Manasi Ganguli

Inspirational

1  

Manasi Ganguli

Inspirational

পুজোর একাল সেকাল

পুজোর একাল সেকাল

4 mins
713


তিনবছর পর সুপ্রিয় এবার পুজোয় বাড়ীতে,গতবছর এসেছিল নভেম্বরে। চাকুরীসূত্রে আমেরিকা যাবার পর কলকাতাকে খুব মিস করে পুজোর সময়। তাই আগের বছরেই ঠিক করে রাখে,এবছর পুজোয় বাড়ী আসবে বলে। বাড়ীর সবাই খুব খুশী। দাদুর সাথে বারান্দায় বসে গল্প করছিল সুপ্রিয়,পুজোর কথাই হচ্ছিল। দাদু সেই পুরনো দিনের যৌথ পরিবারের পারিবারিক পুজোর গল্প করছিলেন,"সে কি আনন্দ, আয়োজন,বাড়ী ভর্তি আত্মীয়-কুটুম,অতিথি-অভ্যাগত,সেইসব। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গিয়ে পুজোয় সেই রমরমা আর নেই,বাড়ীর পুজোও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ীর পুজো মানে তখন ছিল বাড়ীর মহিলারা লালপাড় সাদা গরদের শাড়ী প'রে,একগা গয়না ঝমঝমিয়ে পুজোর কাজ করে চলেছেন। আরতির সময় ৪-৫টা শাঁখ,সঙ্গে ২০-২৫ জনের উলুধ্বনি,কাঁসর,ঘন্টা,ঘড়ি,ঢাক তো ছিলই,সাথে ছিল হাঁড়ি হাঁড়ি ভোগ,বাড়ীর মহিলাদের রান্না করা,সে এক এলাহি ব্যাপার। দু'বেলা রকমারি রান্নার আয়োজন,তা অবশ্য বামুন ঠাকুর রান্না করত।" সেইসব বলতে বলতে দাদুর চোখ চকচক করে ওঠে,খুশীতে ভরে ওঠে মুখ।সত্যিই তো এখন যে সব বাড়ীর পুজো হয়,তাতে এমন জাঁকজমক দেখা যায় না,আর যা দিনকাল,সম্ভবও নয়।

    এছাড়া ছিল বারোয়ারী পুজো,তা ঘিরেও ছিল আনন্দ উত্তেজনা। সে পুজোয় পাড়া-পড়শী সকলে সানন্দে অংশগ্রহণ করতেন,সেটাই তখন ছিল সবার বাড়ীর পুজোর মতই। ছেলেরা সব দোকান-বাজার বাইরের কাজ করতেন আর মেয়েরা ফুল তোলা,পুজোর জোগাড়,ভোগ রান্না,ছেলেরা সেই ভোগ বয়ে নিয়ে আসতেন পুজো মন্ডপে,প্রসাদ বিতরণ করতেন,এইভাবে মিলেমিশে নিজেদের বাড়ীর পুজোর মতই ব্যস্ত থাকতেন। তখন এত বাহ্যাড়ম্বর ছিল না,সাবেকী মূর্তিরই পুজো হত মন্ডপে মন্ডপে। এখনকার মত থিমের পুজো শুরু হয়নি তখন,ছিল না বারোয়ারীদের মধ্যে রেষারেষি,উৎসবটাই সবাই উপভোগ করত। এত বড় বড় বাজেটের পুজো তখন ছিল না বরং প্রায় সব বারোয়ারীই একদিন দরিদ্রনারায়ণ সেবার ব্যবস্থা করত,এখনও অনেক জায়গায় হয় যদিও। নিজেদের পাড়ার ঠাকুর ছাড়াও লোকে আশপাশের ঠাকুর দেখতে যেত এখনকার মতই,তবে এখন যা ভিড় হয় সুস্থভাবে ঠাকুর দেখারই উপায় থাকে না। যুদ্ধ করতে পারো তো যাও ঠাকুর দেখতে। এখন কোথাও কোথাও বিশাল বিশাল ঠাকুর হয় যা আগে ছিল না,খুবই সাধারণ মানের ঠাকুর হত তখন। এখনকার মত থিমের ঠাকুরের ধারণা তখন ছিল না। ইদানীং তো আবার থিমের সাথে ম্যাচ করে আবহ সঙ্গীত হচ্ছে,বিখ্যাত সব সুরকার তাতে সুরও দিচ্ছেন। এলাহী ব্যাপার। এক একটা পুজোর বাজেট এখন লাখ ছাড়িয়ে কোটির ঘরে। কোথাও সোনার শাড়ী পরা মা দুর্গা, কখনও বা তিনি হিরের মুকুট পরেন,বিখ্যাত ডিজাইনার দিয়ে সেসব শাড়ীর ডিজাইন হচ্ছে,ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সোনার পাতের ওপর ডিজাইন হচ্ছে,সব কলকাতায় এনে অ্যাসেম্বল করে তৈরী হবে মায়ের শাড়ী। কোথাও বা মন্ডপ সজ্জায় বিখ্যাত ডিজাইনার আর ভিড় সামলাতে কলকাতা পুলিশের হিমসিম অবস্থা। মফস্বলে এতটা না হলেও কিছু কিছু ঠাকুরের মন্ডপে ঢোকার উপায় থাকে না।

    দাদু বলেন,"কি জানি,আগের পুজোয় যেন প্রাণের সাড়া পাওয়া যেত,আজ এত হৈ চৈ,আলোর রোশনাই,লাখ লাখ টাকা খরচ করেও যেন সে আনন্দ মেলে না। তবুও কাশফুল ফোটে আগের মতই,সকালে সোনা রোদ্দুর পুজোর গন্ধ নিয়ে রোজ হাজিরা দেয়,জানান দেয় পুজো এসে গেছে। এত আড়ম্বর চারিদিকে তবু পথশিশু ছেঁড়া জামা গায়ে,রুক্ষ মাথায় হাত পেতে ঘুরে বেড়ায়। এই বৈষম্য যে বড় পীড়া দেয় দাদুভাই। অবশ্য বিভিন্ন সংস্থা এখন ওদের জন্য ভাবছে। কতটুকুই বা সে ভাবনা, হয়তো পুজোয় একটা নতুন জামা বা একবেলা ভরপেট খাওয়া। তারপর তো আবার তারা পথেই পড়ে থাকবে,আবার পুজো আসতে আসতে সে জামাও হবে শতচ্ছিন্ন।"

   "সেকালে প্রতিটি পাড়ায় কিছু অবস্থাপন্ন ব্যক্তি গরীব দুঃখীদের পুজোয় বস্ত্রদান করতেন,এখন আর তেমন দেখি না,সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত দাদুভাই,মানুষ এখন বড় স্বার্থপর হয়ে গেছে। যা করে আজকাল,কিছু সংস্থা। তখন পাড়ায় বাঁশের প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হলেই বাচ্চা ছেলেমেয়েরা সেই বাঁশ ধরে ঝুলে দোল খেত, তাদের যে পুজো তখনই শুরু হয়ে যেত। আজ বাচ্চারা আর বাড়ীর বাইরে খেলতে পায় কোথায়,খেলা তো সব কম্পিউটারে,মোবাইলে।"

    দাদু বলে চলেন,"এখন ঠাকুর উদ্বোধনেও কত ঘটা,বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের দিয়ে উদ্বোধন হচ্ছে,কোথাও বা মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করছেন। সবই আজকাল দেখনদারি। আগে পুজো সংখ্যার গানের বই বেরত, পাড়ায় পাড়ায় সেই গান বাজত,নতুন সে গান শোনার কত আগ্রহ ছিল সে তোর বাবা-পিসিদের আমলে। সে ছিল অমলিন আনন্দের দিন। আর সাহিত্য পত্রিকা তো ছিলই তবে এখন কদর অনেক কম,ছেলেমেয়েরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে বাংলা পড়ায় আগ্রহ কমে গেছে। তাছাড়া বিসর্জনেও এখন কত আড়ম্বর,সবই অত্যন্ত জাঁকজমক পূর্ণ। আগে বিসর্জনে সিদ্ধি খাবার চল ছিল এখন মদ্যপান করে পা টলমল করতে করতে ঠাকুর বিজয়া করা হয়। বিজয়াদশমীতে কলাপাতায় সিঁদুরগোলা দিয়ে খাগের কলমে করে শ্রীঁ শ্রীঁ দুর্গা সহায়,তিনবার করে লিখে তবে গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত ছোটরা।"

    বলতে বলতে দাদুর মুখটা করুণ দেখাল। সুপ্রিয় বুঝল দাদুর মধ্যে সেদিন হারানোর বেদনা রয়েছে। দাদুর শীর্ণ হাতের পরে হাত রেখে সে বলল,"দাদু দুঃখ কোরো না,যুগ বদলেছে,মানুষের মানসিকতা বদলেছে,এই নিয়েই মানুষ এখন খুশী,আমাদেরও সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে।"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational