Mitali Chakraborty

Inspirational

2  

Mitali Chakraborty

Inspirational

পরিবর্তন:-

পরিবর্তন:-

4 mins
809


সবে দেড় মাস হলো কুন্তলা বিয়ে হয়ে এসেছে সরকার বাড়িতে। রক্তিমের সাথে সম্বন্ধ করেই হয়েছে বিয়েটা। কুন্তলা সব সময়ই একটু চুপচাপ, আবেগী ও শান্ত, আর রক্তিম ঠিক তার বিপরীত।


কুন্তলার এই শান্ত শিষ্ট স্বভাবটাকেই পছন্দ করেছিলেন তার দিদিশাশুড়ি প্রভাদেবী। ৬৮বছর বর্ষীয়া প্রভাদেবীর নয়নের মনি হয়ে গেছে কুন্তলা খুব অল্প দিনেই, খালি সময়ে কুন্তলা দিদিশাশুড়ির কাছেই বসে শুনে রক্তিমের ছোটবেলার গল্প, দেশের বাড়ির গল্প, পাড়া-পড়শীদের গল্প । সেদিন ছিল রবিবার, সকাল থেকেই কুন্তলা তার শাশুড়ি মায়ের সাথে পাক্ ক্রিয়ায় আরো সুচারু হবার প্রশিক্ষণে খুন্তি কড়া নিয়ে ব্যস্ত। তখনই হঠাৎ বেজে ওঠে বাড়ির ল্যান্ড ফোনটা। রক্তিমই নেয় ফোনটা। ফোনের ওপাশে ছিলেন রক্তিমের পিসিমা। তিনি জানালেন যে পরের সপ্তাহেই তিনি আসছেন ওখানে। কিছুদিন থাকবেন, সকলের সাথে দেখা করবেন আর নতুন বৌমা কুন্তলার হাতের রান্না খাবেন। রক্তিম যথেষ্ট উৎফুল্লিত হয়ে আমন্ত্রণ জানায় পিসিমাকে আসার জন্য। পিসিমার সাথে কথা বলা হয়ে গেলে পর হইহই করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকে তার মা আর কুন্তলাকে জানায় আগামী সপ্তাহে পিসিমার আসার কথা। আর কুন্তলার দিকে চেয়ে বলে," বুঝলে, পিসিমার যত্ন আত্তিতে কোনো ত্রুটি যেনো না হয়, পিসিমা আমার বড়ই খাদ্য রসিক, ওনার পছন্দের রান্না গুলো জেনে নেবে আর শিখে নেবে মা আর ঠাম্মার কাছ থেকে..."।


কুন্তলা কিছু বলে না তখন রক্তিমকে, শুধু মনে মনে ভাবে আগামী সপ্তাহে তো তার বাপের বাড়ি যাওয়ার ছিল, প্রায় ১৫ দিন আগেই তার মা বাবা বলে রেখেছেন রক্তিম সহ বেয়াই বেয়ানকে যে কুন্তলা যেনো অবশ্যই যায় ও বাড়ি। অষ্টমঙ্গলার পর আর যাওয়াই হয়নি কুন্তলার বাপের বাড়ীতে। ভেবেছিল আগামী সপ্তাহে যাবে, অনেক দিন দেখে না সে বাড়ীর সদস্যদের, যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ওই মুঠোফোনই ভরসা। সবচাইতে বেশি মন কেমন করে কাকাতো ভাই বিন্তু টার জন্য। খুব দিদিঅন্ত প্রাণ ছেলে বিন্তু, কত কেঁদেছিল অষ্টমঙ্গলার পর যখন ফিরে যাচ্ছিল কুন্তলা। কিন্তু আজ আচমকা পিসি শাশুড়ি মায়ের আগমনের সংবাদে কেমন উদাস হয়ে গেলো কুন্তলা। প্রভাদেবী চৌকিতে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন, রক্তিমের কথা কানে যাচ্ছিল সবই। রক্তিম রান্নাঘর থেকে বেরোলে পর কাছে ডেকে বললেন, "হ্যাঁ রে খোকন, বাসন্তী আসছে বুঝি?", রক্তিম কাধ নাড়িয়ে, চোখ নাচিয়ে বলল, "তবে!!! ওই তো বিয়ের সময় এসেছিল পিসিমা তারপর তো আর সময় করেই উঠতে পারেনা এদিকে আসার। এবার এলে পিসিমাকে বলব কিছুদিন আরো থেকে যাওয়ার..."।


প্রভাদেবী বললেন,"খুব মজা তাই না রে? পিসির সাথে সাক্ষাৎ হবে"।


রক্তিম বেতের মোড়াটা টেনে ঠাকুমার কাছে বসতে বসতে বললো,"সে আর বলতে ঠাক্ মা...! পিসি এলে তো দেদার মজা হয়, কত আড্ডা গল্প হয় বলো দেখি, আর পিসিমা এলে বাড়িতে রান্নাটাও তো কত ভালো হয়, সব ভালো ভালো পদ, পিসিমার সাথে বসে তোমার আর মায়ের হাতের স্বাদে পদে নানা লোভনীয় খাবার খাওয়ার মজাই আলাদা গো। কিন্তু এবারে তোমার চিন্তা করতে হবে না, তোমার মেয়ের ফাইফরমাস খাটার জন্য তোমার নাতবৌ আছে তো, দেখবে সব সামলে নেবে কুন্তলা...", এই বলে রক্তিম গুনগুনিয়ে গান করতে করতে উঠে চলে যায়। প্রভাদেবী কিছু বলেন না তখন, চুপ করে থাকেন আর রান্নাঘরে গলদঘর্ম হওয়া কুন্তলার দিকে চেয়ে থাকেন।


দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর কুন্তলা তার দিদি শাশুড়ির কাছে এসে বসলে প্রভাদেবী তার করুন মুখটা দেখে আঁচ করতে পারেন তার মনের দশা, কিন্তু সে মুহূর্তে তিনি বলেন না কিছুই।


**************************


পিসিমা এসে পৌঁছেছেন আজ সকালে। রক্তিমই গিয়ে এসেছে তাকে স্টেশন থেকে। কুন্তলা মাথায় আঁচল টেনে পা ছুয়ে প্রণাম করে পিসি শাশুড়িকে। কুন্তলার চিবুক ছুইয়ে আশীর্বাদ করেন বাসন্তী পিসিমা। কুন্তলা মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে দু চারটে কথা বলে সে পিসিমার সাথে। তাকে কথা বলতে দেখেই রক্তিম বলে,"আরে পিসিমাকে একটু জিরোতে দাও, এত কথার কি আছে এখন? যাও চা টা বসাও...."। কুন্তলা রান্নাঘরের দিকে এগোতে যাবে তখুনি প্রভাদেবী বলেন, "নাত বৌ, মা তুমি নিজের ঘরে যাও, রান্নাঘরে না..."। প্রভাদেবীর কথায় চমকে উঠে কুন্তলা সহ ঘরের প্রত্যেকেই। বাসন্তী পিসিমা সন্দেহ বশে জিজ্ঞেস করেন, "কি হয়েছে মা?"


প্রভাদেবী রক্তিমের দিকে চেয়ে বলেন, "যা খোকন তৈরী হয়ে নে..."।


রক্তিম অপরিসীম বিস্ময়ে বলে, "তৈরী হবো কিসের জন্য ঠাকুমা?"


প্রভা দেবী বলেন, "তুই তোর শ্বশুরবাড়ি যাবি বলে, ভুলে গেছিস খোকন? দিন ১৫ আগেই কুন্তলার বাবা মা অনুরোধ করেছিলেন কুন্তলা কে বাপের বাড়ি পাঠানোর জন্য, যা নাত বৌ'কে পৌঁছে দিয়ে আয় তার বাপের বাড়িতে।"


রক্তিম ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দেয়, "ওনারা বলেছেন তো কি হয়েছে? পিসিমা এসছেন আর বাড়ির বৌ অতিথি আপ্যায়ন ছেড়ে বাপের বাড়ী যাবে ফুর্তি করতে? এটা হতে পারে না, এটা মেনে নেওয়া যায়না। তাছাড়া কুন্তলা তো বলেই দিয়েছে ও বাড়িতে যে এ সপ্তাহে তার ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়..."। রক্তিম মুখে বিরক্তির ভাব এনে কুন্তলা কে বলে, "তুমি দাঁড়িয়ে আছো কি? যাও না চা-জলখাবারটা বানাও না"।


কুন্তলা আবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই প্রভাদেবী উঠে দাঁড়ান এবং জোর গলায় বলেন, "রক্তিম ভুলে যাস না আমি এখনও জীবিত আছি, আর আমি তোদের সবার থেকে বয়স ও অভিজ্ঞতায় বড়। আমি বলছি কুন্তলা আজ বাপের বাড়ি যাবে তার মানে যাবেই। তোর যেমন নিজের পরিবারের আপনজনদের সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে তেমনি শিকড় থেকে উৎপাটিত হয়ে এবাড়িতে বউ হয়ে আসা মেয়েটিরও ইচ্ছে করে নিজের বাবা মা সহ পরিবারের সকলের সাথে দেখা করার, সময় কাটানোর, যা আর দেরি নয়, তৈরী হয়ে নে জলদি...."।


রক্তিম কিছু বলছে না চেয়ে আছে শুধু হতবাক হয়ে প্রভাদেবীর দিকে।


প্রভাদেবী এবারে কুন্তলাকে বললেন,"যাও নাত বৌ, ঘুরে এসো বাপের বাড়ি থেকে। আর রইলো তোমার পিসিমার যত্নআত্তি করা আর স্বাদে পদে খাওয়ানো? সেটার জন্য আমি নিজেই এখনও শক্ত সমর্থ আছি। যাও আর দেরী করো না, সাত তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হও খোকনের সাথে.... দুগ্গা দুগ্গা...."।


কুন্তলা কিছু বলতে পারছে না, ঢিপ করে প্রভাদেবীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই প্রভাদেবী কুন্তলাকে বুকে টেনে জড়িয়ে বললেন, "এবারে হাওয়া বদল হবে এবাড়িতে, পরিবর্তনের শুরু। নিজের অধিকারের জন্য নিজেকেই আওয়াজ উঠাতে হয় নাতবৌ, চুপ করে, সব সহ্য করে নিজের ইচ্ছে গুলোর, ভালোলাগা গুলোর বলি দেওয়ার নামই সংসার করা নয়। যাও সোনা বৌ প্রাণ ভরে আনন্দের প্রাণবায়ু নিয়ে ঘুরে এসো বাপের বাড়ি থেকে... "।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational