠে। সারাদিন রাত মানুষটা প্রাণপাত পরিশ্রম করে চলেছে। ব্যবহারে কোনও খুঁত নেই। কিন্তু আমি তো জানি কত কান্না ও লুকিয়ে রেখেছে বুকের ভেতর। আর অখিলটাও তো মাটির মানুষ। ওদের কোনো অশান্তি ও করতে দেখিনা কাউকে।
তবে তোমাদের ওপর কোনো জোর নেই আমার ।
একটু চুপ করে থেকে সুলতা ঘাড় কাত করে বলে ওঠে
_____আইচ্ছা।
নিখিলেশবাবু যেন এতক্ষণ দম আটকে বসে ছিলেন।
প্রশান্তিতে মনটা ভরে ওঠে ওনার।
অনুপমা দেবী ওদের দুজনকে দু হাতে জড়িয়ে রাখেন। তাঁর দু চোখে নামে জলের ধারা।