Apurba Kr Chakrabarty

Romance Classics

4.5  

Apurba Kr Chakrabarty

Romance Classics

প্রেম বিরহ (প্রথম পর্ব)

প্রেম বিরহ (প্রথম পর্ব)

11 mins
389


চক্রধরপুর এক ছোট গ্রাম, কঘর বসতি,যাদের মধ্যে আবার অনেকেই বাড়ি ছেড়ে এখন শহরে। বামুন পাড়ায় আগে একসময় যেখানে পনের বিশ ঘর মানুষের বসবাসছিল ,আজ চারটি ঘর টিকে আছে। যার মধ্যে আবার এক ঘর, নিঃসন্তান বিধবা বুড়ি মালতী, আর এক পরিবারের বুড়ো বুড়ি বাবা মা সঙ্গে ছেলে আশোক, হাতুরে ডাক্তার,নতুন বিয়ে হয়েছে, বৌ আর নিজের কাজেই ব্যস্ত।

হরনাথের  পাঁচ সন্তানের ছোট অপু।বড় ছেলে কলকাতায় পড়াশোনা করে।তিন মেয়ের আঠারো কুড়ি মধ্যেই বিয়ে দিয়ে যেন বড় পিতৃকতর্ব্য করেছেন।

আজ তিন চার বছর অপুর পাড়ার সঙ্গী অনুপ্রিয়া। বোনের মত, বছর তিন ছোট। তাদের শিবমন্দিরের পুরোহিতের একমাত্র মেয়ে। পাড়াটা বড় খাঁ খাঁ করে। কিছু দুরে ঘোষ পাড়া, মোরল পাড়া, বাগ্দী পাড়ার ছেলেদের সাথে তার বন্ধুত্ব স্কুলের সহপাঠী হিসাবে।

তিন চার বছর হল অনু ,অপুর একমাত্র সঙ্গী,সেই যতদিন ছোটদি অর্পিতার বিয়ে হয়েছে। সাত আট বছরের বড় দাদা তো ছবছর কলকাতায়। উৎসবে গাজনে আর দূর্গাপুজায় সবাই আসে।সেতো মাত্র ক দিন! অপুর বড় মাছ ধরার সখ। শিব পুকুর ,তাদের জ্ঞাতিদের পুকুর, শিবের দেবত্ত্ব সম্পত্তি, সংলগ্ন পশ্চিমে এক বিঘা পাড়, স্কুল শিক্ষক হরিনাথ সেখান নানা সব্জি চাষ করে ,আর মধ্যে ছোট ফুলের বাগান। শিবের নিত্যপুজোয় লাগে।

অপুরা ধনী না হোক মোটামুটি সচ্ছল, অনুপ্রিয়ার বাবা গ্রামে পুজো করে, পুরোহিত তার পেশা।খাবার অভাব নেই কিন্ত সচ্ছল নয়। অপুদের শিব মন্দিরের পূজারী। সকালে আড়াইশো চিড়ে, কলা, বাতাসা, আর একসের আতব চাল। সন্ধ্যায় শীতলের নিত্যভোগ, দুপোয়া দুধ, মন্ডা,ষোলোটা লুচি । মানিক বামুন, তার গিন্নি অমিতা, ও কন্যা অনুপ্রিয়ার নিত্য দিনের প্রায় অর্ধেক আহার খরচ তাতেই হয়ে যেত। অপুর মাকে, এই সব পুজোর উপকরণ সাজাতে অনু ও ওর মা অনেকটা সাহায্য করে।

সতেরো আঠারো বছরের অপু সদ্য দ্বাদশ পরীক্ষা দিয়েছিল, অনু দশম শ্রেণীতে উঠেছে। গ্রীষ্মের ছুটি। শিব পুকুরের পুবে আম বাগান। সব দেবত্ত্ব সম্পত্তি। হরিনাথের নিজের কিছু জমি আছে, চাষ করে না। ভাগে দেওয়া। তার বাড়ী সংলগ্ন পুব দিকে  শখের  সব্জির বাগানেই ছুটির দিন ব্যস্ত থাকত। এবার দ্বাদশ পাস করে অপুও কলকাতায় পড়তে যাবার কথা।অনুকে সেদিন দুপুরে পুকুরে মাছ ধরতে ধরতে বলছিল, "তুই একা হয়ে যাবি বল !"

অনুর মন খুব খারাপ,অপু তার দাদার মত,আবার বন্ধু, তাদেরও একটা বাড়ির সংলগ্ন উত্তরদিকে ছোট পুকুর আছে । অপু এখানেই বেশী মাছ ধরে। অনুর মাকে সে কাকীমা ডাকে।এ পুকুরে বর্ষার সময় পুব মাঠে জল উপচে ঢোকে,মেঠো পুকুর ভেসে আসা মাছও ঢোকে। বড় বড় শোল ,ল্যাটা, মাগুর সিঙ্গি ছিপে ওঠে। যা ওঠে অপু আধাআধি ভাগ করে ,বেশীভাগটা অনুকে নিতে বলে। অনুর মনে হয় অর্ধেকেরও অনেক বেশী অপু দা তাকে দিচ্ছে, কিন্ত নিতে হয়, অপু দা নাহলে ধমক দেবে। অপুকে সে ভালোবাসে দাদার মত, কিন্ত ভয় সমীহ করে, আবার তার বাহনের মত অনুসারী।

বাগানে ঝড়ে আম পরলে বা পাকা তাল পড়লে, একা অনু যায় না।একটু ফাঁকা নির্জন,ভয় করে, অপুর সঙ্গে যায়।অপু গাছে উঠে আম জাম কুল পাড়লে অনু ভাগ পায়। এই তিন বছর তাদের ভাব ভালোবাসা যেন বেড়েছে। এ দিকটায় গ্রামের মানুষের যাতায়াত কম। সবটাই শিবের দেবত্ত্ব সম্পত্তি, পুকুর, বাগান, পুকুর পাড়। হরিনাথ ভোগ দখল করে। মানিক পুজো করে এ আয়ের সে যৎসামান্যই লভাংশ পায়।

আটের দশকের প্রথম দিক, এ গ্রামে বিদ্যুত সবে এসেছিল, অপুরা বিদ্যুত নিলেও,অনুদের তখনও হ্যারিকেন ভরসা।অনুদের মাটির কাঁচা বাড়ি খড়ের ছাউনি সেই পুরোন আমলের ঘর। উত্তরে ছোটগড়ে পুকুর যাবার খিড়কীর দরজাও নেই। তবে নতুন পায়খানা বাথরুম করেছে ।

অপুদের একতলা পাকা বড় বাড়ী। অসচ্ছল ও সচ্ছলতা মাঝে তাদের হিংসা বিবাদ ছিল না। অপুর মা নমিতা তাদের নানা ভাবে সাহায্য করত। পুজোর সময়, গাজনে অনুর মাকে নতুন শাড়ি ব্লাউজ, বাবাকে ধুতি আর অনুর জামা ফ্রক, ইজের কিনে দিতো। এ জন্য অনুর মা বাবা, অপুদের প্রতি কৃতজ্ঞ অনুগত থাকত।

বছর চৌদ্দ পনেরর অনু গ্রীষ্মের দুপুরে আদ্র গরমে হাত কাটা ঢিলেঢালা টেপ ফ্রক আর ইজের পড়েই থাকে।অপুর সাথে ঘুরে বেড়ানো ,ছিপে অপুর সাথে মাছ ধরা,বাগানের কাঁচাআম,তেঁতুল পেড়ে খাওয়া বেশ আনন্দের  জীবন চলছিল। সরল  সাদাসিদে নিরীহ গোছের মেয়ে অনু। 

অপুকে বলছিল, "তুমি কলকাতায় পড়তে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে, সঙ্গী পাবো না। তুমি কিন্ত প্রতি রবিবার আসবে । গরমে আর পুজোর  ছুটিতে এসে থাকবে।তোমার অরুণদার মত যেন ,কলকাতাতেই থেকে যাবে না !"

অপু বলে,"দাদার তো তোর মত গ্রামের এত ভালো সঙ্গী নেই, আর মাছ ধরার নেশা নেই।আমি আসব ভাবিস না। শুনেছি দাদার খুব সিনেমার নেশা।"

পশ্চিম আকাশে গাঢ় কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে,কাল বৈশাখীর ঝড় উঠছে বেশ জোরে, অপু ,অনুকে বলে একটা ব্যাগ নিয়ে আয়, বাগানের আম বড় হয়েছে,ঝড়ে কিছু পড়বেই, কুড়িয়ে আনব। তখন বিকাল পাঁচটা গ্রীষ্মের বেশ বেলা। মাকে বোলে একটা নাইনলের মস্ত ব্যাগ অনু নিয়ে এল।এরপর দুজনেই শিবপুকুরে পুব পাড়ে অপুদের বাগানে ছুটল, ছিপ পড়ে রইল ছোটগড়ের উত্তর পাড়ে,বাঁশ বনের ঝোঁপে এমন আটকে রাখল ,ঝড়ে উড়ে যাবে না।

বেশ কিছুক্ষণ তারা,বাগানের ঝোঁপজঙ্গলে কখনও বাগানের পরিস্কার জায়গা থেকেই আম খুঁজে খুঁজে দুজন মিলে ব্যাগে ভরছিল। হঠাৎই তীব্র ঝাপটা বৃষ্টি ও ঝড়ে ওরা দিশেহারা, মুহুর্তেই ভিজে কাঁথা কাচা, সঙ্গে ঘন ঘন মেঘের  গর্জন কানে তালা ধরাচ্ছে। অপুর পরনে হাটু অব্দি হাপ প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি,অপু ভেজা গেঞ্জি খুলে,জল নিকড়ে গাছের ডালে রাখল,তারপর কেমন হঠকারিতায়, অনুর ঢিলেঢালা টেপ ফ্রকটা আচমকাই উপরের দিকে টেনে খুলে নিল। 

বলল " ভিজে পোষাক পড়ে থাকার চেয়ে খোলা গায়ে শরীরে জল কম বসবে।" 

অনু প্রস্তুত ছিল না, নগ্ন গায়ে হতভম্ব হয়ে লজ্জায় মুখ হেঁট করে দুহাতে অনাবৃত বক্ষদেশ আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করল।

হতবাক বিস্মিত অপু বলে,"তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস রে অনু!"

এক তৎক্ষনিক আবেগ আর দুষ্ট বুদ্ধিতে অপু, অনুর পিছন থেকে কিশোরীর সদ্য বিকশিত পুষ্ঠ স্তনে দুহাতে আলতো চেপে, কিছু দুষ্টমী করছিল। অপুর শরীরে  উৎতেজনা। অনুর আচমকা তীব্র শিহরণে সারা শরীর কেঁপে ওঠে, নিজেকে সংগত রাখতে পারে না, মুহুর্ত ঘুরে অপুকে সজোরে দুহাতে আকঁড়ে ধরল, অপুর বুকে মুখ গুঁজে কেমন ঘন ঘন নিশ্বাস প্রশ্বাস ছাড়ছে আর হাঁপাচ্ছে।

 অপুর মনে কেমন অপরাধবোধ অস্বস্তি গ্রাস করেছে, গায়ে জোর পাচ্ছে না, অনু উত্তেজনায় এমনভাবে তাকে ঠেসে ধরেছে বুকে চাপ লাগছে, অনুভব করছিল অনুর তপ্ত শ্বাস ও স্পর্শ, বৃষ্টির জলে ভেজা অনাবৃত শুভ্র উজ্জ্বল পিঠে অনুর কালো একরাশ চুল ভিজে সপসপে। অপু ভাবে লাজুক নিরীহ অনু যেন ও আজ নিজেতে নেই, কেমন অন্য রকম !এত শক্তি ওর মধ্যে !

হঠাৎই এক তীব্র গর্জনে বজ্র পাত খুব নিকটেই হল,অনু ভয়ে চমকে এবার অপুকে ছেড়েদিল।অপু যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, অনু লজ্জায় মুখ নামিয়ে।অপু, অনুকে টেপ ফ্রক পড়ে নিতে বলল। নিজেও গেঞ্জি পড়ল। বৃষ্টির ছাড়ার নাম নেই।

"চল অনু বাড়ি যাই" বলে,আমের ব্যাগ এক হাতে, অন্য হাত অনুর বাম কব্জি ধরে অপু বাড়ির দিকে ছুটল।শিব মন্দিরের কাছে আসতে আসতেই অনু কেমন ক্লান্ত অসুস্থবোধ করছে, খুব হাঁপাচ্ছে। অপু উদ্বিগ্ন বলল "তোর কষ্ট হচ্ছে ?"

লাজুক নার্ভাস অনু বলল "না না,খুব ছুটেছি তাই, ও কিছু নয়।" 

অপরাধী মনে অপু কিছু যেন অনুকে বলতে গেল,  পারল না।সব আম সমেত ব্যাগটা অনুকে দিয়ে বলল "বাড়ি যা।"

"তুমি নিলে না !" অবাক অনু জিজ্ঞেস করে!

"আমার লাগবে না।" বলে অপু দৌড়াল বাড়ির দিকে।

রাত আটটায় অমিতা কাকীমাকে বাড়ি আসতে দেখে অপু অপরাধী মনে ভয় পাচ্ছিল, অনু তার দুষ্টমী কথা ওর মাকে বলেনি তো! যদি মাকে কাকীমা সব বলে দেয়!

অমিতা,অপুদের রান্নার ঘরে রাতের শিবের শীতল ভোগের লুচি ও অন্যান্য জোগাড় নিজেই করে,আর পূজার প্রসাদ তারাই ভোগ করে। অপু জানে তবু লুকিয়ে রান্নার ঘরে পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে কামীমার কথা শুনছিল।

বেশ কিছু আম দিয়ে কাকীমা বলল,"সব আম অনুকে দিয়েছে ,অপু কিছুই নেয়নি। দিদি আপনি এগুলো রাখুন। "

নমিতা বলল, "অপু কাক ভিজা হয়ে এসে সে যে বলল আম  কুড়োতেই পারেনি ! বৃষ্টির জন্য ওরা পালিয়ে এসেছে ! কি কান্ড বোঝ, না বলে অমন অবেলায় এত ঝড়জলে বাগানে! এত আমের ঝোঁক! বাগানে কত বিষধর সাপ আছে জানো?"

অমিতা একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, "এখন অনুর শরীর খারাপ চলছে, জলে ভিজে আবার কেমন হাঁচছে,গায়ে জ্বর মনে হল।অপুর শরীর ঠিক আছে তো!"

নমিতা যেন নিজের দায় ঝাড়তে ,"অপু উদ্দেশ্য বলল, হারামজাদা যত নষ্টের মুল,মেয়েটা কত কষ্ট পাচ্ছে ! "

অমিতা বলল, "দিদি ও তো বাচ্চা ছেলে। ওর কী দোষ! এ বয়সে এমন তো হবেই,ওকে কিছু বলবেন না।"

অপু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল,অনু তার নামে তবে নালিশ করেনি !

পরদিন সকালে উঠতে অপু বেশ দেরী হয়েছিল।প্রায় আটটা, মা জিজ্ঞেস করল "শরীর ঠিক আছে তোর?"

অপু হ্যাঁ বলতেই মায়ের তীব্র ভৎসনা বর্ষন শুরু হল। "হতোচ্ছাড়া তোর জন্য অনুর কত জ্বর! রাতে ভুল বকেছে ,কেমন কাঁপছিল,কাঁদছিল, সারারাত ওর বাবা মা পর্যন্ত ঘুমুতে পারেনি, ভীষন জ্বর।এমনিতেই কদিন বেচারার শরীর খারাপ চলছে, এই সময়ে  অবেলায় জলে ভিজে কী যে কান্ড ! তোর জন্য আমার লজ্জা!"

এবার নিজের নয়, অনুর জন্য সে ব্যাকুল হল। "আমি একবার দেখে আসি মা ,"বলেই হন্তদন্ত অপু ছুটল, অনুদের বাড়ি।

ঘরে বিছানায় অনু শুয়ে। চিন্তিত উদ্বিগ্ন অমিতা কাকীমা তার কপালে জল পট্টি দিচ্ছে।

খানিকক্ষন স্থির দাঁড়িয়ে, কেমন অপরাধীর মত অপু বলল, "এমন হবে আমি বুঝতে পারি নেই কাকীমা,ওর কী শরীর খারাপ ছিল! ওতো বলেনি!"

অমিতা শান্ত্বনা সুরে বলে, "ও তুমি বুঝবে না বাবা, মেয়েদের এমন শরীর খারাপ হয়,একটু দুর্বল ছিল   বৃষ্টিতে তুমিও ভিজেছ, তোমার আর কি দোষ! ও নিয়ে ভেবো না! মা বকেছে বুঝি?"

"সে মা যা বলে বলুক, অনুকে ডাক্তার দেখেছে!"

অমিতা বলল,"হ্যাঁ অশোক দেখে গেল,ওষুধ ট্যাবলেট দিয়েছে,একবার সকালে খেয়েছে।"

"ওতো কোয়াক ! বাজারের নবীন ডাক্তার তো ভালো, পাস করা ওকে ডেকে আনব ? "

অমিতা একটু ভরসা নিয়ে বলে ,"একটা দিন না  হয় অপেক্ষা করি,  মেয়েটা এমন রাশ পাতলা, ছোটবেলায় খুব ভোগাত, তর্কা ভুল বকা একটু জ্বর বাড়লেই হল।"

অনু জেগে গিয়েছিল চোখ খুলে,অপুকে দেখে আবার বন্ধ করল,দুচোখের পাশ বেয়ে কেমন অশ্রু গরাচ্ছে!

অনু কেন কাঁদছে! এবার আবার কেমন নিজেকে সে অপরাধী ভাবল, তার কুকর্মের কারনে বুঝি অনু কাঁদছে!

দিন তিনেক পর অনু সুস্থ হল । একটু সে দুর্বল ছিল, তাহলেও গরমের ছুটি থাকায় সে সকালে মায়ের একটু পুজোর আয়োজনে সাহায্য করে। অপুদের বাড়ী থেকে সকালের শিবের পূজার বিবিধ উপকরণ তৈরি, আর ফুল তুলে আনে। সে বড় শিবের ভক্ত।

অপু দেখল ,অনুর একটা পরিবর্তন,কেমন যেন খটকা লাগছে তার।মাথা নিচু করে তাকে দেখলেই চলে যাচ্ছে, হঠাৎ চোখাচোখি হলেই নিরীহ মুখে, নিষ্পাপ দুই ডাগরকালো চোখে লাজুক চাহনি,সঙ্গে সঙ্গেই সে  মুখ নামিয়ে নিচ্ছে।

অপু তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করল "অনু তোর শরীর ভাল আছে তো!" ইশারায় হ্যাঁ বলে সে চলে যায়।

পরদিন অপু দেখল অনু বাগানে ফুল তুলতে যাচ্ছে,  মা বাথরুমে।স্নানে তার মা অনেক সময় নেয়।আর কাকীমা ঘরে কাজে নিশ্চয়ই ব্যস্ত থাকবে।এই ফাঁকে, সে অনু কাছে গেল, ফুল তুলতে তুলতে অপুকে দেখে অনু কেমন থতমত , মুখ নামাল।

হতাশ অপু বলে, "অনু তুই আমাকে খুব খারাপ ভাবছিস!"

অনু মাথা নাড়িয়ে ইশারায় না জানাল।

অপু অধৈর্য হয়ে এবার বলে "তুই কথা বলছিস না কেন ! আমি সেদিনের জন্য ক্ষমা চাইছি, তুই এভাবে--"

কথা শেষ আগেই অনু বলল, "আমি কিছু মনে করি নেই অপুদা, তুমি কেন ক্ষমা চাইছ!"

"তুই কাউকে বলিস নি তো ! "

" তুমি কেন ভাবছ! ওদিনের কথা আমরা ছাড়া কেউ জীবনে জানবে না। বাবা মহাদেবের নামে সপথ করছি।"

"তুই ভীষন ভালো মেয়ে অনু ,তাই তোকে এত ভালোবাসী।"

"তুমি সত্যিই ভালোবাসো অপু দা! আমি সেদিন স্বপ্নে দেখলাম, তুমি গতজন্মে আমার স্বামী ছিলে! আর সেদিন যখন আমায় জড়িয়ে দুষ্টমী করলে খুব যেন পুরোন চেনা কারো হাতের স্পর্শ মনে হচ্ছিল, তখন তো স্বপ্ন টা দেখিনি! কেন আমার এমন মনে হচ্ছে বলো! "

অপু বলল "কী স্বপ্ন আমাকে নিয়ে দেখলি!"

"তুমি আর আমি স্বামী স্ত্রী,অনেক আগের যুগের মনে হয় । কেমন একটা খুব পুরোন মন্দির, তার পাশে আমাদের ছোট বাড়ি, তোমার মা অসুস্থ শয্যাশায়ী, বাবা নেই, দিদিদের বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়িতে। বাড়িতে আমরা শুধু দুজন, নতুন বিয়ে হয়েছে। তুমি এমনই দুষ্টমী করতে, যখন তখন, একদিন স্নান করে খালি শুদ্ধ কাপড় পড়ে ঠাকুরের ভোগ রান্না করছি, সেই সময়ে আমায় নিয়ে এমন শুরু করলে, আবার আমায় স্নান করে ভোগ রাঁধতে হল। আমি কিন্ত খুব সুখী ছিলাম, তোমার এতো ভালোবাসা আর সোয়াগে পাগল ছিলাম। বাপের বাড়িও যেতে চাইতাম না। তারপর কেমন সব খারাপ স্বপ্ন----" , অনু দুঃখে চুপ করে গেল।

অপু বলল, "খারাপ স্বপ্ন তো বলে দিলে মিথ্যা হয়ে যায় ,বলে দে ।"

অনু যেন একটু ভরসা পায়, "বলে আমাদের ছোট গড়ের পুকুরের মত,  তোমাদেরও বাড়ীর উত্তরে একটা ছোট পুকুরে ছিল। তুমি দিন বিকাল হলেই ছিপে মাছ ধরতে, আমি তোমার জন্য মুড়ি নিয়ে যেতাম, কত গল্প করতাম। সেদিন মুড়িতে আদা কুচিয়ে সর্ষে তেল মাখিয়ে ,যা তোমার খুব প্রিয়  ছিল, নিয়ে যাচ্ছি। দেখি পুকুরে উত্তর পাড়ে ছিপে মাছ ধরছ, বাঁশ বনে তোমার ঠিক পিছনে একটা মস্ত বাঘ ! তোমায় তাক করে আছে ,আমি চিৎকার করলাম, তোমার পিছনে বাঘ! জলে ঝাঁপ মারো ,তুমি হতভম্ব হয়ে পিছনে তাকালে, আর বাঘটা ঝাঁপিয়ে পড়ল, তুমি পুকুরের জলে পড়ে গেলে, বাঘটাও জলে ঝাঁপিয়ে তোমায় আক্রমন করল, আমি মুড়ির থালা ফেলে একটা বেড়ার বাঁশ ভেঙ্গে তোমাকে বাঁচাতে জলের উপর দিয়েই ছুটছি ,কিন্ত কিছুতেই এগোতে পারছিনা। তারপর স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।

এরপর দুঃখে আবেগে কেমন অনু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল," মা তুলে দিল, আমি জ্বরের ঘোরে নাকি ঘুমের মধ্যেই খুব চিৎকার আর কান্নাকাটি করছিলাম, কাঁপছিলাম।"

অপু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে।গত জীবনে কতদিন তোকে জ্বালাতন করেছি জানি না। বাঘ মামা কি করেছিল কে জানে! তাহলে তুই আমার তো জন্ম জমান্তরের স্ত্রী! এজন্মেরও! তাই ভেবে আমাকে তুই লজ্জা পারছিস! অমন মুখ নামিয়ে থাকছিস ! পাগলী সে যুগ তো নেই ,স্বামীকে দেখে এখন কেউ মুখ নামায় ! ওসব আগে ছিল। "

অনু লজ্জায় এবার ফুলের সাঁজি নিয়ে দৌড়ে পালাল।

ভারমুক্ত মনে বেশ কদিন পর অপু ছোটগড়ের উত্তরে বাঁশবনের আটকে রাখা ছিপ বের করে ,মাছ ধরতে বসেছিল। তখন বিকাল, অনু চুপি চুপি অপুর পিছনে এসেছে।অপু বুঝতে পারছিল,তবু ভয়ের নাটক করে একটু চমকে উঠে, পিছু ফিরে বলল,"অনু তুই! বাপরে বাপ! আমি ভাবলাম বাঘ!"

"আমি তো তোমার  পিছনে এই জন্যই দাঁড়িয়ে, বাঘটা এলে আগে আমাকে ধরবে ।" তারপর অনু খুব হাসতে লাগল।

"তুই তো ভীষণ চালাক, কেমন উত্তর দিলি! আমি ভাবতেই পারি নি। আমার এজন্মের বৌ তাহলে শুধু সুন্দরীই নয়, বেশ চালাক হবে।"

অনুর মুখ কেমন উদাস একটু হতাশ কি যেন ভাবছে।

অপু বলে" চিন্তা করছিস! কেমন চুপ আছিস যে !"

অনু বিষন্ন দেখাচ্ছিল, বলল,"তোমার দাদা ,তোমার চেয়েও কত বড়, ওরই কবে বিয়ে হবে কে জানে!আর তোমার বিয়ে সেই কবে! ততদিন যদি বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দেয়! এখন থেকেই আমার বিয়ে নিয়ে বাবা মা কত কথা বলে, তুমি আমার মাকে গোপনে বলবে ?"

"পাগল হয়েছিস! কাকীমা কী ভাববে! মাকে বলে দেবে, কী লজ্জা!"

"তাহলে কী হবে অপু দা!"

"অত চিন্তা করিস না ,তোর যখন বিয়ের ঠিক হবে, আমি কাকীমাকে সব বলব, আমি চাকরী পেলে তোকেই বিয়ে করব, অন্য কোথাও তোর বিয়ে যেনো না দেয়। আর মা তোকে খুব ভালোবাসে ঠিক মেয়ের মত, মা নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না। "

হঠাৎই অপু মনে হল মোরল পাড়ার তার বন্ধু সহপাঠী অমলের দাদা,খুব কম বয়সে নেভীতে গেছে ,ভালো বেতন, ভালো চাকরী।পরদিনই সে অমলের কাছে গেল এই বিষয়ে খোঁজ নিতে।অমল জানাল,"আমি তো এয়ার ফোর্সে চাকরীর জন্য এবার দরখাস্ত করেছি। এখনও দরখাস্তের সময় আছে।ষোল থেকে কুড়ি বয়স ,আর মাধ্যমিকে ফাস্ট ডিভিশন বা ষাট শতাংশ নম্বর হলেই চলবে। তোর তো আছে।তুই দরখাস্ত করবি!"

"কিন্ত দরখাস্ত কী করে করব!"

"আমার কাছে একটা টাইপ করা ফাঁকা ফ্রম আছে ভুল হলে আমার লাগত, আমার দরকার পড়েনি, তুই নিয়ে যা,কাকু কামীমাকে বল,দেখ তারা রাজী হবে কিনা!"

মা নমিতা রাজী হয় না, ছোট ছেলে যে তার বড় আদরের দুরে পাঠাবে না। বাবা হরিনাথ না করলেন না।বললেন "দরখাস্ত করলেই পাবে এমন নয় ! পাওয়া কঠিন। কাজ ভালো, আমার স্কুলের হেড স্যারের মেয়ের জামাই তো এয়ার ফোর্সে চাকরী করে, কত গর্ব করে, বিমান চালায়, কত বেতন,কত সুবিধা, আবার আঠারো বিশ বছর বন্ড শেষ হলে অবসর, আজীবন বসে বসে পেনশন, অন্য চাকরী করলেও পেনশন পাবে।"

নমিতাকে বোঝায় "তোমার বড় ছেলে বটানিতে এম এস সি করে বেকার, কলকাতা থেকে আসবে না, প্রাইভেট টিউশন পড়িয়ে মেসে, কত চাকরীর চেষ্টা করছে। কবে হবে কে জানে! আমার আর দুবছর চাকরী আছে, তারপর কী হবে ! তুমি বাধা দিও না, আমারও মনেকষ্ট হবে । কিন্ত সময়টা যে বড় খারাপ, কত শিক্ষিত ছেলে বেকার। জীবন বরবাদ হচ্ছে, অপু যা ভালো চায় করুক।"

নমিতা অগত্যা সম্মতি দিল। অপু দরখাস্ত করল।অমল তাকে অনেক সহযোগিতা করল। 

অনুকে অপু সেদিন বলল,"আমি তোর জন্যই শুধু দরখাস্ত করছি। যদি চাকরিটা হয়, দাদার বিয়ে হোক,না হোক তোকে বিয়ে করে আমার কাছে নিয়ে যাব।"

আনন্দ আর খুশীতে অনুর চোখমুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কত স্বপ্ন সে দেখতে লাগে।

                       ক্রমশ 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance