STORYMIRROR

Saibal Ray

Inspirational Others Children

4.0  

Saibal Ray

Inspirational Others Children

ভারত ভাবনা

ভারত ভাবনা

6 mins
214

ভারতবর্ষ, ইন্ডিয়া না অন্য কিছু? কোনটা আপনার পছন্দ জানিনা। তাতে কিছু আসে যায় কিনা তাও জানিনা! কে যেন বলেছিলেন নামে কি আসে যায়। তবে ইদানিং কালে দেখা যাচ্ছে সত্যিই নামে অনেক কিছু আসে যায়। সেই কারণে চলুন একটু চোখ বুলিয়ে নেই আমাদের স্বদেশের বিভিন্ন নামগুলির দিকে। আমি কোন ঐতিহাসিক নই তাই এই উপমহাদেশের জনপ্রিয় কিছু নাম নিয়ে আলোচনা করব মাত্র। আপনারা অনেকেই হয়ত এ বিষয়ে অবগত। তবু আমার মত করে লিখবার চেষ্টা করছি।  

ইন্ডিয়া: এই নামটি বোধহয় সর্বাধিক প্রচলিত নাম। চলুন দেখে নেই এই নামটির নেপথ্যে দাঁড়িয়ে থাকা জনপ্রিয় ধারণা। এই নামটি নাকি এসেছে জনপ্রিয় সংস্কৃত 'সিন্ধু' শব্দ থেকে। আমরা সকলেই জানি সিন্ধু একটি নদীর নাম। পুরনো পার্সিয়ান কথ্য ভাষায় এটিকে ডাকা হতো 'হিন্দু' বলে। এই হিন্দু প্রদেশ সম্পর্কে কিছু প্রচলিত এবং ঐতিহাসিক ধারণা আছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো প্রথম দারিয়াস দখল করেছিলেন সিন্ধু প্রদেশ (৫১৬ বিসিই) এবং সম্ভবত স্কাইলাক্স বলে সমসাময়িক এক গ্রিক পর্যটক এই অঞ্চলের নিম্ন অববাহিকায় ব্যবহৃত এই পার্সিয়ান নামটিকে পৌঁছে দেন গ্রিকদের কাছে। দ্বিতীয়তঃ হেরোডোটাসের ভূগোলে 'ইন্দোস' এবং 'ইন্ডিয়ান' শব্দ দুটি পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে 'স' এর 'হ' হয়ে যাওয়াটা এশিয়া মাইনরে ব্যবহৃত গ্রিক ডায়ালেক্ট এর প্রভাব বলে মনে করা হয়। হেরোডোটাস সর্বপ্রথম সিন্ধু নদের নিম্ন অববাহিকায় বসবাসকারী জনগণের নাম ইন্ডিয়ান শব্দটিকে পার্সিয়া প্রদেশের পূর্বে অবস্থিত সমস্ত প্রদেশের জনগণকে বোঝাতে সাধারণভাবে ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে মেগাস্থিনিস দক্ষিণ ভারতীয় উপদ্বীপকেও ইন্ডিয়ার অন্তর্গত বলে অভিহিত করেন। 


ভারত: ভারত অথবা ভারতবর্ষ নামটি এসেছে পুরান থেকে। পুরানমতে ভারত নামটি এসেছে রিষভের এর পুত্র ভরতের নাম থেকে। আবার কিছু পৌরানিক অনুচ্ছেদে পাওয়া যায় ভারত নামটি রিষভের পূর্বপুরুষ মনুর আরেক নাম। মহাভারতে আছে 'ভরত-জনগণ' হল রাজা দুষ্মন্তের সন্তান সন্ততি। ভারতবর্ষ কথাটির আক্ষরিক সংস্কৃত মানে হল ভারতের দেশ। আবার বায়ুপুরানে আছে যে, যে গোটা ভারতবর্ষ জয় করবে সে হল 'সম্রাট'। আবার বিভিন্ন হিন্দু টেক্সট যেমন বেদ, পুরান, মহাভারত, রামায়ণ ইত্যাদিতে 'ভারত খন্ড' বা 'ভারত ক্ষেত্র' বলে উল্লেখ করা হয়েছে অধুনা ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মায়ানমার এবং দক্ষিণ এশিয়ার আরো বেশ কিছু অঞ্চলের সম্মিলিত ভূখণ্ডকে। 


হিন্দুস্তান: আগেই বলা হয়েছে 'হিন্দ' এবং 'হিন্দু' এই শব্দদুটো এসেছে সংস্কৃত বা আর্য শব্দ 'সিন্ধু' থেকে। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় সম্ভবত ১০০ সিই সময়কাল থেকে মধ্যপার্সিয়ার জনগণ এই হিন্দু শব্দের সাথে 'স্তান' কথাটি জুড়ে দেন যাতে স্পষ্টভাবে এবং পৃথকভাবে এই ভূখণ্ডকে চিহ্নিত করা যায়। এর আগে (৫০০বিসিই) মিশরে তৈরি প্রথম দারিয়াসের মূর্তিতে খোদাই করা 'হিন্দ' শব্দটির একটি প্রকারভেদ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে এই শব্দটি আরবি ভাষায় ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। আরবি ভাষায় ইন্ডিয়াকে 'আল হিন্দ' বলে অভিহিত করা হয়। দিল্লির সুলতানরা এবং মুঘলরাও এই ভূখণ্ডকে 'হিন্দুস্থান' বলেই অভিহিত করতেন। এছাড়াও 'জয় হিন্দ' একটি হিন্দি ভাষায় বহুল প্রচলিত স্লোগান। সময়ে সময়ে হিন্দি ভাষাভাষির জনগণ ভারত মহাসাগরকে 'হিন্দ মহাসাগর' বলেও ডেকে থাকেন। ১৭ শতক নাগাদ 'হিন্দ' এবং 'হিন্দুস্থান' শব্দ দুটি ইংরেজি ভাষায় জায়গা করে নেয়। আরো পরে ১৯ শতক নাগাদ ব্রিটিশ রাজের সময় এই শব্দদুটি 'ইন্ডিয়া'র সাথে একইভাবে সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। 


জাম্বুদ্বীপ: এই নামটি বহু প্রাচীন লিপিতে পাওয়া যায়। এটিকে মনে করা হয় সংস্কৃত শব্দ যার আক্ষরিক অর্থ হলো বেরির দ্বীপ। ইন্ডিয়া নামের প্রচলন এর আগে এই নামটি ভারত সম্পর্কে বেশকিছু দক্ষিণ এশীয় দেশে ব্যবহৃত হতো। এখনো সময়ে সময়ে এই নামটি মালয়েশিয়া, জাভা এবং বালির লোকজন ভারতের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকেন। তবে প্রকারান্তরে এই নামটি এইসব দেশে সমগ্র এশিয়াকে বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়। 

তিয়াংঝু: 'তিয়াংঝু' বা 'তেনজিকু' এই শব্দদুটি ইন্ডিয়াকে বোঝাতে বহু প্রাচীনকাল থেকে চীন দেশে এবং জাপানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জাপান এবং বেশকিছু অন্যান্য এশীয় দেশের লোকজন বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগণ 'তেনজিকু' নামটি ভারত সম্পর্কে ব্যবহার করেন কারণ এই শব্দটির মানে হল 'স্বর্গীয় কেন্দ্র' অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগণ ইন্ডিয়াকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রস্থল হিসেবে চিহ্নিত করেন। চীনের মানুষজন ইন্ডিয়াকে অনেক সময়ই পাঁচটি ভৌগলিক অঞ্চলের (উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম এবং মধ্য) সমষ্টি বলে মনে করেন। এই কারণে তারা এই ভূখণ্ডকে প্রায়শই 'উতিয়াংঝু' বলে ডাকেন। 'উতিয়াংঝু' শব্দটির মানে হল 'পাঁচটি ইন্ডিয়া'। আধুনিক জাপানিরা ইন্ডিয়াকে 'ইন্দো' এবং আধুনিক চীনারা ইন্ডিয়াকে 'ইন্দু' বলে ডেকে থাকেন। 


হদু: ইন্ডিয়ার বাইবেলে উল্লেখিত হিব্রু নাম হল 'হদু'। ইহুদিদের 'তানাখ' এবং খ্রিষ্টানদের 'ওল্ড টেস্টামেন্টে'র অংশ 'বুক অফ এস্থার' এ ইন্ডিয়াকে এই নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই নামটিরও ব্যুৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ 'সিন্ধু' থেকেই ধরা হয়। হিন্দুর মত এটিও সিন্ধুর একটি হিব্রু প্রকার। 


 এ পর্যন্ত যা বলা হলো তার অনেকটাই অনেকের জানা এবং আজ ইন্টারনেটের যুগে এই তথ্যগুলো পাওয়া খুবই সহজ। কিন্তু মজার বিষয় হলো এই নাম গুলোর মধ্যে যেকোনো একটি নাম আপনার পছন্দ হতেই পারে এবং আপনি সেটা ব্যবহারও করতে পারেন। কারো কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল বাস্তবে তা ঘটে না। আপনি পাঁচবার এই ভূখণ্ডকে ইন্ডিয়া নামে ডাকলে কিছু লোক জড়ো হয়ে যাবে আপনার বিরুদ্ধে। বলবে আপনি ভারত বলে ডাকছেন না কেন। আবার ধরুন আপনার ভারত নামটাই ভালো লাগলো আপনি এই ভূখণ্ডকে ভারত বলে ডাকতে শুরু করলেন। কিছু লোক আপনাকে প্রশ্ন করবে আপনি হিন্দুস্থান বলে ডাকছেন না কেন। আবার হিন্দুস্থান বলে ডাকতে শুরু করলে আপনাকে চিহ্নিত করা হবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে। কিন্তু আদতে হিন্দুস্থান শব্দটির ব্যুৎপত্তির সাথে প্রচলিত হিন্দু ধর্মের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। আবার ধরুন আপনি জানতে চাইলেন পুরানকে কি ঐতিহাসিক দলিল বলা যায় নাকি সেটি ঐতিহাসিক সাহিত্যমাত্র। এক্ষেত্রে আপনি কিছু মানুষের প্রচন্ড রোষের সম্মুখীন হতে পারেন। ইতিহাস এবং মাইথোলজি নিয়ে ঝগড়া বাধানোর লোকের অভাব নেই। এবং এই ঝগড়ুটেদের পৃষ্ঠপোষকরাও অনেক সময়ই সরকারের নিয়ন্ত্রক। তারা দেশের সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য সাধারণ মানুষকে অনেক সময়ই নিঃস্ব করে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সংকট সৃষ্টি করে যে সেই সেই সংকট সমাধানে এগিয়ে আসে। এই কায়দা বিশ্ব জুড়ে চলছে। ভারতীয় ভূখণ্ড তার ব্যতিক্রম নয়।তাই বলছি আপনার যে নামে ইচ্ছে এই ভূখণ্ডকে ডাকুন। আমার আপনার যেমন একাধিক নাম থাকতে পারে তেমনি দেশের একের বেশি নাম থাকতেই পারে। তর্ক বিতর্ক চলুক। দেশের সম্পদ সবার হোক। বাজারি অর্থনীতি ধ্বংস হোক। সমবন্টন চালু হোক। তবেই তো আপনি নিজেকে ভারতীয় বা ইন্ডিয়ান বলতে পারবেন। 


এবার একটু ভবিষ্যতের দিকে আলোকপাত করা যাক। কালের নিয়মে সবকিছুই পরিবর্তনশীল। ইতিহাস তার সাক্ষী। সিন্ধু অববাহিকা থেকে যেমন জন্ম নিল হিন্দুস্থান বা ইন্ডিয়া ঠিক তেমনি ভবিষ্যতে এই ভূখন্ডের কী দশা হবে তা আমরা কেউ জানিনা। তবে সময় এগিয়ে চলে, সভ্যতা এগিয়ে চলে আর অপশক্তি পথে বাধার সৃষ্টি করে। কখনো কি ভেবে দেখেছেন এই পৃথিবীতে এতগুলো দেশ কেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বঙ্গভঙ্গ কোন সাধারণ বাঙালি মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু এই উপমহাদেশে একই ভাষাভাষীর মানুষ দু'ভাগ হয়ে গেল শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে। এর কি কোন প্রয়োজন ছিল? আপনি ভাবছেন আমি অখন্ড ভারতের ধারনার দিকে এগোচ্ছি। কিন্তু একেবারেই ভুল ভাবছেন। আমি বলতে চাইছি যে এই পৃথিবীতে এত ভেদাভেদ এর কোনো প্রয়োজন নেই। গোটা পৃথিবী একটিমাত্র দেশে পরিণত হতে পারে। এবং ভবিষ্যতে তা হবে কারণ প্রযুক্তি এবং সভ্যতা আজ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। বৈষম্যবাদী অপশক্তির হাতের যন্ত্রগুলো - ধর্ম, কালচার, জাতি, বর্ণ ইত্যাদি - অকেজো হতে শুরু করেছে। তাই অপশক্তির সর্বস্তরে বৈষম্য বাড়ানোর ঘৃণ্য চেষ্টাগুলো আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। তবে মানব সমাজ ক্রমশ এগোচ্ছে সমস্ত বৈষম্য বর্জন করার লক্ষ্যে। আপনি হয়তো ভাবছেন যে সবকিছু মেনে নিলেও সুষ্ঠ প্রশাসন চালানোর জন্য গোটা পৃথিবীকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত তো করতে হবেই। নইলে এই ক্ষুদ্র মানব সমাজের পক্ষে সুস্থ প্রশাসন চালানো অসম্ভব। সেক্ষেত্রে বলি সেই সীমানা প্রকৃতি ঠিক করে দিয়েছে। একবার চোখ মেলে প্রকৃতির দিকে তাকান। দেখবেন উত্তরে হিমালয় দক্ষিনে ভারত মহাসাগর বিরাজমান। আলাদা করে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। প্রকৃতি ঠিক করে দিয়েছে সীমানা। তাই আজ থেকে ৫০০ বছর পর ভারতবর্ষের নাম কি হবে আমরা জানি না। হয়তো সেদিন হিন্দু থাকবে না, মুসলিম থাকবে না, খ্রিস্টান থাকবে না, থাকবে না বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। থাকবে শুধু মানুষ। আর এই উপমহাদেশ খুঁজে নেবে আরো নতুন নতুন নাম। তারপর হয়তো এমন একদিন আসবে যখন প্রয়োজন হবে না রাষ্ট্রের। একটা সভ্য সমাজ উপভোগ করবে প্রকৃতির বৈচিত্র। হারিয়ে যাবে বৈষম্য। সমৃদ্ধ হবে বৈচিত্র। উন্মুক্ত হবে এই উপমহাদেশ হয়তো অন্য আরেক নামে। সত্যিই তো, নামে কি আসে যায়!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational