Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance

4  

Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance

প্রিয় অসম্পূর্ণতা (পর্ব ৪)

প্রিয় অসম্পূর্ণতা (পর্ব ৪)

7 mins
219



নেপথ্য সঙ্গীত :

~~~~~~~~~~~

রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে,

     তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,

           তোমার অরুণ হাসির তরুণ রাগে,

                  অশ্রুজলের করুণ রাগে...

অজ্ঞাত ডেরা :

---------------------

গান শুনে ঘোর কাটে সুর আর উত্তীয়র-ও... সুর-এর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেও উত্তীয়-র হৃদয়ে বোধহয় গানের রঙ এসে লাগল- গানটা যেন তার হৃদয়ের অব্যক্ত বেদনাগুলোকেই স্পর্শ করে চলে গেল.... সুর দৌড়ে জানলায় চলে যায়, উত্তীয়-ও সুর-এর পেছনে এসে দাঁড়ায়....

সুর : (উত্তেজিত হয়ে) আজ তো দোল !!! তাই না...

উত্তীয় : হ্যাঁ... তুমি খেলবে...

সুর : আমাদের বাড়িতে তো হোলির জন্য Party throw করা হোত, কৃত্রিমতা থাকতো... কিন্তু, এইভাবে কখনো অনাবিল আনন্দের সাথে রাস্তায় রাস্তায় গান গাইতে গাইতে দোল খেলি নি... আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন !!!

উত্তীয় : তুমি যেতে চাইলে অবশ্যই নিয়ে যাব... কিন্তু তার জন্য তোমাকে আগে ফ্রেশ হতে হবে... ওই আলমারিতে তোমার জন্য সব রাখা আছে... তুমি তৈরি হয়ে এসো...

উত্তীয় ঘর থেকে বেরিয়ে যায়... সুর আলমারি খুলে অবাক হয়ে যায়... অধিকাংশ তার প্রিয় রঙের তার সব প্রিয় পোশাকে আলমারি ভর্তি... হয়তো তার পরিবারের মতো মূল্যবান নয়, কিন্তু আন্তরিকতার ছোঁয়া আছে... এমনকি মেয়েদের একান্ত ব্যক্তিগত সামগ্রীও ওতে মজুত করা আছে... উত্তীয়-র এই 'আন্তরিকতা আর যত্নের সাথে আগলে রাখার' মনোভাবে নিজের অজান্তেই সুর-এর মনে একটা সূক্ষ্ম, সুপ্ত ভালোলাগার অনুভূতি বাসা বাঁধতে শুরু করে... সুর আলমারি থেকে একটা হাল্কা গোলাপী পাড় আর হলুদ রঙের Handloom শাড়ি বের করে ফ্রেশ হতে যায়... বাথরুম থেকে ফিরে খোলা আঁচল আর খোলা চুলে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে আস্তে আস্তে চুল মুছতে থাকে.... হাল্কা ফুরফুরে হওয়াতে সুর-এর চুলগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে... তোয়ালে পাশে রেখে সুর সেই চুলগুলোকে বৃথা বশে আনার চেষ্টা করছে...

নেপথ্যে : থাক না ওগুলো ওমনি... ভেজা চুল বাঁধলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে...

পেছন থেকে উত্তীয়-র গলা পেয়ে সুর চমকে ওঠে... ঘুরে উত্তীয়-র দিকে ফিরতে এক বেপরোয়া হাওয়া সুর-এর আঁচল আর চুল এলোমেলো করে দেয়... অবিন্যস্ত, অবাধ্য আঁচল সামলাতে ব্যস্ত সুর-এর সদ্যস্নাত কমনীয় মুখের দিকে উত্তীয় বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে... সুর-এর ডাকে ঘোর কাটে উত্তীয়র...

সুর : কিছু বলবেন !!!

উত্তীয় : অ্যাঁ !!!

সুর : আপনার হাতে ওটা কি !!!

উত্তীয় : ঘটিগরম... তোমার জন্য আনলাম... খাবে !!!

সুর : বাহহহ... খুব Interesting নাম তো !!!

উত্তীয় : খেয়ে দেখো... ভালো লাগবে...

বিপুল উৎসাহে সুর ঘটিগরম মুখে ভরে... ক্ষণিক চিবতেই তার চোখ মুখ বদলে যায়....

সুর : উহহহহহ.... আহহহহহ.... কি ঝাল !!! উহহহ !!! মা গো !!! ঝাল !!! ঝাল !!!

উত্তীয় : ohhhh Shit !!! Sorry... Sorry... Extremely Sorry... দাঁড়াও... দাঁড়াও জল দিই...

সুর-এর অবস্থা দেখে হতভম্ব উত্তীয় ক্ষণিকের জন্য জলটাও খুঁজে পায় না... উপায়ান্তর না দেখে সুর নিজেই টেবিলের উপর রাখা Choco Syrup মেশানো দুধটা ঢকঢক করে খেয়ে ফেলে... উত্তীয় চোখ বড় বড় করে হাঁ হয়ে সুরকে দেখতে থাকে... ঝাল একটু কমলে চোখে জল মুছতে মুছতে হাঁপাতে হাঁপাতে সুর বলে,

সুর : It's... It's Yummy... Really Yummy... কিন... কিন্তু ভীষণ ঝাল... But Really Too Yummy...

উত্তীয় : হ্যাঁআআআআআ... জীবনে প্রথমবার ঘটিগরম with Choco Milk খেতে দেখলাম...

সুর প্রথমে ভ্রূ কুঁচকে, চোখ পাকিয়ে কপট রাগ দেখাতে গিয়েও ক্ষণিক পর সুর আর উত্তীয় দু'জনেই প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়ে...

দোল উৎসব :

----------------------

তখন প্রায় বেলা এগারোটা... রাস্তার দুই ধারে লাল হলুদের বন্যা- কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অমলতাস, শিরীষ, আরো নানান বৃক্ষ... প্রখর রোদ্দুরকে পরাস্ত করে উর্ধ্বাকাশে ছড়িয়ে পড়ছে আবীর.... অফুরন্ত প্রাণশক্তির যেন দাপুটে নির্ঘোষ... সব বয়সের মানুষ পুরো অলিতে গলিতে আবির মাখতে মাখতে, ছড়াতে ছড়াতে, গানে, প্রেমে, আবেগে ভাসতে ভাসতে চলেছে... সুর-এর আলগা খোঁপা বাধা সম্পূর্ণ.... হঠাৎই সে চোখ তুলে দেখে আয়নাতে হাল্কা হলুদ পাঞ্জাবি পরা উত্তীয়-র প্রতিবিম্ব পড়েছে... একটা মৃদু হাসিতে সুর-এর মুখ ভরে যায়... দূরে কোথাও তখন বেজে ওঠে,

'না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখি জলে, না বুঝে'

উত্তীয় : এই নদী, সাজটা না কোথাও incomplete !!!

সুর : কেন !!! দেখো, আমি কিন্তু এর থেকে বেশি সাজতে পারি না...

উত্তীয় : আচ্ছা, তোমাকে সাজতে হবে না... তুমি চোখটা বন্ধ করো... আমি যতক্ষণ না বলব, খুলবে না কিন্তু...

সুর : কেন !!! কি করবে তুমি !!!

উত্তীয় : আচ্ছা, আমাকে কি একটুও ভরসা করা যাচ্ছে না এখনো !!!

সুর উদাসীন হয়ে পড়ে... সুর অন্তরের গোপনতম যন্ত্রণা কিন্তু উত্তীয়-র চোখ এড়ায় না....

সুর : (মনে মনে) বহু বছরের চেনা মানুষকে সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ হয়ে যেতে দেখেছি....

উত্তীয় : কি হলো সুর !!! ভরসা করতে পারছো না আমাকে !!! দৈবিককে এখনো ভুলতে পারো নি, তাই না !!! এইটুকু জানবে সুর, যা হয় তা কিন্তু ভালোর জন্যই হয়...

সুর চমকে ওঠে উত্তীয়-র দিকে তাকায়... উত্তীয় সুর-এর কাঁধে হাত রাখে... সুর উত্তীয়-র চোখে চোখ রাখতে পারে না... মুখে কৃত্রিম হাসি টানার চেষ্টা করে যন্ত্রণাবিদ্ধ গলায় বলে,

সুর : আরে না না... তেমন কিছু না... মানুষ কি নিজেকেই সারা জীবনে চিনে উঠতে পারে !!! তবে আমার একটা দাবী আছে আপনার কাছে...

উত্তীয় : বলো না... তোমাকে অদেয় তো আমার কিছু নেই...

সুর : আজ আপনাকে গান গাইতে হবে... কি সুন্দর দরাজ গলা আপনার... গাইবেন তো একটা গান !!!!

উত্তীয় : (আবেগভরা গলায়) গাইব... আজ শুধু তোমার জন্য গাইব... তবে তার জন্য যে এখন তোমাকে চোখ বন্ধ করতে হবে....

সুর দ্বিধামিশ্রিত সম্মতিসূচক হাসি হেসে চোখ বন্ধ করে... উত্তীয় Dressing Table থেকে একটা ছোট্ট গোলাপী টিপ সুর-এর কপালে পরিয়ে দেয়... সুর-এর গোটা মুখ একটা মিষ্টি হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে... তারপর নিজের বুকের পকেট থেকে একটা হলুদ গোলাপ বার করে সুর-এর খোঁপায় গুঁজে দেয়.... সুর ধীরে ধীরে চোখ খুলে এবার মুগ্ধ বিস্ময়ে পূর্ণ নয়নে উত্তীয়-র চোখের দিকে তাকায়- যেন বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাস বসন্তহীন সুর-এর কানে কানে পৌঁছে দিল 'নতুন বসন্ত'-এর বার্তাটি....

                   'দোলত দুলে গোবিন্দায় নমঃ'

রাধাকৃষ্ণকে দলের বেদিতে বসানো হয়েছে... মন্ত্র উচ্চারণে সবাই দোল বেদিতে আবীরে রঞ্জিত করছে রাধাকৃষ্ণর মূর্তি... সুর-ও উত্তীয়-র সাথে এসে একযোগে রাধাকৃষ্ণর মূর্তিতে আবীর দেয়... হঠাৎই উত্তীয় দোল বেদি থেকে আবীর নিয়ে সুর-এর কপাল, গাল রাঙিয়ে দেয়... এরপর সুর-এর মাথায় হাত রেখে বলে,

উত্তীয় : আজ এই রাধাকৃষ্ণর মূর্তিকে সাক্ষী রেখে আমি শপথ নিচ্ছি আজীবন তোমাকে সমস্ত রকম অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করে যাব.... মনখারাপের সব রঙগুলো আজ মুছে দাও....

সুর দোল বেদি থেকে আবীর তুলে উত্তীয়-র গালে লাগিয়ে বলে,

সুর : তোমার এই খুশির বসন্ত, যেখানে বসন্তের আমেজ নিজের সাথে অন্যদেরও রাঙিয়ে দেয়- যেন কখনো ফুরিয়ে না যায়... অনন্ত হোক বসন্ত, অনন্ত হোক তোমার দোল পূর্ণিমা... (হাত পেতে) এবার দিন আমার দোলের উপহার...

সুর আর উত্তীয়-র মুখ আনন্দে আলোকিত হয়ে ওঠে...

সুর :

রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে,

সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে,

  যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে,

     রক্তে তোমার চরণ দোলা লাগিয়ে দিয়ে...

 

উত্তীয় :

      আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে,

      পাষাণগুহার কক্ষে নিঝর-ধারা জাগে,

       মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে,

         বিশ্ব নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে,

           তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও,

যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে- কাঁদন বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে..

সুর উত্তীয়-র হাত ধরে ঘুরে ঘুরে গান গাইছিল... কিন্তু উত্তীয় চোখের সামনে দেখছিল- ছোট্ট নদী ছোট্ট টিনটিনের হাত ধরে ঘুরে ঘুরে গান গাইছে... হঠাৎই সুর চিৎকার করে উত্তীয়কে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়.... আর সঙ্গে সঙ্গে গুলির আওয়াজে কেঁপে ওঠে এলাকা....

সুর : (আর্তনাদ করে) সরে যান উত্তীয়.... আহহহহ....

উত্তীয়কে ঠেলে সরিয়ে রক্তাক্ত সুর নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে... ঘটনার আকস্মিকতা কাটাতেই উত্তীয় দেখে সুর বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কাতরাচ্ছে... এদিকে গুলির আওয়াজে সবাই ভয়ে এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়... উত্তীয় কোনোরকমে উঠে যন্ত্রণায় কাতর সুরকে নিজের শরীর দিয়ে আগলে পদপিষ্ঠ হওয়া থেকে বাঁচিয়ে বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে কোলে তুলে ডেরায় ফিরে আসে...

নেপথ্যে (ক্রুর স্বরে) :

------------------------------

Vital Clue পেয়েছিস খুব ভালো কথা... তা বলে, তোকে গুলি চালাতে কে বলেছিল !!!! কিইইই !!! কিইইই বললি !!! ছেলেটাকে গুলি করেছিলিস !!! আরে গুলি যাকেই কর- লেগেছে তো সুর-এর বুকে.... এখন যদি এই Papers গুলোতে Sign করার আগেই পটল তোলে... কোথায় !!! কোথায় ওরা এখন !!! কি বললি !! জানিস না !!! ছেলেটা কপ্পুরের মতো উড়ে গেল !!! আমি কিছু শুনতে চাই না... যেভাবেই হোক, ওদের খবর আমাকে দে... যত তাড়াতাড়ি সম্ভব... শোন, গুলি যখন বুকে লেগেছে, O.T. করতেই হবে.... আর ওইরকম Critical অবস্থায় খুব দূরে নিয়ে যেতে পারবে না... তাই ওই এলাকার আশেপাশের সব হাসপাতাল, নার্সিংহোম গুলোতে চিরুনি তল্লাশি চালা... সুর-কে আমার চাই... মানে 'চাইইইইইই'....

অজ্ঞাত ডেরা :

---------------------

উত্তীয় : সুর... সুর... কি করলে তুমি এটা !! কেন করলে !!! আমার... আমার বিপদটা নিজে নিয়ে নিলে... এত চেষ্টা করেও তোমাকে আমি আগলে রাখতে পারলাম না...

সুর : (কাতরভাবে) মাআআআআআ.... আম... আমি... আসছি...

উত্তীয় : কি বলছো এইসব !!! কি হলো তোমার সুর !!! খুব কষ্ট হচ্ছে !!! এই দেখো... এই দেখো তুমি আমার কাছে... আমি তোমাকে ডেরায় নিয়ে চলে এসেছি... Please... Please... সুর, চোখ... চোখটা খুলে রাখার চেষ্টা করো... সব ঠিক হয়ে যাবে সুর... তোমার কিছু হবে না... আমি হতে দেবো না... Trust me...

সুর আর চোখ খুলে রাখতে পারছে না... চোখের পাতা ক্রমাগত ভারি হয়ে আসছে... বুঝতে পারছে তার সময় আগত... একে একে সবার মুখ মনে পড়ে- মা, বাবা, অভিরী, দৈবিক.... আর... আর... উত্তীয়-র... অস্ফুটভাবে বলে ওঠে,

সুর : আমায় ক্ষমা করে দিও বাবা... তোমা... তোমাদের সাথে আর মনে হয় দেখা হলো না... উত... উত্তীয়, সব... সবাইকে বলো, পারলে... পারলে আমার... আমার গানের মধ্যে দিয়েই আমায় মনে রাখতে... আসি...

উত্তীয় : নাহহহহহ.... নাহহহহ....

পুরোপুরি জ্ঞান হারানোর আগেই মনের অতল থেকে একটা বাচ্চা ছেলের মুখ ভেসে ওঠে তার... সুর-এর চোখের সামনে নিকষ কালো নেমে আসার ঠিক আগের মূহুর্তে তার কপাল স্পর্শ করে এক উষ্ণ অধর পল্লব... সুর-এর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে এক ফোঁটা জল.... উত্তীয়-র বুকের জামাটা শক্ত করে ধরে রাখা সুর-এর হাতের মুঠোটা ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়.... উত্তীয় চিৎকার করে ওঠে,

                                 

          নদীইইইইইইইইইইইইইইই

দূরে পাড়ার প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসছে রবি ঠাকুরের সুর,

   দুঃখ সুখ আপনারি, সে বোঝা হয়েছে ভারি...

      যেন সে সঁপিতে পারি চরম পূজার থালে....

       তোমার আমারো এই বিরহের অন্তরালে,

  কত আর সেতু বাঁধি- সুরে সুরে তালে তালে...

(অতঃপর !!!!)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance