প্রস্ফুটন:-
প্রস্ফুটন:-
ঘড়িতে তখন সকাল ৯ টা, ধড়ফড় করে উঠে বসে তুহিনা। মনে মনে গজগজ করতে করতে বলতে লাগলো,
"এত বেলা হয়ে গেলো, কেউ ডাকলো না। অ্যালার্মটা বন্ধ করে কখন যে আবার ঘুমিয়ে পরলাম, ইশশশ...দেরি হয়ে গেল অনেক।"
তড়িঘড়ি করে ড্রইং রুমে এসে দেখে কুন্তল (তুহিনার বর) পত্রিকার ভেতরে ৮০ শতাংশ ডুবে আছে, সৃষ্টি (তুহিনার কন্যা) ডোরেমন কার্টুন দেখতে ব্যস্ত আর তুহিনার শ্বশুরমশাই দীপকবাবু কিছু কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছেন।
তুহিনা দেখলো কারোর কোনো হুস নেই সকাল ৯ টা যে বেজে গেলো। মনে মনে বিরক্ত হয়ে কুন্তলকে ডেকে বললো, "বলি তোমার কি মাথা বিগড়েছে?"
তুহিনার কথায় অবাক হয়ে কুন্তল, সৃষ্টি আর দীপকবাবু তুহিনার দিকে চাইতেই তুহিনা আবার শুরু করলো, "আরে আমায় না দেখে ঘড়িটা দেখো না! ৯ টা তো বেজে গেলো, অফিস যাবে কখন আর সৃষ্টি তুই কি বসে বসে টি.ভি দেখছিস, স্কুলে যাবি না?"
সৃষ্টি ঝট করে বলে বসলো, "মা, তোমার মাথা বিগড়েছে, বাবার নয়"।
তুহিনা চোখ রাঙিয়ে সৃষ্টিকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, দীপক বাবু বলে ওঠলেন, "এমনি করে মাকে বলতে নেই দাদুভাই। কিন্তু বৌমা, আজকে তো রবিবার, তুমি ভুলে গেছো নাকি?"
তুহিনা নিজের কথায় নিজেই লজ্জা পেয়ে বলে উঠলো, "ওহ হ্যাঁ, তাই তো.... ভুলেই গেছি"।
সৃষ্টি আদর আদর কন্ঠে বললো, "এ জন্যেই তো তোমায় ডাকিনি মা, একটা দিন একটু বেশিক্ষন না হয় ঘুমোলে"।
তুহিনা খুব নরম স্বরে সৃষ্টির মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বললো, "হ্যাঁ রে মা, আমি ভুলেই গেছিলাম। বাবা, কুন্তল তোমরা বসো আমি ঝট করে চা বানিয়ে নিয়ে আসি।"
তুহিনা উঠতে যাচ্ছে তখনই কুন্তল বলে উঠলো, "তুমি কি বুঝবে তুহিনা রবিবারের মর্ম, তোমার জন্যে তো প্রত্যেক দিনই থোর বড়ি খাড়া:খাড়া বড়ি থোর। সারাদিন, সারা সপ্তাহ তো আছো শুধু ঘর আর ঘরোয়া কাজ নিয়েই।"
কুন্তলের বলা কথাগুলি বারবার ঘুরে ফিরে আসছে তুহিনার মনে, অন্যমনস্ক ভাবে ভাবতে লাগলো বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে আসার পরই শ্বাশুড়িমা নিজেই তুহিনার হাতে সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন, সেই থেকে তুহিনা থাকতে বাড়িতে কাউকে কিচ্ছুটি নিয়ে ভাবতে হতো না। সংসারের সর্বেসর্বা তখন তুহিনাই। অতিথি আপ্যায়নে, পুজো পার্বণে, বাড়ির মাথা তখন তুহিনা, শ্বাশুড়িমাও নিশ্চিন্ত ছিলেন যে তুহিনা সবকিছুই সামলাতে শিখে গেছে নিপুণ ভাবে। শ্বাশুড়িমা গত হয়েছেন অনেকদিন কিন্তু তুহিনা কবে যে পুরো দস্তুর গিন্নি হয়ে উঠলো তা বোধকরি নিজেও জানে না।
হঠাৎ চা উথলে উঠছে দেখতে পেয়ে ভাবনার জাল ছিঁড়ে আবার বর্তমানে পদার্পণ তুহিনার।
এর মধ্যে কেটে গেছে বেশ কিছু দিন, হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলায় তুহিনার মোবাইলে এক অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে।
- তুহিনা বলছিস?
- হ্যাঁ, আমি তুহিনা। আপনি?
- এই বাঁদর মেয়েছেলে তুই আমায় চিনলি না? রাক্ষুসী, পেত্নী আমি জাগৃতি বলছি রে।
- হ্যাঁ, তুই???? তোকে কত খুঁজেছি ফেইসবুকে, পাইনি। তোর মোবাইল নাম্বার তো নেই, তাই তোর বাড়িতে ফোন করেছিলাম, কিন্তু সেখানেও আশাহত উত্তর পেয়েছি যে ওটা আর জাগৃতিদের নাম্বার নয়। বেল্লিক মেয়ে আমায় ধমকাচ্ছিস? নিজেই ভুলে বসে রয়েছিস আমায়।
- হা হা হা.... না রে ভুলিনি। আর হ্যাঁ, ওই ফেসবুক টুক করার সময় পাচ্ছি না ভাই, আর বাবার বাড়ির ল্যান্ড লাইন নাম্বার চেঞ্জ হয়ে গেছে রে। আমার সাথে হঠাৎ একদিন চৈতীর দেখা, চৈতীর কাছ থেকেই তোর নাম্বার নিয়ে তোকে ফোন করছি।
- ওহ! তাই বল। চৈতীর সাথে আমার যোগাযোগ আছে বৈকি। একদিন আয় না আমাদের এখানে।
- আসবো, খুব শিগগিরই আসবো। আচ্ছা শোন যে কারণে ফোন করা। আমাদের স্কুলে পুনর্মিলন উৎসব হচ্ছে জানিস তো?
- হ্যাঁ, জানি তো... চৈতীই বলেছে।
- হ্যাঁ, তো জানিস যখন তাহলে প্রস্তুতি নে।
- আর
ে ধুর গাধা! এতে প্রস্তুতি নেওয়ার কি আছে? স্কুলে যাবো, সকলের সাথে দেখা করবো আর ফিরে আসবো, এতে আবার প্রস্তুতি নেবো কি রে??
- না রে গাধী। শুধু দেখা করলে তো চলবে না! তুই, চৈতী আর আমি রবীন্দ্র নৃত্য পরিবেশন করবো পুনর্মিলন উৎসবে, আর এই রবিবারে আমি ও চৈতী আসবো তোর বাড়ি, এসে বাকি কথা হবে। আপাতত তুই গিন্নিগিরি ছেড়ে নাচটা প্র্যাক্টিস করতে হবে সে কথা ভাব। বুঝলি? চল রাখছি।
জাগৃতির সাথে কথা হওয়ার পর তুহিনা আয়নায় আপাদমস্তক নিজেকে একবার দেখে নিল। নিজের মনে নিজেই বিড়বিড় করতে লাগলো, "জাগু একটা পাগলী, আমি এই হোঁৎকা শরীর নিয়ে নাচবো! এই তো আমার প্রকান্ড এক ভুঁড়ি, এই ভুঁড়ি নিয়ে নাচাকোঁদা কি সম্ভব, তাও সকলের সামনে? না না কিছুতেই না! নিজেকে হাসির খোরাক বানাবো নাকি? একদম না! নাচ ছেড়ে দিয়েছি প্রায় ৯ বছর হতে চললো, আর ম্যাডাম বলছেন নাচবেন আমার সাথে। পুরো পাগলামি আর ভীমরতি এই বয়সে"।
তখুনি হঠাৎ কুন্তল ঢুকলো ঘরে, "কি গো কি বিড়বিড় করছো আর কে ফোন করেছিল বললে না তো??!!"
তুহিনা বললো, "আমার স্কুলের এক বান্ধবী গো, একসাথে স্কুল আর কলেজে পড়তাম। বিয়ের পর আর তেমন যোগাযোগ ছিল না, তা জাগৃতিই ফোনটা করেছিল। তোমায় বলেছিলাম না আমাদের স্কুলের পুনর্মিলন উৎসব। তা জাগৃতি বলছে নৃত্য পরিবেশন করবে, বলছে আমিও যেন তাদের সাথে যোগ দেই রবীন্দ্রনৃত্য উপস্থাপনায়..."
তুহিনার কথা শেষ হওয়ার আগেই কুন্তল বলে উঠলো, "সে তো ভালো কথা, তোমার কি কি লাগবে নাচের জন্য আমায় বলে দিও শুধু, সৃষ্টির জন্মের পর থেকে তো তুমি নাচ ছেড়েই দিয়েছ। কতো বলেছি নতুন করে শুরু করতে, কিন্তু তুমি কোনো কথা কানেই তুললে না, এই সুযোগটা ছেড়ে দিও না তুহি, সৃষ্টি এখন অনেকটা বড় হয়ে গেছে"।
তুহিনা বিরক্ত হতে বললো, "আহ্ কুন্তল, কি যে বলো না! আমি নাচবো না। আর সময় কোথায় প্র্যাকটিসের? বাবার যত্ন-আত্তি, সৃষ্টির পড়ালেখা, তোমার...",
"আমার কিছু না, এইসব এক্সকিউজ দেওয়া বন্ধ করো তুহি। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে, তুমি শুধু হ্যাঁ বলো।"
তুহিনা কুন্তলের উপর চটে গিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে হেঁসেল সামলাতে রওনা হয়ে গেলো। রবিবার দিন সন্ধ্যাবেলায় চৈতী আর জাগৃতি উপস্থিত তুহিনাদের বাড়িতে, পুরনো বান্ধবীকে পেয়ে চোখ ছলছল... কিছু এদিক ওদিকের কথার পর জাগৃতিই শুরু করলো, "তা কুন্তল বাবু, মেসোমশাই, আমি চাইছিলাম আমাদের সাথে তুহিনাও নৃত্য পরিবেশনে অংশ নিক।"
দীপক বাবু বলেন, "এতো অতি উত্তম প্রস্তাব। বৌমা তোমায় কিন্তু স্কুল অ্যালুমনী ফেস্টে রবীন্দ্রনৃত্য পরিবেশন করতেই হবে। তোমার হয়ে আমি কথা দিয়ে দিলাম কিন্তু"।
তুহিনা চিন্তান্বিত হয়ে উত্তরে বললো, "কিন্তু বাবা"...
"কোনো কিন্তু নয়, প্র্যাকটিস শুরু করে দাও এবার বৌমা। কুন্তলকে প্রমাণ করে দাও যে তুমি এই ঘর সংসারেই নিজেকে আবদ্ধ করতে রাখতে চাও না, তুমিও বাইরের জগতে তালে তাল মিলিয়ে চলতে পারো"।
শুরু হয় গেলো পুরোদমে প্র্যাকটিস। প্রাথমিক অসুবিধা একটু হতো বটেই ভারী শরীর নিয়ে নাচের মুদ্রাগুলো করতে, কিন্তু থামলে যে চলবে না তুহিনার, স্বয়ং শ্বশুরমশাই কথা দিয়ে দিয়েছেন তুহিনার হয়ে। হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসটা আবার ফিরে পাচ্ছে সে।
এসে গেল সেই কাঙ্খিত দিন, পুরো স্কুল প্রাঙ্গণ আর অডিটোরিয়াম তখন মিলনকেন্দ্র। পুরোনো সহপাঠী, শিক্ষক শিক্ষিকাদের নিয়ে নবীন ও প্রবীণের সমাগমে মুখরিত এক উৎসব। যথা সময়ে নৃত্যানুষ্ঠান শুরুর ঘোষণা হয়। তুহিনা মঞ্চ থেকে দেখছে সারি সারি চোখ তুহিনা, চৈতী আর জাগৃতির দিকে।
ক্ষনিকের মধ্যেই একটি সিদ্ধান্ত নেয় তুহিনা যে, "নিয়ম করে এখন নাচটা শুরু করবো, শুরু করবো নৃত্য প্রশিক্ষণও। চার দেওয়ালে বদ্ধ করে রাখবোনা নিজেকে আর নিজের প্রতিভাকে, কন্যারত্নটিকেও তালিম দেবো নাচের। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে নাচবে আমার সৃষ্টিও।"