প্রথম প্রেম
প্রথম প্রেম


প্রেম ভালোবাসা কখন কী ভাবে আসবে, এটা বলা খুব শক্ত। ঈশ্বরের অপার সৃষ্টিতে প্রেমের স্থান বরাবরই অন্য মাত্রা পেয়েছে বিভিন্নভাবে। ছোটবেলায় রূপকথায় সেইসব প্রেমের কাহিনী শুনতে শুনতে অন্য রাজত্বে বিচরণ করতাম। প্রেমের সম্বন্ধে অন্য ধরণা জন্মেছিল তখন থেকেই।
ছেলেবেলা কেটেছে উত্তর বিহারের কাটিহার নামক এক শহরে। বাবার কর্মসূত্রে সেখানে থাকা আরকি। নিজেদের বিদ্যালয় শুধুমাত্র ছেলেদের হওয়ায় সেরকম ক'রে আলাদা কোনো অনুভূতি মনের চিলেকোঠায় জায়গা পায়নি। তার উপর রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত বিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে বেড়ে ওঠা।
যেটুকু অবকাশ বাইরের পারিপার্শ্বিক জগতে বেড়ে ওঠা, সেটা সর্বান্তকরণে ঘটেছিল খেলার মাঠে।
আমার ছেলেবেলার ধ্যানজ্ঞানই ছিল মাঠ কেন্দ্রিক। তাই ছেলেবেলায় প্রেমের বিশেষ অবকাশ ঘটেনি আমার জীবনে সেভাবে।
মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ ক'রে চলে এসেছিলাম সুদূর কাটিহার শহর থেকে কলকাতায় পড়তে। কারণ, কলকাতার পড়াশোনার সুযোগ-সুবিধা ও মানও অনেক বেশি উন্নত ছিল মফস্বলের শহরের থেকে। যথারীতি ভর্তি হলাম স্বপ্নের কলেজ স্কটিশ চার্চে। নিজেকে সেদিন থেকেই অন্য রকম ভাবতে শুরু করলাম। ইচ্ছেডানায় ভর দিয়ে সেদিনই মেঘপিওনের রাজত্বে ভাসতে শুরু করলাম....
সেই শুরু প্রেমের ভেলাতে ভাসার প্রথম পদক্ষেপ। কো-এডুকেশনাল কলেজে পড়ার সুবাদে মেয়েদের সাথে সখ্যতার প্রথম পাঠ। বিভিন্ন ধরনের মেয়েদের সাথে আলাপ হলো প্রথমদিনেই। কিন্তু আমি বড্ড বেরসিক এই ব্যাপারে! কারণটা অবশ্যই আমার পুরাতন ইতিহাস, সেরকম ভাবে মেয়েদের সাথে মেলামেশার অভ্যাসটা গড়ে না ওঠায় বড্ড মুখচোরা এক কিশোর ছিলাম আমি। মেয়েদের সাথে কথা বলতে গিয়ে কম্পন ধরত আরকি! ইতস্ততভাবে এদিক ওদিক ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎই একটি মেয়ে আমার দিকেই হনহন ক'রে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, "ইলেভেনের বিজ্ঞানের ক্লাসটা কোন দিকে বলতে পারবেন?" আমি হতচকিত হ'য়ে আবেশের বশে ব'লে ফেললাম, "আমিও তো একই ক্লাসের, চলুন আমার সাথে, আমি তো যাচ্ছি ওখানেই।"
সেই শুরু, প্রথম দর্শনেই একটা অন্য অনুভূতি কাজ করছিল। বুকের মধ্যে কেমন ড্রাম বাজানোর আওয়াজ! মনে হচ্ছিল আমি যেন হারিয়ে যাচ্ছি মেঘপিওনের দেশে! কেন এরকম অনুরণন হচ্ছে মনের ভিতর, বুঝেই উঠতে পারছিলাম না। সেদিনই মেয়েটিও সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল আমার মনের কথা!
কারণ, তারপর আর একটি কথাও না বাড়িয়ে হনহন ক'রে ক্লাসে গিয়ে বসে পড়ল একেবারে প্রথম দিকের আসনে। আমিও আমার অন্যান্য সহপাঠীদের নিয়ে পিছনের দিকে আসন গ্রহণ করলাম।
সবাই কত কিছু আলোচনা করছে নিজেদের মধ্যে, আমার তো কোনো কিছুতেই মন নেই। সেই মনের ভিতর ড্রাম পেটানোর শব্দ! কেন এরকম হচ্ছিল, কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। বেশ কয়েকবার তো উঠে গিয়ে সামনের দিকে হেঁটেও আসলাম, যাতে সেই সুন্দর প্রশান্তির মুখখানি দেখতে পাই! বারবার মনে হচ্ছিল এই সেই মেয়েটি, যার জন্য এতকাল কারোর দিকে দৃষ্টিপাত করিনি ঘুণাক্ষরেও। মেয়েটিও কেমন অপলক দৃষ্টিতে আমার অশান্ত মনের নৈর্ব্যক্তিক কথা হয়তো পড়তে পেরেছিল সেদিনই।
প্রেমের বন্ধনে জড়িয়ে পড়া কোনো সংজ্ঞা অনুসারে হয় না; এই কথাটির বাস্তবতা সেইদিনই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু একথা চিরসত্য যে তারপর থেকে কেউ কোনোদিন একে অপরের সাথে সম্মুখ আলাপ করিনি। টানা দু'টি বছর শুধু অব্যক্ত অভিলাষ, প্রেম মনের দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম। দু'জনেই জানতাম একে অপরকে অসম্ভব ভালোবাসি, নিজেদের দৃষ্টি বিনিময় না হ'লে শান্তি পেতাম না প্রতিটি ঘণ্টায়। কিন্তু সেই নীরব প্রেমের কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না। না ছিল প্রেমের অন্য স্বাদ!
বেশ বুঝতে পারতাম ও কিছু বলতে চায় আমায়। আমিও কিছু বলতে চাই ওকে। কিন্তু একটা অলিখিত প্রাচীর গড়ে উঠেছিল দুজনের মধ্যে সম্মুখ আলাপ না হওয়ার! বিধাতা হয়তো চাননি এই প্রেমের গভীরতা আরও বাড়ুক! কিন্তু দু'জনেই দু'জনের প্রেমে পাগল, এটা বেশ বুঝতে পারছিলাম উত্তরোত্তর।
আশঙ্কা বাড়ছিল ক্লাস টুয়েলভের পর যদি এক কলেজে না পড়ি! আর ওর তো ঠিকানা বা ফোন নম্বর আমার কাছে নেই! তাহলে তো চিরতরে বিচ্ছেদ! অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু অব্যক্ত প্রেমের। বিধাতার লিখন হয়তো এটাই ছিল।
ঘটলও তাই। বারো ক্লাসের পর দু'জনেই আর স্কটিশ চার্চে পড়িনি। আর দেখাও হয়নি একটি দিনও তারপর....
আজও প্রতীক্ষায় থাকি যদি ফিরে পাই সেই প্রথম প্রেমের মেয়েটিকে! একটিবার অন্তত চিৎকার ক'রে বলব, "তুমি আমার প্রথম প্রেম, তুমিই আমার শেষ প্রেম।বাকিটা প্রেমহীন ভালোবাসা।"