প্রিয় অসম্পূর্ণতা (পর্ব ৫)
প্রিয় অসম্পূর্ণতা (পর্ব ৫)
রচনা : উশ্রী ও তিতির
অজ্ঞাত ডেরা (পরের দিন) :
------------------‐---------------------
আঙুলটা একটু নড়ে ওঠে সুর-এর... ধীরে ধীরে চোখ মেলে চায় সে- সবকিছু আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়... দিন না রাত বুঝতে পারে না সে... বুকের তীব্র যন্ত্রণা আর অপারেশনের ধকলে কথা বলার মতো ক্ষমতা সঞ্চয় করতে পারে না সে... মনিটরের বিপ বিপ শব্দ ছাড়াও কিছু কথোপকথনের আওয়াজ তার কানে আসে... সেই আওয়াজ অনুসরণ করে সে দেখে একজন ডক্টর আর একজন পুলিশ জানলার বাইরে দিকে তাকিয়ে কথা বলছে...
পুলিশ : সুর-কে নিয়ে চিন্তা করছিস !!
ডক্টর : সেটাই কি স্বাভাবিক নয় সূর্য !! বিগত পনেরো বছরে ধরে যে আমার অন্তরে, বাইরে- সবটা জুড়ে আছে... যে আমার প্রতিটা মূহুর্তের সাথে অঙ্গাঙ্গিকভাবে মিশে আছে... কোনো একটা ক্ষণ নেই, যখন আমি ওকে নিয়ে ভাবি করি নি... সেই সুর আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে... আমার... এই... এই হাতে লুটিয়ে পড়ল...
সূর্য : সেই সুর-এর অপারেশন তো নিজের হাতে করলি... আমি তো ভাবতেই পারছি না, সুর অপারেশন টেবিলে শুয়ে আর তুই ছুরি কাঁচি ধরেছিস... এখনো ভাবতে পারছি না, বিশ্বাস কর... জানি, এই মূহুর্তে কলকাতায় ডক্টর উত্তীয় বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সমতুল্য Surgeon আর কেউ নেই... তাও... অপারেশন টেবিলে তো তখন তার আজীবনের অব্যক্ত ভালোবাসা জীবন মরণ লড়াই লড়ছিল....
সুর-এর শ্বাস ক্রমাগত ঘন হতে থাকে.... চাদর আঁকড়ে ধরে সুর, চোখ থেকে অঝোর শ্রাবণ নেমে আসে- কি শুনছে সে এইসব !!!
উত্তীয় : কি করতাম !!! ওরা এইটুকু জানে, সুর আহত... ওরা সবার আগে হাসপাতাল, নার্সিংহোম-গুলোতে সুর-কে খুঁজতো... সুর-এর হাতে তখন সময় ফুরিয়ে আসছিল... এত Bleeding, এত Bleeding হচ্ছিল যে ওর ঠিক করে শ্বাস নিতে পারছিল না... আমার... আমার চোখের সামনে শ্বাসকষ্টে ছটফট করছিল... আমি... আমি নিজে একজন Surgeon হয়ে ওকে মরতে দিতাম !!!
সূর্য : (উত্তীয়-র কাঁধে হাত রেখে) সব বুঝলাম... কিন্তু যা করবি, একটু ভেবে-চিন্তে করিস... আর একটা কথা মনে রাখিস, সুর-কে আসন্ন বিপদ থেকে আড়াল করতে গিয়ে তুই কিন্তু এখন একজন Kidnapper... একবার যদি পুলিশের খাতায় তোর নামটা ওঠে, তোর কিন্তু বিদেশ যাওয়াটা... তোর এতদিনের Research-এর স্বপ্নটা কিন্তু...
উত্তীয় : সুর আমার কাছে আমার স্বপ্ন, আমার স্বত্বার থেকে অনেক বেশি দামী... হাসছিস কেন ওমনি বিচ্ছিরিভাবে...
সূর্য : এই একটা বিষয়ে, তোর আর সুর-এর মধ্যে ভয়ঙ্কর মিল জানিস তো... তোরা দু'জনেই ভালোবাসায় অন্ধ... সুর ওই দৈবিক ছাড়া এখনো কিছুই দেখতে পায় না, আর তুই সুর-কে ছাড়া... আচ্ছা, তোর ভালোবাসা কি চিরকাল এইরকম অসম্পূর্ণই থেকে যাবে !!! চিরটা কাল সুর-কে এইভাবে দূর থেকে ভালোবেসে যাবি, কিন্তু মেয়েটা কোনোদিন কিছু জানতে পারবে না !!! তোর ভালোবাসা কোনোদিন বিচার পাবে না- তাই না !!! একবার সুর-কে বলেই দেখ না- বাকিটা ওর বিবেচনার ওপর ছেড়ে দে... হতেও তো পারে, তোর ভালোবাসা ওকে ওর ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবে...
উত্তীয় : নাহহহহ... আমি ওর উপর কোনোরকম জোর করব না...
সূর্য : এতে জোরের কি আছে টিনটিন !!!
উত্তীয় : আছে... আছে... আমার নদী ভীষণ নরম মনের একটা মানুষ... একটা সামান্য আঁচড়-ও ওকে ভীষণ যন্ত্রণা দেবে... আমি ওকে ওই সামান্য আঁচড়টুকুও দিতে পারব না... পার...
হঠাৎই একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ উত্তীয়-র কানে পৌছাতে সে চমকে একবার সূর্য-র দিকে তাকিয়ে পেছন ফিরে তাকায়... দেখে সুর চাদর আঁকড়ে ধরায় স্যালাইনের বোতল দিয়ে রক্ত উঠতে শুরু করেছে... সুর ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাচ্ছে... দৌড়ে আসে উত্তীয় আর সূর্য...
দু'দিন পর :
-----------------
সুর : এতক্ষণে আসার সময় হলো আপনার !!!
উত্তীয় : আমার অপেক্ষা করছিলে বুঝি !!!
সুর : একটু উঠে বসতাম... আর শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না...
উত্তীয় : নাহহহহহ... এখন উঠা যাবে না সুর... দু'দিন আগেই তোমার এতবড় একটা অপারেশন হয়েছে....
সুর : Please... ভীষণ পিঠে ব্যাথা করছে... একটু উঠে বসি...
উত্তীয় পরম যত্নে সুর-কে ধরে ধরে উঠিয়ে বসিয়ে দেয়... আজ সুর-এর চোখে, মুখে প্রত্যয়ের এক অদ্ভুত দীপ্তি দেখতে পায় উত্তীয়... যেন এক অন্য 'সুর'-কে দেখতে পাচ্ছে সে... মিটি মিটি হাসছে সে...
উত্তীয় : হাসছো কেন !!
সুর : আপনার নামটা শুনলেই একটা গান মনে পড়ে আমার...
উত্তীয় :
থাক থাক নিজ মনে দূরেতে,
আমি শুধু বাঁশরীর সুরেতে
পরশ করিব ওর প্রাণ মন, অকারণ...
সুর :
চমকিবে ফাগুনের পবনে
পশিবে আকাশ-বাণী শ্রবণে
চিত্ত আকুল হবে অনুক্ষণ, অকারণ....
উত্তীয় :
দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপন বিরহ ডোরে বাঁধিব
বাঁধন বিহীন সেই যে বাঁধন, অকারণ...
কিছু মুহূর্ত ওদের জীবন থেকে হারিয়ে যায় পরস্পরের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে থেকে... ক্ষণিক পর সুর নিজেকে সামলে টেবিল থেকে একটা শাল পাতা মোড়া নিজের হাতে তুলে নেয়... সেখান থেকে জবা ফুল, বেল পাতা উত্তীয়-র মাথায় ছোঁয়ায়... উত্তীয় বুকে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রণাম করে... তারপর একটা পেড়া উত্তীয়কে খাইয়ে দেয় সুর...
উত্তীয় : কার জন্য পুজো দিলে সুর !!!
শাল পাতা মোড়াটা উত্তীয়-র দিকে এগিয়ে দিয়ে সুর বলে,
সুর : ওতে যে সিঁদুরটা আছে, ওটা আমার সিঁথিতে পরিয়ে দাও...
উত্তীয় : অ্যাঁআআআআআ !!!! সুর, তুমি কি মজা করছো !!!
সুর : একেবারেই না....
উত্তীয় : তাহলে !!! তুমি তো আমাকে ভালো করে চেনেও না...
সুর : চিনতাম না... এখনো তেমনভাবে চিনি না... সত্যিই বলতে কি চিনতে চাইও না আমি... এক লহমায় সবকিছু জেনে নিয়ে পরস্পরের কাছে পুরাতন হয়ে যেতে চাই না আমি... তার চেয়ে নতুন শাড়ির ভাঁজ খোলার মতো করেই না হয় পরতে পরতে আমাদের সম্পর্কটা উন্মোচিত হোক... ক্ষতি কি !!! আর সবচেয়ে বড় কথা, এত বছর পাশাপাশি থেকেও কি একটা মানুষকে চেনা যায় !!! তার সবটুকু জেনে ফেলা যায় !!! নাহহহহ... সবসময় কাছে থাকলেই আপন হওয়া যায় না উত্তীয়... তাতে দুই পক্ষের সমর্পণটা প্রয়োজন... তাই...
সুর-এর মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে উত্তীয় বলে ওঠে,
উত্তীয় : এখন চেনো, তাই তো !!!
সুর : যেদিন আমার বুকে গুলি লেগেছিল, সেদিন আমি তোমায় চিনেছিলাম উত্তীয়... তুমি যেভাবে আমাকে ওই ভিড়ে আঁকড়ে ধরে আড়াল করছিলে.... তারপর তোমার ওই ডাক... তোমার চোখের জল.... তোমার হয়ে তোমার সব না বলা কথা আমাকে বলে দিয়ে গেছে....
সুর এতগুলো কথা একসাথে বলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে... মাথাটা ঘুরে যায় একবার... সে টলে গেলে উত্তীয় দ্রুত তাকে আঁকড়ে ধরে,
উত্তীয় : দেখলে তো সুর... বারণ করলাম তোমাকে !!
সুর : তাহলে আমাকে সারাজীবনের মতো বাঁধতে তোমার কোথায় বাঁধছে !!!!
উত্তীয় : তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না....
সুর : তাতে কি তোমার ভালোবাসায় ভাটা পড়েছে !! আমি কি তোমার বন্ধু তো হতে পারি উত্তীয় !! পথ চলা তো শুরু করি... ভালোবাসা নিজেই এসে নিজের... আহহহ...
উত্তীয় : সুর !!! কষ্ট হচ্ছে তোমার...
সুর : আমার সিঁথিটা রাঙিয়ে দাও উত্তীয়... আমাকে এত ভালোবাসো... তোমার এই গোপন ডেরায় এতগুলো দিন তোমার সাথে একা কাটানোর পর সমাজের কলঙ্কে আমাকে কলঙ্কিত হতে দেখতে পারবে !!!
উত্তীয় : নাহহহহহ.... কখনো নয়....
সুর : আমার বড় সাধ ছিল- আমাদের বাঁধনটা অকারণ হবে... আমি তোমাকে কোনো জোর করতে চাই না উত্তীয়... কোন সমাজ বা কোন কিছুর ভয়ে আমাকে গ্রহণ করতে জোর করতে চাই না... আমি কি তোমার চলার পথে তোমার বন্ধু হতে পারি উত্তীয় !!! অকারণেই !!!
কয়েক ফোঁটা মুক্তদানা দু'জনের চোখ থেকেই ঝরে পড়ে... উত্তীয় সুরের সিঁথি রাঙিয়ে দেয়... সুর ক্ষণিক চোখ বন্ধ করে রাখে.... তার চোখের উপর উত্তীয়-র ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে জল ভর্তি চোখ নিয়ে উত্তীয়-র দিকে তাকায়....
নেপথ্যে :
---------------
সূর্য : এত বুদ্ধিমান হয়েও এইটুকু বুঝলি না টিনটিন, এই মেয়ে নিজের সিঁথির সিঁদুর দিয়ে তোর অপরাধটুকু মুছে দিল... তোর গায়ে এতটুকু অপরাধের আঁচড় লাগতে দিল না... সত্যিই, যোগ্য মেয়েকেই ভালোবেসেছিস... ভালো থাক তোরা, ভালো থাকুক তোদের ভালোবাসা....