পুজোর সাজ
পুজোর সাজ


ভোর পাঁচটার থেকে হান টান করছে অশীতিপর বৃদ্ধা সুরবালা। আজকাল কোমর সোজা করে দাড়াতে পারেনা সে, চোখের দৃষ্টি হয়ে গেছে অস্বচ্ছ। আজ ষষ্ঠী, পাড়ার পুজোয় ঢাক বাজছে সকাল থেকে। জানলার শিকটা ধরে বাইরের রাস্তার দিকে তাকাল সুরবালা, এতো দেরি তো হয় না। প্রত্যেকবার পঞ্চমীর দিন সুরেশ এসে পৌঁছে দিয়ে যায়। সুরেশ হলো সুরবালার সইয়ের ছেলে। সুরবালা নিঃসন্তান, কিন্তু তার এই দুঃখ, কোনদিনই তাকে বুঝতে দেয়নি সুরেশ। সুরেশের মা প্রমীলা ছিল সুরবালার সই। সে আজ অনেক দিনের কথা। তখন সুরবালার বয়স হবে এই বারো তেরো। প্রমীলাও ওই বয়সী। সবে বিয়ে হয়ে গাঁয়ে এসেছে সে। পুকুর ঘাটে গিয়ে দুজনের আলাপ , আর তারপর থেকেই গলায় গলায় বন্ধুত্ব। রোজ দুপুর বেলায় তারা পুকুর পাড়ের তেঁতুল তলায় দেখা করত। কত মনের প্রাণের কথা হত। যে কথা আর কাউকে বলা যায় না, সেই সব কথা । বিয়ের এক বছর পরই প্রমীলার ছেলে হল, সুরেশ। সুরবালার বিয়ের দু বছর হয়ে গেছে, কিন্তু তার কোন সন্তান হয় নি। তার পরিবারে এই নিয়ে প্রায়ই অশান্তি হয়। শাশুড়ি কথায় কথায় বাঁজা বউ কথাটা শোনাতে ছাড়ে না। একদিন অশান্তি তুমুলে উঠলো , সুরবালা সহ্য না করতে পেরে গলায় কলসি বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে।
কিন্তু মরা তার হল না । তার সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রমীলা আসছিল সুরেশকে কোলে নিয়ে। দূর থেকে তাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে তাকে জল থেকে তুলে বাঁচালো। তারপর তার গলা জড়িয়ে ধরে প্রমীলার সে কি কান্না। তার হাত নিয়ে সুরেশের মাথায় রেখে তাকে প্রতিজ্ঞা করালো, “বল তুই আর এই কাজ কোনদিন করবি না। আজ থেকে আমার ছেলে তোর ছেলে। সুরেশের দুটো মা। আমি থাকি বা না থাকি সুরেশ তোর দেখাশোনা করবে এই আমি কথা দিলুম।“
তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। এখন সুরেশ কলকাতায় থাকে। আজ প্রায় চল্লিশ বছর হল প্রমীলা মারা গেছে। সুরেশের বউ রমা বড় ভালো মেয়ে, ওদের দুটি মেয়ে। মেয়েগুলো যখন ছোট ছিল ওরা সবাই ছুটিছাটার দিনে আসতো নিয়মিত গ্রামের বাড়িতে। এখনও সুরবালার চোখের সামনে ভাসে ওই দিনগুলো। সুরেশ চুপচাপ কিন্তু রমা খুব কথা বলে, দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই তার গলা শোনা যেত,” সইমা ও সইমা, কোথায় গেলেন?” সুরবালা রান্নাঘর থেকে মুখটা বার করলেই পায়ে হাত দিয়ে ঢক করে একটা প্রণাম করতো রমা আর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদুটো ছুটে এসে ওর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ত, সইমা বলে। সঙ্গে সঙ্গে সুরবালা নকল রাগে বলে উঠতো, “কতবার বলেছি না আমি তোদের বাবার সইমা কিন্তু তোদের সই। আমাকে শুধু সই বলে ডাকবি।“ ওরা দুটিতে খিলখিল করে হেসে উঠত।
হঠাৎ পাশের বাড়ির গোপালের মায়ের গলার আওয়াজে সম্বিত ফিরে পায় সুরবালা, “তুমি কি রাতভোর এই জানলা ধরে ডাইরে ছিলে নাকি গো ঠাগমা?“
সুরবালার গা জ্বলে গেলো, “ তাতে তোর কি রে হতভাগী?”
“বাব্বা, ছেলের জন্য এমন হাপিত্যেশ করতে কাউকে দেকিনি। তাও যদি নিজের পেটের হত।“ টিটকিরি মারল গোপালেরমা। কথাবার্তার আওয়াজে আরও দুচারজন বউ ঝি জুটে গেলো মজা দেখার জন্য। ঠাকুমার পিছনে লাগতে সবারই ভালো লাগে। গোপালের মায়ের কথার হুলটা সুরবালা ভালোই টের পেল কিন্তু একটা জুতসই উত্তর দেবার আগেই ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একটা বলে উঠলো,” ছেলের জন্য নয়গো, ছেলের বউ কোলকেতা থেকে এবার পুজোর শাড়ি পাটায়নে তাই ঠাগমার মন খারাপ,” একটা হাসি রোল উঠলো চারদিকে । প্রচণ্ড রাগে সুরবালার ব্রহ্মতালু অবধি জ্বলে উঠলো, সে চিৎকার করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় পাড়ার মেয়ে টেঁপি এসে খবর দিলো,” অ ঠাগমা, তোমার ছেলে আসতেছে গো, হুই দেকো।”
মুহূর্তের মধ্যে সুরবালার রাগ ও জমা হওয়া বউ ঝিয়ের দল গায়েব হয়ে গেলো।
সুরেশ দরজার পাশে জুতো খুলে, দাওয়াতে এসে বসলো , “এবার একটু দেরি হয়ে গেলো গো সইমা। কলকাতায় কি বৃষ্টি ! আমাদের বাড়ির সামনে এক হাঁটু জল।“
কাঁপা হাতে জলের গেলাসটা এগিয়ে দিতে দিতে সুরবালা বলল,” তাতে কি হয়েচে বাবা। তা তোরা সব ভালো আচিস তো?”
“ সব ভালো। তোমার বউমা আসতে পারলোনা। তোমার বড় নাতনী এসেছে, তার ছেলেপুলে হবে। তোমার জন্য শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ পাঠিয়েছে। দেখ পছন্দ হয় কিনা ।“ বলে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিলো সুরেশ সুরবালার দিকে।
সুরবালা একে একে জিনিষ গুলো ব্যাগ থেকে বার করে করে দেখতে লাগলো, দুটো সাদা খোলের শাড়ি, একটার নীল পাড় আর একটার খয়েরি পাড়। সাথে সাদা ব্লাউজ ও সায়া। ব্যাগের তলায় একজোড়া চটি ও রয়েছে। আর রয়েছে এক বাক্স কড়াপাকের সন্দেশ, সুরবালা ভালবাসে বলে প্রতিবার রমা পাঠায়। জিনিশগুলির উপর পরম স্নেহে হাত বোলাতে লাগলো সুরবালা। হঠাৎ দরজার দিকে চোখ পড়তেই সে দেখলো গোপালের মা উঁকি মারছে।
“এই পোড়ারমুখি, এদিকে আয়, দেকে যা আমার বউমা আমার জন্যে কি পাঠিয়েছে। কোলকেতার শাড়ি, যেমন খোল তেমন পাড়।“ সুরবালার মুখে হাজার ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে।
গোপালের মা ভিতরে এসে শাড়িটা হাত দিয়ে দেখে বলল,”তোমার বউয়ের মন আছে গো ঠাগমা।“
“তবে? বউমা আমার লক্ষ্মী।” সগর্বে চেঁচিয়ে ওঠে সুরবালা, তারপর সুরেশের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠে ,” আর আমার ছেলে রাজা। শুধু পেটে ধরলেই কি ছেলে হয়...“ হঠাৎ গলাটা কান্নায় বুজে আসে সুরবালার।