প্রতিবাদ যখন জরুরী
প্রতিবাদ যখন জরুরী
কোয়েড কলেজের ভর্তি হবার কথা উঠতেই বাবার ভুরু কুঁচকে উঠলো । সোফায় বসে পেপার পড়তে পড়তে বাবা আমার দিকে মনোযোগ দিলেন এবার । হাতের ইশারায় আমাকে সামনের চেয়ারে বসতে নির্দেশ দিলেন । আমি জানি বাবা এবার আমাকে কোয়েড কলেজে না পড়ার জন্য একহাজার কারণ দেখাবে । তবুও বসলাম বাবার সামনে , বাবা একদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । আমি এবার বিরক্তই বোধ করছিলাম কারণ আজ শেষ ডেট এডমিশন করবার আর ঘড়িতে অলরেডি এগারোটা বাজে । বাবা কিছুক্ষণ নীরবে আমাকে জরিপ করে উঠে দাঁড়ালেন । আমার পাশেই এসে দাঁড়ালেন । বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ,
হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন , "ছেলে আর মেয়ে বন্ধু হতে পারে কিন্ত তারা অবশ্যই প্রেমে পড়বে । হয়তো খুবই অল্প সময়ের জন্য অথবা ভুল সময়ে । কিংবা খুবই দেরিতে , আর না হয় সব সময়ের জন্য । তবে প্রেমে তারা পড়বেই।"
শুধুই সুযোগের অপেক্ষা।আর তুমি কি চাও আমি যেচে সেই সুযোগ তোমাকে করে দেবো ? অমনি তুমিও আমার মুখে চুন কালি মাখিয়ে কোন বাজে অপদার্থ ছেলের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবে ?বাবা আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে স্বস্থানে এসে বসে পড়লেন । আমি বরাবরই গার্লস স্কুলে পড়েছি এবং আমার জীবনে পুরুষ বলতে আমার বাবা ও ভাই । কোন পুরুষ বন্ধু আমার হয়নি বা হওয়ার সুযোগ দেয়নি বাবা । এককথায় আমি অসূর্যস্পর্ষা নারী , আমার নাম অপলা রায় । বাবা নাম রেখেছেন এক মহিয়সী নারীর নামে অথচ আমি এক খাঁচায় বন্দি পাখি মাত্র । আমার মা ও আমার মতই বদ্ধ ঘরের গৃহকর্ত্রী । বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্ন এলেও আমি যেতে পারিনা কারণ বাবার যুক্তি বেশি বারমুখো হওয়া ভালো নয় । বিয়ে বাড়ি গেলে নাকি খারাপ কুনজর এসে পড়বে আমার উপরে । তবে এতদিন বাবার সব যুক্তি মানতে বাধ্য আমি আজ একটু বেশিই সাহসী । আমাকে এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে হলে বাবার মুখের উপর কথা বলতেই হবে । আমি এতক্ষন নীরব ছিলাম এখন গলা ঝেড়ে নিয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করতে ব্রতী হলাম । বললাম আমি কোয়েড কলেজে পুরুষ সঙ্গ করতে তো যাচ্ছি না বাবা , যাচ্ছি পড়তে । এই কলেজে আমার পছন্দের বিষয় গুলি আছে তাই আমি এখানে ভর্তি হতে চাই । তাছাড়া আমার উচ্চমাধ্যমিকে যা রেজাল্ট তাতে আমি এই কলেজে যখন চান্স পাচ্ছি অন্যত্র যাবো কেন ? শুধুমাত্র সেগুলো উইমেন্স কলেজ এই যুক্তিতে ? বাবা পুরুষ মানেই তো প্রেম নয় ? পুরুষ মানে বন্ধু ... পুরুষ মানে ভাই .... পুরুষ মানে একজন সঙ্গী । আমার জীবনে পুরুষ মানে তুমি , ভাই আর আমার ভবিষ্যত স্বামী কেনই বা হবে ?বাবা আমাকে ইশারায় থামিয়ে দিলো আবার ।বাবা বললো , ছেলে ও মেয়েতে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব অসম্ভব ও প্রকৃতি বিরুদ্ধ । কেননা শুধুমাত্র বন্ধুত্ব হলে প্রকৃতি নিজের অস্তিত্ব হারাবে। চুম্বক আর লোহা কখনো পাশাপাশি থাকতে পারে না। আকৃষ্ট করবেই। যদি কেউ তা এড়িয়ে যায় তবে সে ভণ্ডামি করছে নয়তো ধোঁকা দিচ্ছে ।
আগুনের পাশে মোম গলবেই। ছেলে ও মেয়ে বন্ধুত্ব হতে পারে , কিন্তু একসময় প্রেমে বা অবৈধ সম্পর্কে রুপ নিবেই। শুধুই সুযোগের অপেক্ষা।বাবার মান্ধাতা আমলের যুক্তিকে ভাঙা অসম্ভব হয়ত ছিল না কিন্তু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল । তাই কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে আসার জন্য বললাম , দিদিকেও তো নিজে দেখে বিয়ে দিয়েছিলে বাবা কি হলো ? তোমার নির্বাচন করা পুরুষ তো শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠেনি ? সে তো দিদিকে মেরেই দিলো প্রাণে । একটা মেয়েকে হারিয়েও তোমার টনক নড়েনি ? এখনো আমাকে বলির পাঠা বানাতে উদ্যোগ নিচ্ছ ? আমি আসছি এখন দেরি হয়ে যাচ্ছে ।বাবার জবাবের অপেক্ষা না করেই সেদিন বেরিয়ে এসে কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম । বিকালে বাড়ি ফিরে দেখলাম বাবার মুখটা বেশ হাসিখুশি যেমনটা তো হবার কথাই নয় ! এখন তো বাবার মুখ ভার হওয়া দরকার ছিল ! আমার দিদির হন্তা যে লোকটা সে এসেছে বাবার কাছে । বাবা বেশ রসিয়ে রসিয়ে গল্প করছে জামাইয় সুনীলের সাথে । মানে গল্পের টপিক এমনি যে বাবা মেয়ের খুনির সামনে সাচন্দ্য বোধ করছেন । আমি ঐ সুনীলকে দুচক্ষে সহ্য করতে পারিনা । নেহাত সেদিন বাবা পাল্টি খেয়ে বলেছিল আমার মেয়ে নিজেই মরেছে সুনীলের দোষ নেই ... আমি বাবার উপরে কিছু বলতে পারিনি সেদিন । নিজের ঘরে টপ করে ঢুকে গেলাম । কিছুক্ষণ পর মা আমার ঘরে এসে বললো বাবা আমাকে ডাকছে । বাধ্য হয়ে বাবার কাছে গেলাম তখনো ওই সুনীল বর্তমান। বাবা একটা অপ্রত্যাশিত কথা আমাকে বললো , যেটা শুনে নিজের কানকেও কিছুক্ষণ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । বাবা আমাকে বললো , সুনীল বলছে একা একা তো জীবনটা কাটানো শক্ত । তাই তুই যদি সম্মতি দিস তা হলে আমি তোর আর সুনীলের চার হাত এক করে নিশ্চিন্ত হই ।বাবা আরো কিছু বলেছিল তখন আমার কান দুটো শুনতে পায়নি কথা গুলো । আমি তখন ধপ করে মাটিতে বসে গেছি । সুনীল আমাকে তাড়াতাড়ি ওঠাতে এলে তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত নাকচ করে আমি উঠে দাঁড়ালাম । আমার মাথাটা তখন টলছে কিন্তু এখন সময় দুর্বল হবার নয় ।
এখন সময় দিদি যেটা পারেনি সেটা করে দেখাবার । নিয়ম আর রীতিনীতির বেড়াজাল ভাঙা দিদির অসম্ভব মনে হয়েছিল বলেই দিদিকে মরতে হয়েছিল অসময়ে । আমাকে নিজেকে সসম্মানে বাঁচাতে দিদির সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে । আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম সুনীলের দিকে । ও একটু নড়ে বসলো মনে হয় । চিৎকার করে সুনীলকে বললাম জাস্ট গেট আউট ইউ ব্লাডি রাস্কেল । না গেলে আমি দিদির সেইসব চিঠি পুলিশকে দিয়ে দেবো যেগুলো আজ পর্যন্ত বাবার জন্য না দেওয়ায় তুমি জেলের বাইরের হওয়া খাচ্ছ । সুনীল দিদির চিঠির কথা শুনে ঘেমে উঠেছে মুহূর্তে । আমার রনচন্ডী রূপ দেখে বদমাশটা ততক্ষণে বুঝে গেছে আমি এখন প্রচণ্ড সাহসী হয়ে উঠেছি । সুনীল চুপচাপ বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে । এই মধ্য বাবা অনেক বকবক করেছে যদিও আমি কান দিনি সেসব কথায় । আপদ গেছে এবার বাবাকে নিয়ে পড়লাম । বাবাকে বললাম তুমি শিক্ষিত , মানুষ হিসেবেও খারাপ নয় কিন্তু তুমি মধ্যযুগীয় কালচার নিয়ে বাঁচতে চাও । আর এতে আমি বা মা , দিদি তোমাকে প্রশ্রয় দিয়ে তোমার স্বভাব আরো নষ্ট করেছি প্রতিবাদ না করে । আর না বাবা , তুমি বললে আমি জলে ডুবে মরবো কিন্তু ওই সুনীল যার হাতে আমার দিদির রক্ত লেগে আছে ওকে বিয়ে করবো না । আমাকে আমার মতো বাঁচতে দাও । আমি নিজের সিধান্ত নিজে নিতে সক্ষম । এখন নারী চাঁদে যাচ্ছে , সে ও সেইসব কাজ করছে যা একদিন কেবলমাত্র পুরুষ করত । কিছুই অসম্ভব নয় বাবা , দরকার সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির । বাবা কিছুই বললো না উত্তরে নিজের ঘরে ঢুকে গেল । আমি ও কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেলাম । তারপর অনেক দিন বাবা আমার সঙ্গে কথা বলেনি । ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়েও গেল । একটা জিনিস বদলে গেল ওই ঘটনার পর , বাবার মধ্য কিছুটা পরিবর্তন এসেছে । বাবা আমার উপরে কোনদিন কিছু চাপিয়ে দিতে আসেনি তারপর থেকে ।

