।।ফিরে দেখা।।
।।ফিরে দেখা।।


আমার চোখে আজও সেই দিন স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। চারিদিকে বই খাতা ছড়ানো ছিটানো, কলের উপর রাখা আমার মাসের মেনে থেকে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে কেনো ল্যাপটপটা। শুধু চেষ্টা আর চেষ্টা; কিভাবে ওদের জীবনে সফল করা যায়। ছেলে মেয়েগুলোর মধ্যে প্রতিভা আছে, মনে ইচ্ছে আছে, তবে সাথে নেই সফল হয়ে ওঠার পরিস্থিতি। চোখের সামনে আমি দেখতে পাচ্ছি, এই পঞ্চাশজন যখন আমার ভাড়া বাড়িটার ঠিক পাশের বস্তিতে থাকতো। আমার চেয়ে বয়সে খুবই ছোট ওরা; সেই সময় আমি একটা প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি করছি আর ওরা খুব কষ্ট করে অন্তত নাইট স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে। ওরা জানে যে ওদের কেউ সুযোগ করে দেবে না, তাই নিজেরাই সুযোগ করে নিচ্ছে। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে এদের নাইট স্কুলে যাওয়া দেখতাম। হঠাৎ একদিন শুনলাম পাড়ার নাইট স্কুলটা এই ছোটছোট সপ্ন দেখা চোখগুলোকে গভীর ঘুমের দেশে পাঠিয়ে দিয়ে বন্ধ হয়ে গেলো। শুনেছিলাম সেদিন এদের বুক ভাঙ্গা কান্না। নিজের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। একদিন এরকমই খড়কুটো থেকেই উঠে এসেছিলাম।
দেরী না করে শুরু করলাম এদের পড়ানো। বুঝতে শিখলাম কাঁচা মাটি কি আর প্রতিভা কাকে বলে। উদ্দেশ্য শুধু একটাই এদের প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে, যাতে সমাজ জানে আর বোঝে যে কেউ ফেলনা নয়। মনের জোর থাকলে সব সম্ভব, আর হলোও তাই। নিজেদের পছন্দের বিষয় বেছে নিয়ে কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ডাক্টার, কেউ বা আবার খুব বড় উকিল হলো। যে সমাজ সেদিন তাদের পায়ের তোলার পিছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, আজ সেই সমাজই এদের ছাড়া অচল।
যেদিন এরা সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের নিজের কাজের পথে পারি দিল সেদিন আমায় বলেছিল -
" আপনাকে কোনোদিন ভুলবো না। "
ভেবেছিলাম তা হয়তো সম্ভব নয়। তবে আজ দেখছি সত্যিই সম্ভব। ওরা সবাই আজ সারি বদ্ধ হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। তবে কারো মুখে হাসি নেই, তার বদলে রয়েছে চোখের কোণে জল। ওদের মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এসে একটা রজনীগন্ধার তোরা আমার সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা শরীরের বুকের উপরে রেখে দিল। নিজের মৃত দেহের পাশে বসে আমি আজ সবকিছু দেখছি, সবাইকে দেখছি তবে কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। শুনতে হয়তো পাবে না। বুকের ভিতরটা হুহু করে উঠলো। নিজের অজান্তেই বলে উঠলাম -
" তোরা আমাকে ভুলে যাসনি বল!"
অবাক হয়ে দেখলাম পঞ্চাশজন একসাথে দাঁড়িয়ে; কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ডাক্টার, কেউবা আবার উকিল; আমার মৃত দেহের দিকে তাকিয়ে বলছে -
"ভুলিনি... আমরা কেউ আপনাকে ভুলিনি..."