পুনর্বাসনকেন্দ্র
পুনর্বাসনকেন্দ্র
নকুল একজন বেকার যুবক। দু'বছর আগে সে একটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছে। এখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ। এখনো পর্যন্ত সে চাকরির জন্য অনেক জায়গায় আবেদন করেছে। কিন্তু সে কিছুতেই একটা শালীন চাকরি জোটাতে পারেনি। তাই এবার সে ডোমের পদের জন্য আবেদন করেছে কলকাতার একটা নামী মেডিকেল কলেজে। এই পদের জন্য অন্তত আট হাজার শিক্ষিত যুবক-যুবতী আবেদন করেছে। এদের মধ্যে সাতশ চুরাশি জন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। নকুল তাদের মধ্যে একজন। এই পদে আবেদন করবার যোগ্যতা ছিল মাধ্যমিকেরও নিচে। এই পদের জন্য মাইনে দেওয়া হবে পনেরো হাজার টাকা। ‘খারাপ নয়!’ - নকুল ভাবল কারণ এর আগে সে কয়েক মাসের জন্য একটি স্টার্ট-আপ কোম্পানিতে আট হাজার টাকার মাসিক বেতনে চাকরি করেছিল। তাই সে এবারে এই পরীক্ষাতে বসেছিল। তবে সে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। পরে সে খবরের কাগজে পড়েছিল যে খানদানি ডোমেদের পরিবার থেকেই এই পদে লোকেদের নিযুক্ত করা হয়েছে। যাই হোক একবুক হতাশা নিয়ে সে কলকাতা শহরে দিন কাটাচ্ছে। কখনও সে ভাবতো যে লোন নিয়ে ব্যবসা করবে। পরক্ষনেই তার মনে হতো কিভাবে সেই স্টার্টআপ, যেখানে সে কাজ করতো, উঠে গিয়েছিল। একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে সে পরিষ্কার দেখতে পারত সেই ভয়ঙ্কর বৃত্তটাকে যার শুরু মানুষের নিম্ন ক্রয়ক্ষমতা থেকে এবং শেষ নিম্ন আয় বা ক্ষতি যা ক্রমাগত স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী। তার মা একজন গৃহকর্ত্রী। সে ভেবেছিল যে আরও এক বছর সে চাকরির জন্য আবেদন করবে। তারপর সে নিজের উদ্যোগ শুরু করবে যখন বাজারে স্থিতাবস্থা ফিরে আসবে। এর মধ্যেই তার এক বন্ধু উপদেশ দিল শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার জন্য। এখনো পর্যন্ত সে শেয়ার ট্রেডিং শুরু করেনি। তবে সে ভেবে রেখেছে যে পরের বছর থেকে সেটা শুরু করবে যদি সে কোন চাকরি জোটাতে না পারে। এইভাবে যখন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন যাচ্ছে তখন রোজ সে একটা আলুথালু মলিন ভিখারিকে বাজারের পাশে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখতো। সে ভিখারিটিকে নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে বিব্রত বোধ করত। টেলিভিশন চ্যানেল পরিবর্তন করার সময় সে জ্যোতিষীদের বকবক করতে দেখতো। শুনতে ভালই লাগত। কিন্তু সে জানতো যে ওরাও ব্যবসা করছে। এইভাবে দিন কাটতে লাগলো। সে সত্যিই কিছু করতে চাইত। কিন্তু চারপাশের জানালা গুলো যেন বন্ধ। শুধু পরিচিতরা আশার গান গাইতে থাকতো। তার হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। সে রোজকার সিরিয়ালের ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত বোধ করত কারণ সেগুলো একেবারেই তার জীবনের সাথে মিলত না। তাই সে ইন্টারনেটে বিনামূল্যে যা পাওয়া যেত তার মধ্যে যেগুলো ভালো লাগতো সেগুলো দেখতো ও শুনতো । কিছুদিন পর তার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল। সে মলিন ভিখারিটার প্রতি উৎসুক হয়ে উঠলো কারণ ওর মধ্যে সে নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পেত। ‘কেন লোকটা ভিখারি হলো?’ - এই প্রশ্ন তাকে তাড়া করতে লাগলো। তাই সে একদিন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেরোল। সে ভিখারিটার কাছে গেল এবং তাকে পাঁচ টাকার একটা মুদ্রা দিল। তারপর সে কাছের চায়ের দোকানটাতে গেল এবং সেখান থেকে ভিখারিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। সে দেখল ভিখারিটা পা চুলকাচ্ছে। এদিন সে বাড়ি ফিরে আসলো। এইভাবে সে ভিখারিটাকে ঠিক বুঝতে পারল না। তাই সে ভাবল যে সে একটা ওয়েবব্লগ খুলবে যেখানে সে রাস্তায় পড়ে থাকা ভিখারিদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন উপায় নিয়ে আলোচনা করবে। শুরুতে সে খুব বেশি সাড়া পেল না। তাই সে এবার ব্লগটাকে বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইটে শেয়ার করে দিল। এর কিছুদিন পর আরেকজন সমবয়সী যুবক সাড়া দিল। সে একটা সংগঠন শুরু করার প্রস্তাব দিল। এই সংগঠনের কাজ হবে রাস্তায় পড়ে থাকা ভিখারিদের জীবনের ইতিহাস অন্বেষণ করা এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যাতে তারা মূলস্রোতে ফিরতে পারে। এই কথাটা নকুলের খুব ভালো লাগলো কারণ ভিখারিদের শুধু অন্ন বস্ত্র অর্থ দিলেই এই সমস্যা নির্মূল হবে না। ইন্টারনেটে আলোচনা চলতে থাকলো।শেষ পর্যন্ত তারা ঠিক করল যে তারা কাজটা একটা ভিখারিকে নিয়ে শুরু করবে। তাতেই বোঝা যাবে যে তাদের পরিকল্পনা কাজে দেয় কিনা। তাই তারা ঠিক করল যে একদিন সেই মলিন ভিখারিটার কাছে কোথাও তারা দেখা করবে। তারা একটা চায়ের দোকানে দেখা করল। এক কাপ করে চা খেয়ে তারা ভিখারিটার কাছে গেল। তারা ভিখারিটাকে কিছু পয়সা দিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে পাশে বসল। ভিখারিটা সত্যিই নোংরা। নির্ঘাত কয়েক যুগ চান করে নি। যাই হোক তারা তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলো। ভিখারিটা প্রথমে একটু আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তবে ধীরে ধীরে সে মুখ খুলতে শুরু করলো।
আদতে তার নাম হলো কানন। তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কুমিরডাঙা বলে একটা গ্রামে। সে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত একটা স্কুলে পড়েছে। তার বাবা ছিল ভাগচাষী। তার বয়স যখন দশ তার বাবার চাষ করতে গিয়ে বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়। তার মা বিধবা হয়ে পড়ে। কুমিরডাঙায় তাদের এক ছোট্ট কুঁড়েঘর ছিল। প্রতি বর্ষায় এই কুঁড়েতে জল ঢুকে যেত। সব ছারখার হয়ে যেত। আর আবার তারা ঘর বাঁধত। বাবার মৃত্যুর পর তার বিধবা মা কলকাতা শহরে চলে আসে। বিভিন্ন বাড়িতে সে ঘরের কাজে নিযুক্ত হয়। কানন তার গরীব কাকা কাকিমার সাথে গ্রামেই থাকতো। কিন্তু একদিন সকালে হঠাৎ তার কাকা খবর পায় যে শহরে কাননের মা কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। কাছের এক ক্লাবের সহায়তায় শবদেহটি কুমিরডাঙায় তার কাকার কাছে পৌঁছে যায়। সেখানেই এক শ্মশানে কানন তার মার মুখে আগুন দেয়। এরপর দারিদ্রতার কারণে কাননের কাকা কাকিমা তাকে খাবার জোগাতে অস্বীকার করে। তাই সে কুমিরডাঙা ছেড়ে শহরে আসে খাবারের সন্ধানে। সে এই শহরের কাউকে চিনতো না। তাই সে শেয়ালদা স্টেশনেই ভিক্ষা করতে শুরু করে। খুব শিগগিরই সে সেখানকার ভিক্ষাবৃত্তির নিয়ন্ত্রক ভিক্ষুকদের নিশানায় পরিণত হয়। তাই সে লোকাল ট্রেনে চড়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে শুরু করে ভিক্ষা করতে। কখনো কখনো সে রাস্তার ধারে খাবারের হোটেল গুলোতে কাজ করতো। এইভাবে রাস্তার ধারের দোকানে কাজ করে এবং ভিক্ষা করে সে প্রায় তিরিশ বছর কাটিয়ে দেয়। বর্তমানে অপুষ্টির কারণে সে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিগত কয়েক মাস ধরে নকুলদের বাড়ির কাছে বাজারের ধারে রাস্তায় তার ঠিকানা। এখানে এক উদার খাবার বিক্রেতা তাকে খাবার দেয়। আর বিক্রেতাদের সমাজ তাকে সাহায্য করে। সে রাস্তাতেই পড়ে থেকে ভিক্ষা করে যায়।
নকুল ও তার বন্ধু খুব মন দিয়ে কাননের গল্প শুনলো। তারপর তারা কিছু করবে বলে ঠিক করলো। একটা উপায় হলো কাননের জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা করা। কিন্তু তার মানসিক পরিচর্যার প্রয়োজন যাতে সে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। প্রকৃতপক্ষে আপাতত তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যাইহোক তারা যে যার বাড়ি ফিরে গেল। তবে তারা এই সমস্যার সমাধান খুঁজে যেতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নিল যে তারা একটা সংস্থা তৈরি করবে। তারা বিভিন্ন পরোপকারী ক্লাব, সংগঠন এবং সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ করতে লাগলো। এইভাবে ধীরে ধীরে তাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে উঠলো। এই সংস্থা রাস্তার ধারে পড়ে থাকা ভিখারিদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হল।
এই গল্পটা শুনতে ভালো লাগলেও লাগতে পারে। কিন্তু তাদের যাত্রাপথ একেবারেই মসৃণ ছিল না। এই পৃথিবীতে অর্থ সংগ্রহ করা একেবারেই সহজ কাজ নয় ঠিক যখন সরকার পবিত্র গঙ্গাকে পুঁজিদৈত্যদের হাতে বেচে দিতে উদ্যোগী। এই দেশ ও জাতি খুব শিগগিরই পরিণত হবে পুঁজিদৈত্যদের এবং তাদের স্বত্বভোগীদের এক সমষ্টিতে। আর এই ধরনের দানশীল সংস্থাগুলি সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে বাধ্য হবে পুঁজিদৈত্যদের ওপর।যদি তারা চায় গরীবদেরকে সাহায্য করতে তাহলে করবে। যদি তারা না চায় তাহলে করবে না। কিন্তু আসল সমাধান হলো দারিদ্র দূরীকরণ। এটা কিভাবে সম্ভব? কেন সম্পদ ক্রমশ কেন্দ্রীভূত হয়ে চলেছে দানবদের হাতে? কেন কিছু লোকের দয়ায় বেঁচে থাকা? কেন জীবনকে ভয় করা? সাম্য আর কতদূর? কিছু লোকের সমষ্টি যে দেশ তার জন্য কিসের অহংকার? ‘পুনর্বাসনকেন্দ্র’ চালাতে চালাতে প্রতি মুহূর্তেই নকুল হোঁচট খায় এইসব প্রশ্নে। কিন্তু সে চুপ করে থাকে এবং সমাজের প্রতি তার সেবাকর্তব্য চালাতে থাকে।