পুজোর কাপড়
পুজোর কাপড়
" কি এত ভাবচ?" ঘাম মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে রবি।
" বর্ষায় ঘরটার অবস্থা তো গেছে। ঘরটা সারানা দরকার। পূজা আসচে। ছ্যানাগুলানের জন্যে একটা করে হলেও নূতন জামা না কিনলে হয়? সবাই নূতন জামা পরে ঘুরবে। " অসহায় মাতৃহৃদয়ের বেদনা ফুটে ওঠে মিনতির কণ্ঠে।
" ঠিক কথাই বলচ । আমার মাথাতেও আছে কিন্তু কি করে কি করব সেটাই ভাবচি।" রবির কণ্ঠেও চিন্তার সুর।
পলাশবনি গ্রামের নিতান্তই ছোটখাটো চাষী রবি। দুবিঘা নিজস্ব ধানজমি ছাড়াও লোকের জমিতে ভাগ চাষ করে কায়ক্লেশে সংসার চালায়। স্ত্রী মিনতি, কন্যা নীলু আর চোদ্দ বছরের পুত্র বিলুকে নিয়েই তার জগৎ। রবির সংসারে একটা বস্তুরই অভাব সেটা হল অর্থের নাহলে সুখে-শান্তিতেই বাস করে তারা। ছেলে-মেয়ে কিংবা স্ত্রী কারুরই সাধ্যের বাইরে সেরকম কোনও চাহিদা নেই তাই সীমিত সামর্থ্য নিয়েও ভালোই দিন কাটে তাদের কিন্তু এবছরের অতি বৃষ্টি তাদের সুখের ঘরেও দুশ্চিন্তার বান ঢুকিয়ে দিয়েছে। অতি বৃষ্টিতে অনেক ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় তাদের মাটির বাড়িখানার অবস্থাও শোচনীয় হয়ে গেছে।
বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ক্লান্তিকর ডাক। পরিশ্রান্ত রবি গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন কিন্তু মিনতির চোখে ঘুম নেই। ক্রমাগত ছটফট করছে। একটা কথা বলতে চাইছে সে কিন্তু বলে উঠতে পারছে না। রবির ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। এতবছরের দাম্পত্যের অভ্যেস। এতটুকু তাল কাটলেই বুঝতে পারে।
" মিনু, ঘুমাও নি কেনে? শরীর খারাপ?" উদ্বিগ্ন হয় রবি।
" না মানে একটা কথা বলব?"
" বল না।"
" রাগ করবে নি বল।"
" আচ্ছা করব নি। বল।"
" কল্পনা বৌদির মেয়ের বাচ্চা হবে। এখেনে এসেই থাকবে। কল্পনা বৌদি খবর পাঠিচে যে আমি যদি মনি ঘরে আসার পর ওদের কাজগুলা করে দিই। মনির তো অনেক ভালো ঘরে বিয়া হইচে তো সে বলে দিয়েচে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কেউ ছাড়া তার বাচ্চার কাজ করতে দিবেনি। মনিও আমাকেই চাইচে। বলচি কি আমি ঘরের কাজ সামলেই কাজটা করি না গো? তুমি তো বলছিলে ঘর সারিয়ে আর সংসার চালিয়ে হাতে কিছু থাকবে নি। ছ্যানাগুলানকে পূজায় নূতন কিছু দিতে পারবে নি। নীলু বড় হইছে কিছু বলবে নি। বিলুটা এখনও ছোট। গতবছরই বলছিল যে অর বন্ধুদের সবার কম করে দুটা জামা হইচে আর অর মোটে একটা।"
রবি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল। হয়ত নিজের অসহায়তার সঙ্গে একটু যুঝবার চেষ্টা করল। শুধু ঘর সারানো কিংবা সংসার চালানোই নয় সেইসঙ্গে আছে বিলুর পড়ার খরচ। তার ছেলেমেয়ে দুটো পড়াশোনায় বেশ ভালোই। নীলু তো অনেক দিন থেকেই ছোট বাচ্চাদের টিউশন করে নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালায়।
" কিগো করব কাজটা?" ব্যগ্র মিনতি রবির সম্মতির প্রতীক্ষায় থাকে। রবি ঘাড় নেড়ে অনুমতি দেয়।
অন্ধকার ঘরে হ্যারিকেনের দুই পাশে ইতিহাস আর অংকের বই দুটো খোলা। নীলু অতীতের গর্ভে নিমগ্ন কিন্তু অংকের বইয়ের মালিকের সব হিসেব নিকেশ বোধহয় গুলিয়ে গেছে কারণ খাতার পৃষ্ঠায় এখনও কলমের আঁচড় পড়েনি। পড়তে পড়তে ভাইয়ের দিকে চোখ পড়ল নীলুর," বসে আছিস কেন?"
" এমনি।"
" অঙ্কগুলো তাড়াতাড়ি শেষ কর।" ভাইকে ধমক লাগায় নীলু।
" আমি একটু মায়ের সঙ্গে রান্নায় লেগে দিয়ে আসি। মাকে অনেক নিষেধ করেছিলাম। বললাম আমাদের কিচ্ছু লাগবে নি। মা শুনল নি কাজ করতে যাচ্ছে। মায়ের মুখ দেখেই বুঝতে পারছি মায়ের কত কষ্ট হচ্ছে।" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলু বই রেখে উঠে গেল।
" পারবি তো বিলু?"
" হ্যাঁগো, সান্টুদা। তুমি শুধু নিয়ে চল। আমার টাকার খুব দরকার।" কাতর আর্জি জানায় বিলু।
বিলে নামার আগে সান্টু বলল," যত তুলতে পারবি তত টাকা বুঝলি তো।"
" হুঁ।" মাথা নাড়ে বিলু। বিলের পাড়ে সাদা কাশের সমুদ্র। বাতাসে পুজোর গন্ধ কিন্তু সেসব ছাপিয়ে বিলুর নাকে যেন এসে লাগছে নতুন কাপড়ের গন্ধ। সান্টুর সাথে বিলের জলে নেমে পড়ে সে। বিল আলো করে ফুটে আছে নীল পদ্মের ঝাঁক। মা দূর্গাকে তুষ্ট করতে প্রয়োজন একশ আট নীলপদ্ম তাই এই সময় নীলপদ্মের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। সান্টু নীলপদ্ম তুলে বিক্রি করতে যায়। বিলুকে সান্টু কথা দিয়েছে যে তাকে বিক্রি করতে যেতে হবে না শুধু তুলে দিলেই হবে। সান্টুই নিজের ফুলের সাথে বিলুর ফুল নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে টাকা এনে দেবে বিলুকে। বেশকিছু ফুল তুলে ফেলেছে বিলু। বিলের ঠান্ডা জলে হাত-পা জমে যাচ্ছে তাও তার উৎসাহে কমতি নেই।
" আঁক।" বিলুর চোখ দুটো আতঙ্কে ঠেলে বেরিয়ে আসছে।
" কি হল রে?" সান্টু কিছুটা দূরে ছিল।
বিলুর বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। বিস্ফারিত চোখে সে শুধু তার সামনে উপস্থিত মৃত্যুদূতের দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্ম তুলতে গিয়ে অনেকেই সাপের কামড়ে মারা যায়। বিলুর বুঝতে বাকি রইল না যে মৃত্যু তার শিয়রে।
অতি কষ্টে চোখ দুটো খুলল অচেতন বিলু। তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে তিনটে উদ্বিগ্ন মুখ। একটু দূরে আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। একটু ধাতস্থ হতে বুঝতে পারল সে তার নিজের বাড়িতেই শুয়ে আছে।
" বিলু, এখন কেমন লাগচে বাবা?"
" ভালো।" বাবার প্রশ্নের উত্তরে ক্ষীণস্বরে জানালো বিলু।
" তোর কি জন্য টাকার দরকার পড়ল বাবা? মানছি আমরা গরীব তাও তো আমাদের সাধ্য মত তোদের...।" কথা শেষ করতে পারল না মিনতি। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
" আজ যদি তোর কিছু হয়ে যেত? সান্টুদা আর মিলন কাকু মিলে সাপটার হাত থেকে তোকে না বাঁচাতো কি হত বলত?" গলা ধরে এল নীলুর।
" কেন এমন করলি বাবা?"
" তোমার জন্য নতুন কাপড় কিনব বলে।" অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে বিলু।
" কি বললি!" মিনতি বাকরুদ্ধ।
" তুমি কত কষ্ট করে লোকের ঘরে কাজ করে আমাদের জন্য নতুন জামা কিনে এনেছ। তুমি আর বাবা পূজায় পুরানো কাপড় পড়বে তাই আমি..।" ফোঁপাতে থাকে বিলু। সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। যে ছেলে আগের বছর বন্ধুদের বেশি জামা হয়েছে বলে অনুযোগ করেছিল সে আজ মা-বাবার জন্য নতুন কাপড় কিনবে বলে নিজের জীবন বিপন্ন করল!
" তরাই যে আমার সবকিছু রে। কি হবে আমার নতুন কাপড়? আর কোনও দিন এমন কাজ করিসনি বাবা। তোদের ছাড়া আমি বাঁচব নি।" বিলুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে মিনতি। রবির চোখেও জল।
" পাগল কোথাকার! আমাকে একবার যদি বলতিস।" নীলু এসে বিছানার পাশে দাঁড়ায়। তার মুখে হাসি আর হাতে একটা পলিথিন।
" এই দ্যাখ।" একটা নতুন ছাপাশাড়ি আর একটা জামা বের করে নীলু।
" আমি আমার টিউশনির টাকা থেকে সারাবছর ধরেই একটু একটু করে জমিয়ে ছিলাম। তারপর ওই আমাদের স্কুলের পাশে দীপাকাকিমা জামা-কাপড়ে জরি,চুমকি এসব বসায়, নানারকম গয়না বানায়। তাকে মাঝে মাঝে সাহায্য করতাম। সেখান থেকেও কিছু টাকা পেতাম। তোমাদের অবাক করে দেব বলে বলিনি। তখন যদি জানতাম ভাই এমন কান্ড করবে তাহলে ওকে অন্তত আগেই বলতাম।" নীলুর মুখে তৃপ্তির হাসি।
" ও মিনতি, কাঁদচ কেন? তুমি তো মা দুগ্গা গো। তোমার নীলু একাই লক্ষী-সরস্বতী আর বিলু কাত্তিক-গণেশ।" রবি আর মিনতির চোখে আনন্দাশ্রু। সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ধরল মিনতি। বাতাসে ভেসে আসা পঞ্চমীর ঢাকের সুর বলছে এসে গেছে ভালোবাসার পুজো।
