পাবলিক প্লেস
পাবলিক প্লেস
কপালের লাল টিপটা লাগিয়ে একবার ভালো করে নিজেকে আয়নায় দেখে নিলো প্রিয়া। লাল শাড়ী, লাল কানের দুল , লাল টিপ, লাল লিপস্টিক, সব ম্যাচিং। মন্দ দেখাচ্ছে না । নিজেকে নিজেই অ্যাপ্রিসিয়েট করে ও। আসলে লাল রং টা ওকে খুব মানায়। সাজটা শেষ করে , একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর গুন গুন করতে করতে ও ড্রইং রুমে এসে দাঁড়ালো। ও আর সমীরণ যাচ্ছে শপিং এ, মানে যাকে আমরা পাতি বাংলায় বলি বাজার করতে ।
প্রিয়া একজন স্কুল টিচার আর ওর স্বামী সমীরণ একটি মালটি ন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো চাকরি করে। দুজনের সংসার। বিয়ের মাত্র ছ মাস হয়েছে। প্রিয়া আর সমীরণের বিয়ে দেখেশুনে হয়েছে। সমীরণ প্রিয়ার থেকে মাত্র বছর তিনেকের বড়, কিন্তু প্রিয়া ভীষণ ছেলে মানুষ আর সমীরণ বয়সের তুলনায় একটু বেশিই গম্ভীর। তাই ওদের দেখে বেশিরভাগ লোকই ভাবে ওদের বয়সের অনেকটা ফারাক।
“কেমন দেখাচ্ছে আমায়?” এক গাল হেসে আদুরে গলায় প্রশ্ন করলো প্রিয়া। ওকে উপর থেকে নিচে অবধি ভালো করে দেখে নিয়ে একটু গলা খাঁকরে সমীরণ গম্ভীর গলায় বলল,” এরকম রেড রাইডিং হুড সেজে তুমি বাজার করতে যাবে?”
মুহূর্তের মধ্যে প্রিয়ার মুখের হাসি মলিন হয়ে গেলো । অপ্রতিভ মুখে ও বলল,” আচ্ছা চেঞ্জ করে আসছি।“ ঘরে এসে একটা মেরুন রঙের সালওয়ার কামিজ পরে নিলো ও।
সমীরণকে ঠিক বুঝতে পারে না প্রিয়া। আসলে বাড়ির সবচেয়ে ছোট ও। ওর বড় দিদি আর দাদা ওর চেয়ে পাঁচ ছ বছরের বড়। তাই ছোট থেকেই ও খুব আদরে মানুষ। যা করেছে সবাই তাতে প্রশংসা করেছে। আর ওর স্বভাবটা এমন যে কাউকে অখুশি দেখলে ও নিজে খুশি থাকতে পারে না। ওদের বাড়ীতে সবাই জোরে জোরে হাসে। ছোট ছোট ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত হয়। যেমন ধরুন বাড়ীতে বছরের প্রথম আম এলো। তাতে বাড়ীতে এতো হৈ চই শুরু হয়ে যেত যে পাড়ার লোকেরা ভাবতো, বাড়ীতে নিশ্চয়ই কারুর জন্মদিনের পার্টি হচ্ছে। কিন্তু সমীরণদের বাড়ীতে সবাই খুবই সংযত। ওরা মেপে হাসে, মেপে কথা বলে।
বিয়ের পর ওরা প্রথম সিনেমা দেখতে গেছে। ভীষণ রোম্যান্টিক দৃশ্য চলছে। প্রিয়া সমীরণের হাতটা হাল্কা করে নিজের হাতের মধ্যে নিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে সমীরণ হাতটা ছাড়িয়ে সোজা হয়ে বসলো। সেদিন বাড়ী ফেরার পথে সমীরণ প্রিয়াকে হাল্কা ভর্ৎসনার সুরে বলেছিল,” কি যে কর , পাবলিক প্লেসে!”
তারপর একদিন সমীরণের বন্ধু রনিদের বাড়ির পার্টিতে, সব বন্ধুরা তাদের স্ত্রীদের নিয়ে এসেছিল। সকলের সঙ্গে প্রিয়ার আলাপ করানোর জন্যই ওই পার্টিটা দিয়েছিল রনি। সবাই খুব মজার মুডে ছিল। রনি খুব মজার মজার জোকস বলছিল। প্রিয়া হাসতে হাসতে সমীরণের কাঁধের উপর মাথাটা রাখতেই সমীরণ সচেতন হয়ে গেলো। দাঁত চিপে সমীরণ বলে উঠল,”এটা পাবলিক প্লেস!” তারপর আস্তে আস্তে ওর থেকে একটু দূরে গিয়ে বসলো। সবাই লক্ষ্য করে সমীরণের এই আচরণ। লজ্জায় লাল হয়ে যায় প্রিয়া। তারপর পার্টিটা আর তেমন জমলো না। সেদিন বাড়ী এসে প্রিয়ার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে যায় সমীরণের।
“আমরা স্বামী স্ত্রী তো নাকি? তোমার বন্ধুর বাড়িটাও কি পাবলিক প্লেস?” চেঁচিয়ে ওঠে প্রিয়া।
“ভালোবাসাটা ঠিক দেখানোর জিনিষ নয়। ওটা ভীষণ ভাবে পার্সোনাল।“ শান্ত গম্ভীর উত্তর সমীরণের।
“আমার সাজগোজ, আমার ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ , কিছুই তোমার পছন্দ নয়।“ কেঁদে ফেলেছিল প্রিয়া।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ করে গিয়েছিল সমীরণ।
আজকাল স্কুলে যাবার সময় হাল্কা লিপস্টিক আর ছোট্ট টিপ পরে প্রিয়া। আগের মত কথায় কথায় হিহি করে হাসে না, বাড়ির থেকে ফোন এলে চিৎকার করে,” কত দিন বাদে ফোন করলে, আমার কথা তো আর তোমাদের মনেই পড়ে না”, বলে না। সত্যই মেয়েরা জলের মতন , যে পাত্রে রাখবে সে পাত্রের আকার নেবে। প্রিয়াও আসতে আস্তে বদলে যাচ্ছে, হয়তো নিজের অজান্তেই। কিন্তু পরের পার্টি গুলোতে প্রিয়ার এই পরিবর্তন কারুরই চোখ এড়ালো না।
দিওয়ালীর আগে হঠাৎ রনির ফোন, “তুমি খুব চালু বাবা! তোমার বউয়ের রান্না কবে খাওয়াবে আমাদের? আমাদের সবার বাড়ীতে পার্টি হয়ে গেছে। এবারের দিওয়ালী পার্টি তোমার বাড়ী ।“
“তোরা তো জানিস দিওয়ালীতে আমার কি অবস্থা থাকে।“ বলেছিল সমীরণ।
“ওসব আমরা জানিনা। আমরা বিকালবেলায় তোমার বাড়ী হাজির হয়ে যাব, ব্যাস।“ বলে ফোন রেখে দিয়েছিল রনি। আসলে দিওয়ালীটা সমীরণের খুব একটা পছন্দের উৎসব নয়। ও বাজিকে অসম্ভব ভয় পায়। তাই প্রতিবারই ও এই সময়টা কোথাও চলে যায় , যেখানে বাজির আওয়াজ নেই। কিন্তু এবার অগত্যা ওকে থাকতে হচ্ছে কারণ পার্টিটা ওদের বাড়ীতেই হচ্ছে। এটা ওদের বিয়ের পর প্রথম দিওয়ালী, তাই এই সব ব্যাপার প্রিয়া কিছুই জানে না।
রনি , টিটো, পাবলো, বাবলু এই চারজন তাদের স্ত্রীদের নিয়ে আসবে। ওরা আটজন আর প্রিয়ারা দুজন, মোট দশ জনের রান্না। প্রিয়া খুব টেনশনে আছে। মাকে ফোন করে, দিদিকে ফোন করে, ইন্টারনেট দেখে সব রান্নার রেসিপি জোগাড় করেছে। মেনু তৈরি। স্যালাড, চিপস, চিকেন-নাগেট, চীজ-কর্ণ, স্নাক্সে থাকবে আর ডাল, বেগুনি, বেকড-ভেজিটেবিল, বাটার-চিকেন, মাটন-দো-পিয়াজা, চাটনি আর আইসক্রিম, থাকবে মেইন কোর্সে। সঙ্গে থাকবে ভাত আর রুটি।
সব রান্না শেষ। একটা সাদা সালওয়ার কামিজ পরে, প্রায় বিনা মেকআপে, প্রিয়া তৈরি। সারা বাড়ী প্রদীপ দিয়ে সাজিয়েছে প্রিয়া। বন্ধুরাও সময় মত এসে গেছে। আওয়াজ কম করার জন্য বাড়ির সব জানালা দরজা বন্ধ রেখেছে ওরা। শুধু, রান্নাঘরের বারান্দার দরজাটা খোলা। রান্নাঘরের সামনেই ওদের ডাইনিং টেবিল। টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে সবাই ড্রিঙ্ক নিচ্ছে। সমীরণ একজন ভালো হোস্টের মত সবাইকে ড্রিঙ্ক পরিবেশন করছে আর ঠিক তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রিয়া স্যালাড কাটছে। হঠাৎ কেউ একটা চকোলেট বোমা ছুঁড়ে দিলো ওদের রান্না ঘরের বারান্দায়। প্রচণ্ড জোরে একটা “দুম” করে শব্দ করে বোমাটা ফেটে সারা বাড়ী কাপিয়ে দিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে সমীরণ প্রায় ডিগবাজি খেয়ে, “ওরে বাবারে!” বলে প্রিয়াকে জাপটে ধরল। প্রিয়া চমকে উঠে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলতে লাগলো,” এই! কি হচ্ছে কি?” আর সব বন্ধুরা সমস্বরে বলে উঠলো,” এ বাবা! এ কি রে ! পাবলিক প্লেসে?”
ঘোর কাটতে, হো হো করে হেসে উঠলো সকলে। সকলের সঙ্গে সমীরণও হেসে উঠলো। প্রিয়া এই প্রথম সমীরণকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখল। তারপর প্রিয়াকে অবাক করে দিয়ে সমীরণ ওকে আরও একটু কাছে টেনে নিয়ে বলল, ”কি একটা সাদা সালওয়ার-কামিজ পরেছো! ওই দিনের লাল শাড়ীটা পরে এসো না! ওটাতে তোমায় খুব সুন্দর দেখায়।“