পরম্পরা যখন শত্রু
পরম্পরা যখন শত্রু


গ্ৰামের শেষ প্রান্তে বেশ বড় তিন মহলা বাড়িটা গ্ৰাম প্রধানের। তার ঠিক পাশের কাঠের কোঠা বাড়িটা মাষ্টার বাবুর। নেপালের সীমান্তে পাহাড়ের কোলে ভারতের শেষ গ্ৰামের ছবি। মাঝে মাঝেই বয়ে আসে উত্তরের হিমেল হাওয়া। শীত এসেও আসেনি এখনো। পাতলা কুয়াশার পর্দা ভেদ করে দেখা যায় প্রধানের বাড়ির পেছনে বাগানের ধারে একটা মাটির ঘর। থেকে থেকেই ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে এক অসহ্য চিৎকার। গ্ৰাম প্রধানের ছোট ছেলের বৌ সরিতার প্রসব বেদনা উঠেছে সেই বিকেলে। এ বংশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ভেঙ্গে মেয়ে-বৌদের এখনো হাসপাতালে নেওয়া হয় না। ঐ মাটির অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটি আঁতুড়ঘর। ওখানেই জন্মায় বংশের কুলপ্রদীপেরা।গ্ৰাম প্রধান ধরমবীর সিং এর তিন পুত্র পরম, বিনয় আর আকাশের জন্ম হয়েছে ঐ ঘরেই। পরমের দুই ছেলে আর বিনয়ের একটি ছেলেও চোখ মেলেছে ঐ মাটির ঘরে। আকাশের বৌ সরিতা এই নিয়ে তৃতীয় বার প্রবেশ করেছে ঐ আঁতুড়ঘরে।
ঘরের বাইরে বড় উনুনে মাটির গামলাতে জ্বাল দেওয়া হচ্ছে দুধ। হ্যাঁ, যখনি এ বাড়ির মেয়ে বৌদের প্রসব বেদনা ওঠে ঐ উনুনে বড় গামলাতে দুধ জ্বাল হয়। এর একটি তাৎপর্য রয়েছে।
ধরমবীর সিংদের বংশে মেয়ে নেই বললেই চলে। এবাড়ির বউদের পুত্র সন্তানের জন্ম দিতেই হবে।
ঘরের ভেতর মাত্র উনিশ বছরের সরিতাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে দুই মাঝ বয়সী দাই। মেয়েটা প্রতিবার এমন কষ্ট পায়। কপালটাই মন্দ। যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া সরিতার মাথায় হাত বুলিয়ে ধাইমা বলে,
''আউর থোরা জোর লাগা বিটিয়া। দেখ ইশবার ভগবান তেরা জরুর শুনেগা।"
সরিতার দু চোখে জলের ধারা। শরীরের সব শক্তি একত্রিত করে ও চাপ দেয়।
একটা ক্ষীণ চিৎকার। তারপরেই এলিয়ে পড়ে মেয়েটা। ওর দুই থাইয়ের মাঝখানে যে সদ্যজাত নরম রক্ত মাংসের দলাটা চিৎকার করে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে তা ছেলে না মেয়ে জানতেও পারল না এমনি অভাগী মা ও। ছোট ধাই মা তাড়াতাড়ি কোলে তুলে কাপড়ে জড়িয়ে নেয় শিশুকে। বড় ধাইমা সাবধানে নাই কাটে। কিন্তু শিশুর জননাঙ্গ দেখে দু জনেই থমকে যায়। ছোট্ট আঙুরের মতো লিঙ্গর বদলে আবার সেই চেড়া গর্ত। এই নিয়ে তিনবার কন্যা সন্তানের জন্ম দিল সরিতা। বাচ্চাটার এক মাথা কোঁঁকড়া চুল, ফর্সা রং, টিকালো নাক, টানা চোখ এ যেন দেব শিশু। ছোট ধাইমা বুকে জড়িয়ে বলে,
''এ পাপ ওউর হাম সে না হোগা। ইসে তু সামহাল।''
বড় ধাইমার ভ্রু-তে ভাঁজ। ওদিকে শিশুর আওয়াজে দরজার বাইরে চাঞ্চল্য শুরু হয়েছে। ধরমবীর সিং নিজে দাঁড়িয়ে রয়েছেন পাহারায়। দুই ধাইমা সরিতাকে দেখে আবার। জ্ঞানহীন মেয়েটার এখনি শুশ্রুষা প্রয়োজন। ওদিকে শিশুটা ধাইমার বুকের ওম পেয়ে নিজের আঙ্গুল মুখে পুরে চুষে চলেছে একমনে।
কিন্তু এই বংশের ঐতিহ্য মেনে এই শিশু কন্যাকে এখন ফেলে দিতে হবে ঐ দুধের
গামলায়। এ বংশে মেয়েদের এই পরিণতি। সিং বংশে মেয়েদের দুধের গামলায় চুবিয়েই শেষ করা হয়। সরিতার আগের দুই মেয়ে ওর দুই জেঠানির মেয়েদের এই গতি হয়েছে। কিন্তু ধাইমা দুজন এই পাপ করতে করতে কাহিল।
হঠাৎ বাইরে একটা নতুন গলার আওয়াজ শোনা যায়। মাষ্টারের মেয়ে জায়া সদ্য ডাক্তারি পাশ করে গ্ৰামে ফিরেছে। পাশের টাউনের হাসপাতালে চাকরি পেয়েছে। ছুটির দিন বিনা পয়সায় গ্ৰামের রোগী দেখে জায়া।
''পেয়রিপনা তাউজি, ভাবি কো একবার দেখনে আই হু।''
জায়া এর আগেও সরিতাকে জোর করে দেখে গেছে কয়েকবার। ও ডেলিভারিও করতে চেয়েছিল। কিন্তু ধরমবীর রাজি হয়নি।
জায়া আঁতুড়ের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে কেউ বাধা দেওয়ার আগেই।
কয়েক সেকেণ্ডেই দৃশ্য বদলে যায় । মাষ্টার গ্ৰামের আরো পাঁচ জনকে নিয়ে হাজির হয়। সিংজি বিরক্ত হলেও বলতে পারে না কিছুই।
হঠাৎ দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসে জায়া, কোলে সদ্যজাত শিশু পুটলিতে জড়ানো। পেছনে সরিতাকে নিয়ে দুই ধাই।
''তাউজি, ভাবি ওর বেবি দোনো কো হাসপাতাল লে যা রহি হু। তবিয়ত ঠিক নেহি হ্যাঁ দোনো কা।''
ঝড়ের মত বেরিয়ে যায় মেয়েটা।বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়েই ছিল ওর। সিং জি বা বাড়ির কেউ কিছু বলার আগেই ওরা বেরিয়ে যায়।
টনক নড়তেই সিং জি বলে,
''লেকিন ছোড়া কি ছোড়ি ? কা হুয়া?''
সবাই চুপ।
তাড়াতাড়ি গাড়ি বার করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ধরমবীর সিং।
ততক্ষণে জায়া সদ্যজাত ও মা-কে ভর্তি করিয়ে নিয়েছে। সিং জি আসতেই সবাই ঘিরে ধরে।
'' লছমী আই হ্যায় ঘরমে প্রধানজি। পহলা লছমী আপকে ঘর।"
ক্লান্ত সরিতা মেয়েকে পাশে নিয়ে শোওয়া।
প্রধান অবাক হয়ে দেখে, দুটো ফর্সা হাত মুখে ভরে চুষছে শিশু। পুতুলের মত বাচ্চাটাকে একটু আগেই দুধে ফেলে মারার কথা ছিল। কিন্তু কই, এখন তো আর রাগ হচ্ছে না!
অনেকগুলো নাতির মাঝে না হয় ছোট বৌয়ের এই মেয়েটিও বড় হবে। দিন তো বদলাচ্ছে!পরম্পরাও বদলাবে এভাবেই।
পাশে এসে দাঁড়ায় জায়া। বলে,
''দেখিয়ে তাউজি, কেইসি মুসকুরা রাহি হ্যায় আপকা গুড়িয়া। আব তো খুশ হো যাইয়ে।''
জায়ার মাথায় হাত দিয়ে প্রধান বলে,
''তুনে মেরা আঁখে খোল দি আজ। নেহিতো আজ ফিরসে এক পাপ হো যাতা।''
বাড়ি ফিরেই আঁতুড় ঘর ও উনান ভাঙার হুকুম দেয় গ্ৰাম প্রধান। বলেন,
''আব গাও মে ডকটরনী হ্যায় তো ইস সবকি কা জরুরত? আবসে সব হাসপাতাল হি জায়গা।''
বাড়ির বাকি মহিলাদের মুখেও হাসি ফোটে এই প্রথম। এত দিনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির খোলস ছেড়ে অবশেষে বের হতে পেরেছে গ্ৰাম প্রধান।সত্যিই লছমী এসেছে এতদিনে।
(সমাপ্ত)