Priyanka Banerjee

Inspirational Thriller Others

3  

Priyanka Banerjee

Inspirational Thriller Others

।।জয়া।।

।।জয়া।।

11 mins
245


স্কুলিং ইন্ডিয়ায় করার পর, কলেজ করেছি লন্ডন থেকে। কলেজ শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই ইন্ডিয়ায় আবার ফিরে এসেছিলাম। তখন জাস্ট কিছুক্ষণ আগেই এয়ারপোর্ট থেকে চেক আউট করে বেরিয়েছিলাম। একটা শেয়ার ক্যাব বুক করেছিলাম, সেটা আসার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আর কি। বাড়িতে খবরটা দিয়ে দিয়েছিলাম যে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গেছি, ক্যাবের জন্য ওয়েট করছি। লাগেজ সাথে ছিল তবে সেটা শেয়ার ক্যাবে না তুলতে পারার মত নয়। একা ছিলাম, শেয়ার হয়তো নিতাম না তবে শেয়ারের গাড়ি ছাড়া অন্য কোন গাড়ি আর পাইনি , সব নাকি আগে থেকে বুকিং করা। তাই বাধ্য হয়েই শেয়ার ক্যাব নিতে হয়েছিল।


        গাড়ির বুকিং তো করেছিলাম, তবে সে গাড়ি আসার কোন নামগন্ধ দেখছিলাম না। ওয়েট করছিলাম বেশ খানিকক্ষণ। এছাড়া আর উপায় তো অন্য ছিলনা। ওই মুহূর্তে এয়ারপোর্টে যে জায়গাটাতে আমি দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক তার পাশেই আরেকটি মেয়ে একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বাচ্চা ছেলেটির বয়স সাত নয়তো আট বছর হবে। অন্যদিকে মেয়েটির বয়স আমারই মত, বাইশ কি তেইশ বছর । দু'জনের মুখের বেশ মিল। দেখে মনে হল বোধহয় ভাই বোন। ওরাও এয়ারপোর্ট থেকে চেক আউট করেই বেরিয়েছে। তবে আমার ফ্লাইটে এরা ছিল না। বাচ্চা ছেলেটা কেমন যেন থেকে থেকে ঝিমিয়ে পড়ছিল তখন। মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরছিল দুটো ছোট ছোট হাতে। মেয়েটি বাচ্চাটার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে ইংরেজিতে বলছিল যে গাড়ি ডাকা হয়েছে , গাড়ি এসে গেলেই সেই গাড়িতে উঠে ঘুমোতে পারবে। বুঝতেই পারছিলাম যে অনেকটা জার্নির পর বাচ্চাটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ঘুম পেয়েছে বেচারার। এরাও তাহলে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে! মেয়েটিও ছেলেটিকে চেহারা কিংবা পোশাক-আশাক দেখলে তারা ইন্ডিয়ার বাইরে থাকলেও ভাই ইন্ডিয়াতেই অন্য কোন স্টেটে থাকলেও তারা যে ইন্ডিয়ান এটা ভালোভাবে বোঝা যায়। বেশ অনেক্ষণ ধরেই ছেলেটি ও মেয়েটি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, মনে মনে ভাবছিলাম, একটু আলাপ জমালে কেমন হয়! আবার পরক্ষনেই মনে হলো, 'না থাক! কি দরকার? আমি নয় নিজে থেকে কথা বলতে যাব, সেটা ওরা যদি খারাপ মনে করে, আর খারাপ মনে করে যদি আমাকে আরো দু চারটে বাজে কথা শুনিয়ে দেয়, তখনই ভরা এয়ারপোর্টের সামনে আমার একেবারে প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে, তার থেকে বাবা থাক দরকার নেই। তাছাড়াও খানিকক্ষণ এর মধ্যেই হয়তো গাড়ি এসে যাবে, কি হবে কথা বলে এখন। এইটুকু সময়ের মধ্যে এত পরিচয় পর্বটাও শেষ হবে না। তার থেকে থাক!'


          এই সমস্ত ভাবতে ভাবতেই দেখলাম একটা শেয়ার ক্যাব ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বুঝতে পারলাম যে এটাই সেই গাড়ি যেটা আমি বুক করেছি। তবে অফ রুট বলে বোধহয় কোন প্যাসেঞ্জার নেই। যাক, যতটা ফাঁকায় ফাঁকায় নিজের মত যাওয়া যায়! গাড়িটিকে এগিয়েই, নাম্বার প্লেটের নজর রেখে, যেইনা ওটিপিটা বলেছি, অমনি দেখি কিনা সেই মেয়েটি ও বাচ্চা ছেলেটি ও তাদের লাগেজ নিয়ে ঠিক এই গাড়িটার দিকে এগিয়ে আসছে। তার মানে কি ইরাও এই গাড়িটাই বুক করেছে? হতেও পারে। ঠিক তাই হলো। নিজেদের ওটিপি দিয়ে ওরাও এই গাড়িটাতেই উঠলো। 


        গাড়ির পেছনের সীটে আমরা তিনজন উঠলাম। একটা জানলার ধারে বাচ্চা ছেলেটা আর অন্য জানলার ধারে আমি বসলাম। ছেলেটা গাড়িতে উঠে মেয়েটার কোলে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ল। মেয়েটা বসেছিল ঠিক আমার পাশে। মনে মনে ভাবছিলাম যে এবার একটু কথা বলি। যেই না ভাবা অমনি আমাকে আর কিছু বলতে হলো না। মেয়েটিই হাসি মুখে আমাকে বলল-


"হ্যালো!"



আমি প্রথমে একটু চমকে গিয়ে তারপর বললাম-



"হাই! "



অন্যদিক থেকে আবার প্রশ্ন এল-



"হোয়ার আর ইউ ফ্রম? আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?"



আমি বললাম-



"ইয়েস অফ কোর্স! আই এম ফ্রম ইন্ডিয়া, এন্ড ফ্রম কলকাতা অনলি।"



মেয়েটি বলল-



"ও! নাইস টু মিট ইউ। আই এম অলসো ফ্রম কলকাতা। তুমি কি বাঙালি?"



এবার কথোপকথন শুরু হলো-



"হ্যাঁ আমি বাঙালি। প্রাপ্তি সেনগুপ্ত। আর তুমি?"



"আমিও বাঙ্গালী। আমার নাম জয়া মিত্র। তোমার ব্যাগে এখনো ফ্লাইট একটা লাগানো আছে, লন্ডনে কি পড়াশোনার জন্য থাকতে?"



"হ্যাঁ গো। পড়াশোনার জন্যই। স্কুলিং এখান থেকে করার পর কলেজটা লন্ডন থেকেই করেছি। তবে তোমার ব্যাগে ফ্লাইট একটা দেখছি না। তাই এগজ্যাক্টলি বুঝতে পারছিনা তুমি কোথা থেকে আসছো। বাইরে কোথাও গিয়েছিলে নাকি দেশের ভেতরে অন্য স্টেটে?"



"দেশের ভেতরেই অন্য স্টেটে। আসলে আমি হায়ার স্টাডি ব্যাঙ্গালোর থেকে করেছি। তাই পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর আবার কলকাতায় ফিরে এলাম।"



"ও আচ্ছা। তা এখন আপাতত বাড়ি যাবে তো?"



"হ্যাঁ।"



এইটুকু কথা বলার পরেই বাচ্চা ছেলেটা একটু নড়ে উঠলো। মনে হল যেন একটু ঘুমের ঘোর টা কেটেছে। তবে না। একটু নড়ে ওঠে এই আবার আগের মতোই শুয়ে পড়ল। জয়ার সাথে কথা বলতে বলতে বাচ্চাটার দিকে অতটা খেয়াল ছিল না। জয়াও বেশ মন দিয়েই আমার সাথে কথা বলছিল। এবার বাচ্চাটা নড়ে উঠে ও ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিল। এই দেখে আমি বললাম-



" তোমার ভাই কিন্তু খুব মিষ্টি। তোমাদের দুজনের মুখেরও খুব মিল আছে। কি নাম ওর? কোন ক্লাসে পড়ে?"



জয়া উত্তর দিল-



" হ্যাঁ ও ভীষণ মিষ্টি। তবে এখন ঘুম পেয়েছে বলেই তাই, না হলে দেখতে ভীষণ দুষ্টুও। ওর নাম অভয়। অভয় মিত্র। ক্লাস টুতে পড়ে এখন। আর বাই দ্যা ওয়ে, যদিও তোমার কোন দোষ নেই সবাই এটাই ভেবে থাকে, কিন্তু সত্যি এটাই যে ও আমার ভাই নয়।"



মনে একটা ভীষণ কৌতুহল জাগলো জোয়ার এই কথায়। ভাই নয়তো কে ও? জিজ্ঞাসা করলাম জয়াকে-



"ভাই নয়? তাহলে কে হয় ও তোমার?"



জয়া যেন এক প্রশ্নে কোথাও একটা হারিয়ে গেল। এরপর বলল-



"না প্রাপ্তি, অভয় আমার ভাই নয়। ও আমার ছেলে। এডপ্টেড ভেবোনা, ও কিন্তু আমার বায়োলজিক্যাল চাইল্ড।"



অবাক হয়ে গেলাম জোয়ার এই কথায়। কি বলছে ও? কি করে সম্ভব? তবে কি এই হাসি মাখানো মিষ্টিমুখটার পেছনে বহু ক্ষত কান্না লুকিয়ে আছে? জয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম-



"আই থিঙ্ক ইউ ডোন্ট মাইন্ড মি আস্কিং দ্যাট তোমাকে তো দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমারই মত 21 কি 22 বছরের। তাহলে এত তাড়াতাড়ি তোমার ৭ কী ৮ বছরের একটা ছেলে... কি ব্যাপার আসলে?"



এই কথায় দেখলাম জয়ার চোখ দুটো একটু ছল ছল করে উঠলো। জয়া বলতে শুরু করল-



"আমি বাড়িতে আমার মা বাবার সাথে থাকি না। আমি আমার অভয়কে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকি। যদিও সেটাই এখন আমার নিজের বাড়ি। যে বাড়িতে ছোট থেকে বড় হলাম, সে বাড়িতে এখন আর আমি নিজের বলে মানি না।"



"কিন্তু কেন জয়া? হ্যাঁ অবশ্যই যদি তুমি আমার সাথে শেয়ার করতে চাও তাহলেই বল, নয়তো আমি তোমাকে জোর করব না।"



"না না প্রাপ্তি। এখানে শেয়ার না করার মত কিছু নেই। শোনো তাহলে, তোমাকে সেই গল্প বলি। ছোট থেকেই আমি পড়েছি একটি কোয়েড স্কুলে। সবই ঠিকঠাক ছিল জানো, শুধু সমস্যাটা হলো যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। তখন আমার 14 বছর বয়স। আমার থেকে দু ক্লাস সিনিয়ার একটা ছেলের আমাকে খুব পছন্দ হয়। সেই ছেলে ছিল ভিষন বড়লোক। কোন জিনিসে ছোট থেকে কখনো 'না' শোনে নি। তাই বোধহয় আমার ক্ষেত্রেও ভেবেছিল আমিও না বলবো না। কিন্তু সেটা হয় না। নানান রকমের ইঙ্গিত। নানান রকমের কাছে আসার চেষ্টা। আর শুধু কি তাই, তার সাথে নানান রকমের অশ্লীলতা। এইসব এরপরেও আমি 'না' করি। ওর সাথে সম্পর্ক রাখার প্রস্তাবটা আমি নাকচ করে দি। এটাই মেনে নিতে পারেনি সে। ইগো হার্ট হয়। আর ওই যে, এই ছেলেটি যখন ছোট ছিল এর মা-বাবা এ কখনোই সে রকম সময় দেয়নি। তার বদলে নানান রকমের খেলনা অন্যান্য লাক্সারিয়াস আইটেম দিয়ে একে ওই 'আমাকে কখনো কেউ না বলতে পারবেনা' এই ব্যাপারটা তৈরি করে দিয়েছে। আর আমি জানিনা আমাদের সমাজে কিছু মা-বাবা কেন তাদের ছেলেদেরকে ছোট থেকে শেখায় যে তারা কখনো কষ্ট হলে কাঁদতে পারবে না। কান্নাটা শুধুমাত্র মেয়েদেরকেই মানায়। এই জিনিসটাই পরবর্তীকালে সবচেয়ে বড় ইসু হয়ে দাঁড়ায়। তারা তাদের ইমোশনস গুলো ঠিকমতো এক্সপ্রেস না করতে পারা থেকেই ভুল রাস্তায় চলে যায়। তারা ইমোশনগুলো চেপে রাখতে রাখতে সেটাকে রাগে বদলে ফেলে আর সেই রাগ তারা বের করে কোন একটা মেয়ের উপরে, কিংবা এমন কারোর উপরে যে তাদের কাছে কমজোরি। ঠিক এই জিনিসটাই হয়েছিল আমার সাথে। আমার 'না' শোনার পরে সেই ছেলেটির যে প্রচন্ড রাগ হয়েছিল সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। এরপর একদিন সন্ধ্যেবেলায় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে টিউশান ক্লাস থেকে বাড়ি ফিরছি, ঠিক সেই সময় সেই ছেলেটি আরও পাঁচটি ছেলেকে নিয়ে এসে ওই ফাঁকা রাস্তায় আমাকে ধর্ষণ করে। সেদিন হয়তো মরেই যেতাম। তবে ওই যে 'রাখে হরি তো মারে কে', হঠাৎ সেই ফাঁকা রাস্তায় কোথা থেকে যেন দু'চারজন লোক এসে পড়ায় ওই ছেলেগুলো আমাকে ফেলে রেখে পালায়। সেই দু চারজন লোক আমাকে সেদিন বাড়ি পৌঁছে দেয়। বাড়িতে মা যখন ব্যাপারটা শোনে তখন আমাকে ভালো করে স্নান করে নিতে বলে। বাবা অফিসে ছিল তখন‌। বাড়ি ফিরে সব কথা শুনলে বলে যে ওই ফাঁকা রাস্তা দিয়ে আমি যেন আর কোনোদিনও না ফিরি। কেউ পুলিশ কম্প্লেইন করল না। আমাকেও পুলিশকে কিছু জানাতে দিল না। পুলিশকে জানালে তারা নাকি আমাকে এমন কিছু প্রশ্ন করবে যাতে আমি অকওয়ার্ড ফিল করব। তাছাড়া নাকি এসব কথা বাইরে জানাজানি হলে আমার বাড়ির লোক আর কোথাও মুখ দেখাতে পারবে না। ঘটনাটা তো ঘটেছিল আমার সাথে। ভিকটিম ছিলাম আমি। অপমানিত যদি হতে হয় তাহলে ওই ছেলেগুলো কে হতে হবে, যারা আমার সাথে জানোয়ারের আচরণটা করেছিল। আমাকে কেন অপমানিত বোধ করতে হবে? কেনই বা আমার বাড়ির লোক কারো সামনে মুখ দেখাতে পারবে না? ওই ঘটনার পরে ওই ছেলেগুলো আজও বুক ফুলিয়ে রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওদের শাস্তি হয়নি। উল্টে এক প্রকার শাস্তি যেন পেয়েছিলাম আমি। ভীষণ রাগ হয়েছিল তখন। তাও সে রাগটা কে মনের মধ্যে চেপে রেখেছিলাম। রাখতে পারিনি তখন যখন আরেকটা ঘটনা ঘটলো। এই ঘটনার একমাস পরেই আমি অভয়কে কনসিভ করি। সেই কথা যখন আমি বাড়িতে জানাই। ব্যাপারটাকে মেনে নেওয়া তো দূরের কথা, মা বাবা বলল বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলতে। ওই পাপের বিজ নাকি তারা আমার শরীরে রাখতে দেবেনা। ভীষণ রাগ হয়েছিল তখন, তার সঙ্গে কষ্টও। ওই অপরাধের মাসল আমার মধ্যে যে বড় হচ্ছে সে কেন দেবে? তার কি দোষ? সে তো আর ঘটনাটা ঘটায়নি, তবে? কেন মেরে ফেলবো একচিলতে প্রাণকে? কেন বাঁচতে দেব না তাকে? সে তো সম্পূর্ণ নির্দোষ, নিষ্পাপ। হাঁটছি আমার মধ্যে বড় হচ্ছে তাকে নষ্ট করা মানে তো খুন করা। আমি খুনি হয়ে বাঁচতে পারব না। মা বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। তারা কিছুতেই বুঝতে চায় না। যখন তারা একেবারেই বোঝেনা তখন আমি নিজের রাস্তাটা নিজেই বেছে নি। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসি ওই অবস্থায়। তারপরে মা-বাবা আমাকে খুঁজেও পেয়েছিল। তবে আমি আর ফিরিনি। শর্ত দিয়েছিলাম যে আমাকে ওই বাড়িতে আবার তুললে যে আসছে তাকেও গ্রহণ করতে হবে। এই শর্তে খুব স্বাভাবিকভাবেই ওরা রাজি হয়নি। আর আমি ফিরিনি, আর কোন যোগাযোগ রাখিনি ওদের সাথে। একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করি। সে বাড়ির যে ল্যান্ডলেডি ছিলেন তিনি ভীষণ ভালো মানুষ। তিনি আমাকে সেই অবস্থায় খুব সাহায্য করেছিলেন। ওই নটা মাস ওনার সাহায্য নিয়েই নিজের খেয়াল রাখি ও পড়াশোনা চালিয়ে যাই। এরপর অভয়ের জন্ম হয়। ওর জন্মানোর পর আমি একটু সুস্থ হয়ে গেলে। একটা হোটেলে ওয়েট্রেসের কাজ করতে শুরু করি। ল্যান্ড লেডি একজন বয়স্ক ও একা মানুষ ছিলেন। দুটো মানুষের খরচা চালানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে আমার সেই দিন থেকেই আমি এখনো ওনাকেই আমার মা বলে মানি। তখন আমার মাথায় একেবারে জেদ চেপে গিয়েছিল। ঠিক করে নিয়েছিলাম যে নিজের পড়াশোনা তো চালাবই, তার সাথে সাথে অভয়কেও মানুষ করব। একাই সামলাতে পারবো আমি। কাউকে লাগবে না। সেই সময় আমার যা বয়স ছিল তাতে ওয়েট্রেস ছাড়া অন্য কোন চাকরি আমি পেতাম না, তাই বাধ্য হয়ে আমাকে সেই চাকরি করতে হলো। কাজের মধ্যেই নিজের খরচে পড়াশোনা চালিয়ে যেতাম। আর আমি যখন কাজ করতাম তখন অভয়কে বেবি কেরিয়াজের মধ্যে নিয়ে কাস্টমারদের খাবার সার্ভ করতাম। ভীষণ বাজে কথা শুনতাম অনেকের কাছ থেকে। আসলে কেউ তো জানতো না সত্যিটা কি। তাই যে যা পারতো তাই বলতো। তবে কেউ কি কখনো ভেবে দেখেছে যে এই সমাজে একা একটা মেয়ের কত কষ্ট? একা একটা মেয়ে কি করে ঘরে ও বাইরে দুই একসাথে সামলায়? ধর্ষণের পরে মেয়েটার কি দোষ? কখনো কি কেউ ভেবে দেখেছে? না দেখেনি। দেখলে সমাজ আজ এরকম হতো না। সমাজ ভীষণ স্বার্থপর। সমাজ যখন স্বার্থপর হতে পেরেছে আমাদের দিকে, তখন আমরাও স্বার্থপর হবো। আমিও শুধুমাত্র আমার আর অভয়ের কথাই ভাববো। তা সে যে যাই বলুক। যে আমাদের যে চোখেই দেখুক, আমার কিছু যায় আসে না। আমি এখানে থেকে নিজের খরচা চালিয়ে স্কুলিং শেষ করি। অভয়কে একটা নার্সারী স্কুলে ভর্তি করি। তারপর হায়ার স্টাডিজ জন্য ব্যাঙ্গালোরে চলে যাই অভয়কে নিয়ে। ওখানে গিয়ে একটা কল সেন্টারে কাজ শুরু করি। অভয়কে ওখানে আবার একটা স্কুলে ভর্তি করি। নিজের পড়াশোনার অভয়ের পড়াশোনার খরচ সবটাই চালাতে সক্ষম হই। তারপর আমার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে, ব্যাঙ্গালোরের পাট চুকিয়ে আবার এখানে ফিরে এলাম। এখন পার্মানেন্টলি এখানেই থাকবো। একটা ফার্মে এখন লিগ্যাল এডভাইজারের চাকরি পেয়েছি। ভালো মাইনের। এখানের একটা স্কুলে অভয়ের এডমিশনও হয়ে গেছে। ওকে আমি ছোট থেকে শিখিয়েছি, কোন ভাল মানুষকে আঘাত না দিয়ে কথা বলতে, কোন ভাল মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার না করতে, সব ভালো মানুষকে সম্মান দিতে, সব ভালো মানুষের ইচ্ছাকে সম্মান করতে, আর কারুর 'না' বলাটাকে 'না' বলে মেনে নিতে, কোন ভাল মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে কখনো জোর না করতে, আর সব শেষে শিখিয়েছি নিজেকে সময় দিতে, ভালো মন্দ বিচার করতে ও ও কষ্ট হলে কাঁদতে; কারণ কান্নাটা একেবারেই পিওর ইমোশন। এরমধ্যে ছেলে মেয়ের কোন পার্থক্য হয় না। ওই না কাঁদতে পারলেই, কষ্টগুলো জমতে জমতে রাগে পরিনত হবে, আর সেই রাগের ইগো স্যাটিসফ্যাকশন হবে অন্য একজনের উপর দিয়ে। ওকে আমি যেমন তৈরি করেছি ও ঠিক সেভাবেই বড় হচ্ছে। কিন্তু যারা আগে থেকেই বিপথে চলে গেছে তাদের আর ঠিক পথে আনার উপায় নেই। তাদের থেকে নিজেদেরকেই বাঁচতে হবে। তাই স্কুলে থাকাকালীন আমি আমার কিছু বান্ধবীদের নিয়ে একটা দল তৈরী করি যার নাম দিই 'ফাইট ব্যাক'। এটা এখন একটা এনজিও যেখানে আমরা সেইসব নিপীড়িত মেয়েদের লড়তে শেখায় আর নতুন করে বাঁচতে শেখায় যাদের দিনের-পর-দিন অত্যাচারিত হতে হতে বাঁচার ইচ্ছেটাই চলে যায়। বাঁচার ইচ্ছে চলে গেলে তো হবে না। বাঁচতে হবে নিজেকে, লড়তে হবে নিজেকে, থেমে থাকার সময় নেই আর হেরে যাবার জায়গা নেই। আমি ব্যাঙ্গালোরে থাকলেও এটার কাজ একটিভ থাকে তখনও। এখানেও আমাদের সেই ল্যান্ডলেডি ভীষণ ভাবে সাহায্য করেছিলেন। এখন আমি তোমাকে যে ফ্ল্যাটে থাকার কথা বললাম সেই ফ্ল্যাটটিও ওনার। ওটা ফাঁকা পড়েছিল। পরে আমি ওটা কিনেনি। এখানে থেকে আমার অভয় পড়াশোনা করবে। মানুষের মত মানুষ তৈরি হবে‌। ওই ল্যান্ডলেডিকেও দিদিমা বলে মনে করে‌। আমি আজও জানি না অভয়ের সত্তিকারের বাবা কে। তবে ও আমাকে সেসব কথা কখনো জিজ্ঞাসা করেনি। ও কিছু জানে না। আজ এখন যদি ঘুমের ঘোরে শুনে থাকে তাহলে হয়তো জানবে!"



এই বলে জয়া থেমে গেল। এবার আমি বললাম-



"সত্যিই জয়া, তুমিই হলে রিয়েল ফাইটার। দেবী দুর্গাকে কখনো চোখের সামনে দেখি নি। তবে তোমাকে দেখে আজ মনে হচ্ছে ,হ্যাঁ, সত্যিই দেবী দুর্গাকে চোখের সামনে দেখলাম। খুব ভালো লাগলো তোমার সাথে দেখা হয়ে, তোমার সাথে কথা বলে। তোমার ফোন নাম্বারটা পেতে পারি? তাহলে সত্যিকারের দুর্গা সাথে যোগাযোগ রাখা যাবে।"



জয়া হেসে বলল-



"নিশ্চয়ই পেতে পারো। এই নাও আমার কার্ড। এটাই আমার ফোন নাম্বার আছে।"



          এরপরে একটা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে জয়া গাড়ি দাঁড় করাতে বলল। তারপর অভয়কে নিয়ে ও যেই না গাড়ির বাইরে নেবে ড্রাইভারকে গাড়ির ভাড়া দিতে গেল, অমনি ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে জয়াকে একটা স্যালুট করে বলল-



"দিদিভাই, ও টাকা আমি নিতে পারবো না। ওটা আপনি রাখুন। আপনি যা কাজ করছেন তার তুলনা হয়না। আপনি আর আপনার ছেলে দুজনেই খুব সুখে থাকবেন ভালো থাকবেন, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।"



           জয়া ভাড়া মেটানোর জন্য অনেক জোর করলো। ড্রাইভার কিছুতেই সে ভাড়া নিল না ওর কাছ থেকে। এরপর অভয়কে নিয়ে, নিজেদের লাগেজ নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে চলে গেলো জয়া। গাড়ি আবার আমাকে নিয়ে ছুটতে শুরু করলো ডেস্টিনেশনে। 


           আমার হাতে তখন জয়ার দেওয়া ফোন নাম্বার লেখা কার্ডটা ছিল। সেটাকে দেখতে দেখতেই মনে মনে ভাবলাম, অভয়ের মা জয়ার জয় হবেই, ওর জয় কেউ আটকাতে পারবেনা। কারণ জয়া হেরে যেতে শেখেনি। ও জানে যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাড়াতেই হয়। ও জানে নিজে এগিয়ে যেতে আর সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সমাজকে ঠিক পথে চালিত করতে। জয়ের মতো মেয়েরা বা মায়েরা সকলের কাছে অনুপ্রেরণা। কারণ তারা পিছিয়ে যায় না। তাদের পিছিয়ে যাওয়ার সময় নেই।।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational