ফেরা
ফেরা
চোখের ওপর আলোর তীব্র খোঁচা এসে লাগতে আমার জ্ঞানটাও ফিরে এলো যেন। চোখের পাতা কষ্ট করে খুলেই ফেললাম। এ আমি কোথায় পড়ে আছি? ঝরনার পাড় কাদা মাটি শ্যাওলা চারদিকে! এ কোথায়? উঠে বসতে গেলাম। উঃ হাঁটুর যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলাম। কি হয়েছে আমার পায়ে? এবার চেষ্টা চরিত্র করে উঠেই বসলাম। হাঁটুটায় গর্ত হয়ে কেটে গেছে। কিসে কাটলো ঠিক বুঝতে পারলাম না। হাতে পায়ের অনেক জায়গায় কেটে ছড়ে গেছে। কপালেও খুব ব্যাথা লাগছে, ঠিক ডান ভ্রূর ওপর। কেটে গেছে মনে হচ্ছে! মুখের কিছু হয়নি? হাত বুলিয়ে বুঝলাম না। কিন্তু হাত দুটো তুলতে চোখে পড়লো হাত ভর্তি কাদা। ধুয়ে ফেলতে হবে। হ্যাচড় প্যাচড় করে এগিয়ে গেলাম জলের দিকে। অনেক কষ্ট করে জলের ওপর ঝুঁকে পড়লাম। বয়ে যাওয়া জলে হাত দুটো কচলে কচলে ধুয়ে নেওয়ার পর মুখটাও ধুলাম। খুব জল তেষ্টা পাচ্ছে। সেই জলই আঁজলা ভরে খেয়ে নিলাম, যে আমি কোনদিন কেনা জল ছাড়া মুখে ছুঁইয়েও দেখিনি। জল খেতে শরীরে যেন একটু সাড় এলো। বয়ে যাওয়া জলে আবার চেহারাটা দেখার চেষ্টা করলাম। অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকার পর বুঝতে পারলাম। কি বিভৎস হয়েছে মুখটা। নিজের চেহারা দেখে নিজেই আঁতকে উঠলাম। এই কি আমি? তন্দ্রা সেনশর্মা! না কি অন্য কেউ? কিন্তু আমার তো স্মৃতি বিস্মৃত হয়নি তাই একটু একটু করে মনে পড়ে যেতে লাগলো আগের ঘটনা। গাড়ি নিয়ে সেবক রোড ধরে ফেরত যাচ্ছিলাম শিলিগুড়িতে।
জোনাকি চঞ্চল রুদ্র আর আমি, আমরা চারজন ফিরছিলাম গ্যাঙ্গটক থেকে। পুজোর ছুটিতে আমরা এসেছিলাম দার্জিলিং বেড়াতে। ওখান থেকে সিকিম। গাড়ির চালকের আসনে ছিলাম, বেশ লাগছিলো পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে আসতে। নতুন গাড়ি কিনেছি অফিসে পদন্নোতির পর। কিন্তু একটা সরু বাঁকে পৌঁছতে কি ভাবে যে গাড়ির দরজাটা খুলে গেলো কে জানে আর আমি স্রেফ পুতুলের মতো গড়িয়ে পড়ে গেলাম গাড়ি থেকে। আর পড়ে নীচের দিকে গড়িয়েই যেতে থাকলাম নিজেকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারলাম না। আমার চারদিকে বড় বড় আর লম্বা লম্বা গাছের সারি। এখানে ওখানে ঠোকর খেতে খেতে কখন আমি নীচে এসে পৌঁছেছি কে জানে? শেষ পর্যন্ত আমার জ্ঞানও ছিল না। একবার ওপরের দিকে তাকালাম, কিছুই চোখে পড়লো না, শুধু ঘন বনাঞ্চল ছাড়া। তার মানে রাস্তা এখান থেকে অনেক ওপরে। সেখান থেকে পড়ে গিয়েও আমি বেঁচে আছি এখনো, ভাবতেই পারছি না। এটা কি ওপরওয়ালার দয়া? নিশ্চই তাই নাহলে যেভাবে আমি পড়ে গিয়েছিলাম তাতে মানুষ বেঁচে ফেরে না।
এবার তো ওপরে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সারা শরীরে যা অসহ্য যন্ত্রণা যে আমার মন চাইলেও শরীর সাথ দিতে চাইলো না। খানিক বিশ্রাম নিয়ে নিই আগে তারপর দেখা যাবে। নিজেকে কোন মতে একটা চ্যাটালো পাথরের ওপর টেনে নিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে গা এলিয়ে দিলাম। ঘুম নেমে এসেছিলো ক্লান্ত শরীরে।
যখন ঘুম ভাঙলো তখন বুঝতে পারলাম না দিন আর রয়েছে নাকি রাত নেমে এসেছে।
প্রশ্নের পর প্রশ্ন মনে উঠে আসতে লাগলো। গাড়িটা কি স্কিড করেছিলো, মনে তো হচ্ছে না। তাই যদি হত তাহলে সবাই গাড়ি শুদ্ধ খাদে গড়িয়ে পড়তো আমার মতো কিন্তু সেরকম হয়েছিলো বলে মনে হচ্ছে না। গাড়ির দরজাটা হঠাৎ খুলে গিয়েছিলো যেটা অস্বাভাবিক। নতুন গাড়ির দরজার লক তো ঠিকই ছিল। তাহলে? এটা চক্রান্ত?! আমাকে মেরে ফেলার। মনে হচ্ছে ওরা তাই চেয়েছিল কারণ গাড়িতে ওরা চারজন ছাড়া আর কেউ ছিল না তো।
************
হোটেলের ঘরে পার্টি চলছে। জোনাকি গ্লাসে মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে কিন্তু কিছু বলছে না। চঞ্চল বলল “কি রে তোরা এতো চুপ কেন? মনে হচ্ছে তন্দ্রার জন্য শোক প্রকাশ সভা ডেকেছি”
রুদ্র
বলল “ঠিকই বলেছিস। বেটি মরে গিয়েও আমাদের শান্তি দিচ্ছে না”
জোনাকি বলল “আমার এখনো ভয় হচ্ছে কে জানে কোন দিন আবার পুলিশ ওর ব্যাপারে নতুন কিছু তথ্য নিয়ে হাজির হয়। কোন ক্লু তো রাখিনি যে আমরা ওকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়েছিলাম। ওর মাও কিছুই জানতে পারতো না যদি না সৌরভ ওর খোঁজে ওদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হতো। কারণ শুধু ও’ই শেষ মুহূর্তে জানতে পেরেছিল আমরা দার্জিলিং যাচ্ছি”
রুদ্র মুখ বেঁকালো “তুই বলিস সৌরভ তোকে ভালোবাসে। এই ভালোবাসার নমুনা। আর একটু হলে তো তোকেই ফাঁসিয়ে দিচ্ছিল”
চঞ্চল বলল “রাম পাঁঠা একটা”
হঠাৎ ঘরের আলো নিভে গেলো। ওরা সমস্বরে বলে উঠলো “আরে এটা কি হল! আলো নিভলো কেন?” বলতে বলতেই দরজাটাও হঠাৎ বন্ধ হঠাৎ খুলে যেতে লাগলো যেন বাইরে ঝোড়ো হাওয়া উঠেছে। জোনাকির কেমন যেন মনে হল দরজা দিয়ে এক ছায়ামূর্তি ঘরে এসে দাঁড়ালো। ও চেঁচিয়ে উঠলো “কে? কে ওখানে?”
রুদ্র বলল “এই কি বলছিস। কেউ তো নেই কোথাও”
“না রে আছে, আমি দেখলাম”
চঞ্চল বলল “কেউ কি এসেছ ঘরে তাহলে কথা বলো আওয়াজ দাও”
- আমি কথা বললে কি তোদের সুবিধে হবে?
“কে বলছ?” কাঁপা কাঁপা গলায় জোনাকি বলল।
- চিনতে পারছিস না। এই এক মাসের মধ্যে ভুলে গেলি। কেমন বন্ধু রে তোরা? আর দ্যাখ আমি মরে গিয়েও তোদের ভুলতে পারলাম না। তাই তো তোদের সাথে দেখা করতে এসেছি (হাসি)
“মানে তুমি তন্দ্রা”
- হ্যাঁ রে আমি
“কিন্তু...”
- কিন্তু কি মৃত লোক তো যেখানে খুশি যেতে আসতে পারে। তা যাক ফালতু কথায় কাজ কি। আমি জানতে এসেছি আমাকে বাঁচতে কেন দিলি না তোরা। কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তোদের?
চঞ্চল বলল “লাভ কি করেছিস। বড়লোক বলে সব সময় আমাদের দাবিয়ে রাখতিস যেন আমরা তোর ফরমাশ খাটতে আসা চাকর
- হা হা তোরা তো তাই ছিলি রে। আমার থেকে সুযোগ পেতেই তো তোরা সবসময় আমাকে তোসামোদ করতিস
রুদ্র বলল “তোসামোদ আমরা করতাম না তুই। দিব্যি তো আমাদের বস সৌরভকে পটিয়ে উঁচু পদে উঠে গেলি। যে পদ আমার পাওয়ার কথা যেহেতু আমি অনেক সিনিয়ার”
- আমি উঠেছি নিজের এলেমে কারো পায়ে ধরে নয়। যতই সৌরভের আর আমার মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক থাক না কেন
জোনাকি লাফিয়ে উঠলো “মিথ্যে কথা। তুই আমার থেকে সৌরভকে কেড়ে নিয়েছিস। আমরা দুজন দুজনকে ভালবাসতাম, মাঝখান থেকে তুই সব গণ্ডগোল পাকালি”
- ও এটা তো আমি জানতাম না যে সৌরভকে তুই ভালবাসিস
“সব জানতিস! না জানার ভান করছিস
- ও সেই কারণেই কি তোরা আমাকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিলি
“যদি বলি হ্যাঁ তাতেও তো তোর কোন লাভ নেই। তুই মরে গিয়েছিস আর প্রমাণ করতে পারবি না। আর আমরাও কোন ক্লু ছেড়ে আসিনি”
“আর সেই কারণেই তো এই নাটক রচনা করা যাতে তোমাদের মুখ দিয়েই তোমাদের দোষ স্বীকার করানো যায়” কথা শেষ হতে হতেই ঘরের আলো জ্বলে উঠলো, দেখা গেলো তন্দ্রা সৌরভ আর পুলিশকেও। তিনজনের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো কিন্তু সব বলে দিয়েছে ওরা। এখন তো আর ফেরত হবে না। পুলিশ ওদের নিয়ে গেলে তন্দ্রা বলল “ধন্যবাদ সৌরভ। তুমি না সাহায্য করলে আমি আর আমার চেনা পৃথিবীতে ফিরতে পারতাম না”
সৌরভ উত্তর দিলো “আমার সন্দেহ হয়েছিলো ওদেরকে কিন্তু কোন তথ্য ছিল না হাতে। তুমি যদি ফিরে এসে আমার সাথে যোগাযোগ না করতে তাহলে ওরা অধরাই থেকে যেত”
“তোমার মতো বন্ধুই আমার দরকার”
“চলো এবার তোমার মায়ের সাথে দেখা করে আসি”