পরচুলা
পরচুলা


“আমার বলতে খুব খারাপ লাগছে। আপনার এত সুন্দর চুল, কেমোথেরাপির পর কিন্তু সব চুল ঝরে যাবে ।“ কেমোথেরাপির প্রথম দিন ডাক্তার অনিলাকে বললেন।
অনিলা আড়চোখে শ্যামলের দিকে তাকাল, ওর মুখটা করুণ হয়ে গেছে । ও মৃদু হেসে ধীরে ধীরে বলল ,” আমি জানি। ”ডাক্তার বাবু বললেন,” আপনি বরং চুলগুলো ছোট করে কেটে ফেলুন, তাতে trauma টা কম হবে।“
“কে... কেটে দেবো?” শ্যামলের গলা দিয়ে প্রায় আওয়াজ বেরচ্ছেনা অনিলার চুল শ্যামলের খুব প্রিয়। সত্যি কথা বলতে কি, ওর ওই এক ঢাল চুল দেখেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল শ্যামল। শুধু শ্যামলেরই নয় ওদের মেয়ে মঞ্জুলারও মায়ের চুল নিয়ে খুব গর্ব । ক্লাসের সব বন্ধুদের মায়েদের চেয়ে ওর মায়ের চুল লম্বা, প্রত্যেকবার পেরেনট টিচার মিটিং এর পর এসশ্যামলের মুখের দিকে তাকিয়ে, অনিলা বলল,” থাক......, যতদিন আছে। যখন ঝরে পড়বে তখন দেখা যাবে।কিন্তু বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না, এক সপ্তাহের মধ্যেই চুলগুলো ঝরে পড়তে শুরু করল । কেমোথেরাপির দিন সাতেক পর একদিন চুল আঁচড়াতে গিয়ে অনিলা দেখল একটা টেনিস বলের সমান চুলের গোলা হাতে এসে গেল । সবাইকে লুকিয়ে চুলটা ডাস্টবিনে ফেলে দিল ও । প্রত্যেক দিন ঝরে পড়া চুলের সংখ্যা বাড়তে লাগলো । ঝরা চুলগুলো আঁচড়ে ফেলে না দিলে মাথায় অসহ্য ব্যথা হয় । ধীরে ধীরে চুলগুলো মনে হতে লাগল একটা বোঝা । একদিন চুলগুলো লুকিয়ে ফেলতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়ে গেলো শ্যামলের কাছে। শ্যামল স্তম্ভিত হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে, চোখ দুটো ছল ছল করছে জলে। ও শুকনো গলায় বলল, “ এসো তোমার চুল গুলো ছোট ককিন্তু বব কাট চুলে ঝামেলা আরও বাড়লো । আগে চুলগুলো খসে পড়ে চুলের মধ্যেই আটকে থাকতে জটার মত কিন্তু এখন যেহেতু ছোট হয়ে গেছে সারা বাড়িময় চুল । খুব মুশকিল হতে লাগল । শেষ পর্যন্ত একদিন বিকালে শ্যামল ওর ইলেকট্রিক রেজারটা দিয়ে অনিলার মাথা শেভ করে দিতে লাগলো। খনিকটা মাথা কামানো হয়েছে, এমন সময় কোচিং থেকে ফিরে এসে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো মঞ্জুলা । মাকে দেখে ও কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল । তারপর ছুটে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল, বড় হয়ে গেছে মেয়ে । নিজের চোখের জল মাকে দেখাতে চায় না ।
যখন পুরো চুলটা কাটা হয়ে গেল, আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অনিলা। ওর নিজেকে দেখে বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনী মনে হলো । কাঁধে একটা হাল্কা চাপ অনুভব করলো ও। শ্যামল পিছনে এসে দাঁড়িয়ে “ ইউ আর বিউটিফুল।“ ফিসফিস করে ওর কানে বলল শ্যামল।
“আই নো।“ বলল অনিলা।
কিছুদিনের মধ্যেই চোখের পাতা আর ভুরুর চুলগুলোও ঝরে পড়ে গেল অনিলার । আয়নায় নিজেকে দেখে শিঁউরে উঠলো অনিলা । ওর নিজেকে দেখে ‘ অগ্নিপথ’ সিনেমার সঞ্জয় দত্তের মতো লাগলো । তারপর থেকে পারতপক্ষে আয়না দেখেনা ও। শ্যামলের চোখের তারায় খোঁজে নিজের। মুঞ্জুলা আজকাল কমই আসে ওর কাছে। আসলেও বড্ড দূরের লাগে মেয়েকে। মায়ের সামনে নিজেকে স্বাভাবিক দেখাবার অভিনয় টায় এখনও পাকাপোক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। শুধু শ্যামলের মধ্যেই কোন ফারাক নেই। ওর সমস্ত টা দিয়ে আগলে রেখেছে অনিলাকে। দ্বিতীয় কেমোথেরাপি নেবার সময় এসে গেলো।
এই প্রথম অনিলা বিনা চুলে বাইরে বেরবে ।
কেমোর আগের দিন শ্যামল আর মঞ্জুলা বাজারে গিয়ে আই ব্রাও পেনসিল আর একটা খুব সুন্দর পরচুলা কিনে আনল। তারপর বাবা আর মেয়ে মিলে, হসপিটাল যাবার আগে, অনিলাকে পরচুলা পরিয়ে ভুরু এঁকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো । আয়নায় নিজেকে দেখে অনিলার চোখ ছল ছল করে। একদিকে শ্যামল আর অন্যদিকে মঞ্জুলা অনিলাকে ধরে রাস্তায় নিয়ে বেরিয়েছে। অনিলার সেদিন রাস্তায় বেরোতে খুব লজ্জা করছিল, মনে হচ্ছে সবাই ওর দিকেই দেখছে। রাস্তায় রিঙ্কু আন্টির সঙ্গে দেখা। রিঙ্কু আনটি ভুলভাল জায়গায়, ভুলভাল কথা বলার জন্য বিখ্যাত। উনি জানেন যে অনিলার চুল কেটে দেওয়া হয়েছে । অনিলাকে দেখেই ভালোমানুষের মত মুখ করে জিজ্ঞাসা করে বসলেন, “আরে অনিলা, কেমন আছ? এটা কি তোমার নিজের চুল। শুনেছিলাম তোমার .....অনিলা আর শ্যামল হঠাৎ করে যেন পাথর হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে সবাইকে অবাক করে দিয়ে মঞ্জুলা হেসে বলে উঠলো,”হ্যাঁ এটা আমার মায়েরই চুল । আমি কিনে দিয়েছি। যেমন জামা, জুতো, ব্যাগ কিনে দিয়েছি। এখন অগুলো সবই আমার মায়ের । কি সুন্দর দেখাচ্ছে, ওর জবাব শুনে রিঙ্কি আনটি কেমন যেন থতমত খেয়ে গেলেন, আর আমতা আমতা করে বলে উঠলেন, “তা তো বটেই, তা তো বটেই!” বলেই পা চালিয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা হলেন “ইউ আর দ মোস্ট বিউটিফুল মম“, বলে মঞ্জুলা অনিলাকে জড়িয়ে ধরল। অনিলা, মঞ্জুলা আর শ্যামলকে সজলচক্ষে জড়িয়ে ধরে বলল, “ আই নো......।“