Sayandipa সায়নদীপা

Inspirational

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Inspirational

নতুনের সংকল্প

নতুনের সংকল্প

7 mins
711



পরীক্ষক খাতাটা তুলে নিতেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তাতাই। অবশেষে পরীক্ষাটা শেষ হল তবে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবেনা আগামী পনেরো দিন, তাই বন্ধুরা সব ডাকছিল আড্ডা দিতে। কিন্তু তাতাই জানে আড্ডা দেওয়ার সময় নেই তার। এটা সেটা বলে ওদের কাটিয়ে দিয়ে সেন্টার থেকে বেরিয়ে এলো সে। বাইরে বেশ শীত শীত করছে। মাফলারটা মাথায় বেঁধে হাঁটা লাগাল তাতাই। এই বি.এড কোর্সটা যত বিরক্তিকর, তার থেকেও দ্বিগুন বিরক্তিকর ছিল এর পরীক্ষা। মাত্র চারদিন পরীক্ষা কিন্তু সেটাও এমন গ্যাপে গ্যাপে দেওয়ার কোনো মানে হয়! দুদিন ছাড়া রুটিন পাল্টে পাল্টে পরীক্ষা তেরো তারিখের জায়গায় শেষ হল একুশে। এখন তাতাই কিভাবে সব সামলাবে কে জানে! ওভার ব্রিজের ঐদিকে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন বাবা। তাতাই বাবার কাছে এসেই বলল, "কেকের দোকানে যাবে তো?" 

বাবা বললেন, "চার ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে বেরোলি, রেস্ট নিবি না?"

"রেস্ট নেওয়ার দিন কি আর আছে বাবা! চলো কেকের দোকান। আজই অর্ডার দিয়ে আসি। বড়দিনের সময়, পছন্দমতো কেক পাওয়া মুশকিল।"


   আর মাত্র তিনদিন পরে পিচাই মহারাজের জন্মদিন। তাতাইকে জ্বালাতন করতে আজ থেকে প্রায় আঠেরো বছর আগে এই ধরাধামে এসেছিলেন তিনি। বড়দিনের দিন পিচাই জন্মেছিল বলে তাতাই ভেবেছিল স্যান্টাক্লজ বুঝি একটা জ্যান্ত পুতুল উপহার দিয়েছে তাকে। এরপর বিভিন্ন খুনসুটিতে সেই জ্যান্ত পুতুলের সঙ্গে আঠারোটা বছর কাটিয়ে দিল তাতাই। হ্যাঁ, এই পঁচিশে ডিসেম্বর পিচাই পা দিচ্ছে আঠারোতে। আইনত এবার সেই ছোট্ট জ্যান্ত পুতুলটা প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যাবে। এমনিতেই বড়দিনের দিন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে গোটা বিশ্ব মাতে আনন্দে, তার ওপর পিচাইয়ের জন্মদিন হওয়ার কারণে তাতাইদের আনন্দ থাকে দ্বিগুণ। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল সেই যে পাঁচ বছরে পিচাইয়ের জন্মদিন পালন হয়েছিল, তারপর থেকে কোনো না কোনো কারণে প্রত্যেক বছর ওর জন্মদিন ক্যান্সল হয়ে যায়। বারবার এরকম হতে দেখে মা বাবা শেষে প্ল্যান করাই ছেড়ে দিয়েছেন কয়েক বছর। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা আলাদা। এমনিতেই ভাইয়ের আঠেরো হচ্ছে বলে তাতাইয়ের উৎসাহের অন্ত নেই, তার ওপর সামনেই পিচাইয়ের উচ্চমাধ্যমিক। বেচারা দিনরাত বইতে মুখ গুঁজে আছে। তাই তাকে একটু আনন্দ দেওয়ার জন্যও জন্মদিনের আয়োজনটা জরুরি। এছাড়া আরও একটা কারণ অবশ্য আছে। গত বছর দাদুর মৃত্যুর পর থেকে তাতাইদের পরিবারটা কেমন যেন ঝিমিয়ে গেছে। ঠাম্মিও আজকাল সারাদিন বসে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে কি যেন দেখেন, কারুর সাথে কথা বলেন না, মেশেন না। তাই পিচাইয়ের জন্মদিনের বাহানায় ওদের পরিবারটা বহুদিন বাদে আবার হয়তো আগের মতোই আনন্দে মাততে পারবে, মন ভালো করতে পারবে অনেকটা এই আশাতেও তাতাই জেদ ধরেছিল পিচাইয়ের জন্মদিন পালনের। সে বলেছিল সারপ্রাইজ পার্টি দেওয়া হবে ভাইকে। তবে মুখে বলা আর সত্যিকারের সারপ্রাইজ পার্টির পরিকল্পনা করার মধ্যে যে অনেক পার্থক্য রয়েছে তা এই ক'দিনে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তাতাই। পরীক্ষাটা পিছিয়ে আরও গণ্ডগোলটা হল। যাইহোক, তাতাই ঠিক করেছে ডেকোরেশনটা সে নিজের হাতেই করবে, আর সেটা করতে হবে পিচাইয়ের অলক্ষ্যে। তাই চব্বিশে ডিসেম্বরের রাতটাই সেরা সময়।


    কোমরটা বড্ড যন্ত্রণা করছে তাতাইয়ের। খিদেটাও যেন মরে গেছে এতো বেলায়। কাল রাতে ডেকোরেশন করতে গিয়ে ঘুম হয়নি, আজ আবার ভোর ভোর উঠতে হয়েছে। এমনিতে শীতকালে তাতাই স্নান করতে চায়না কিন্তু আজ তার একমাত্র ভাইয়ের জন্মদিন বলে কথা তাই ঠান্ডা জলে ভালো করে স্নানও করেছে সকাল সকাল। তারপর বেলা ন'টার থেকে আত্মীয়স্বজনরা আসা শুরু করেছেন, মায়ের সঙ্গে তাদের আপ্যায়ন করতে, রাঁধুনি যারা এসেছে তাদেরকে জিনিসপত্রের জোগাড় করে দিতে কম পরিশ্রম হয়নি তাতাইয়ের। শেষ কবে এতো খাটাখাটনি করেছিল মনে পড়ে না। তবে পরিশ্রম যাই হোক, তাতাইয়ের উদ্দেশ্য সফল। অনেক দিন পর আবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছে তাদের বাড়িটা। আত্মীয়স্বজনদের দেখে ঠাকুমাও আজ খুশি, বহুদিন বাদে এতো কথা বলছেন তিনি। পিচাইও তো চমকে গিয়েছে রীতিমত। এমন একটা গ্র্যান্ড পার্টি যে পাবে সেটা ভাবেইনি সে। 


   

  পুরো বাড়িটা এখন গমগম করছে সবার কোলাহলে। সবার আনন্দ দেখে তাতাইয়ের মনটাও আজ বেশ খুশি খুশি। মোটামুটি সব আমন্ত্রিতদের খাওয়া দাওয়া হয়ে যেতে এখন খেতে বসেছে তাতাই আর মা বাবা। অনেক বেলা হয়েছে, তার ওপর রিচ খাবার দাবার… খেতে বসেও ঠিক করে খেতে পারল না তাতাই। থালায় পড়ে নষ্ট হল অনেক খাবার। খেতে খেতে বাবা বললেন, "অনেক খাবার বেশি হবে আজ। ট্রেন অবরোধের জন্য তো অনেকেরই আসার কথা ছিল কিন্তু আসতে পারল না।"

আর খেতে না পেরে উঠে পড়ল তাতাই। যেখানে সব এঁটো পাতা ফেলা হচ্ছে গেট খুলে সেখানে এলো সে। আর সেখানে পৌঁছেই শিউরে উঠল তার শরীর। দেখলো একটা শীর্ণকায় ছোটো বাচ্চা এই শীতেও আদুল গায়ে এক ধারে বসে একটা ভাঙা স্যান্টাক্লজ নিয়ে খেলছে। আর তার থেকে একটু দূরে তুলনামূলক বড় একটা মেয়ে একটা ময়লা ফ্রক পরে তাতাইদের বাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া এঁটো পাতা থেকে মিষ্টি তুলে তুলে ভরছে একটা পলিপ্যাকে। অনেকেই মিষ্টি নিয়েছিল পাতে কিন্তু আর খায়নি শেষমেশ। মেয়েটা সেই মিষ্টিগুলোই কুড়োচ্ছে। 


   ---- জিজি এই নতুন পুতুলটা ফেলে দিয়েছিল কেন লে? 

---- ভেঙে গেছে দেখছিস না? ওরা এটা দিয়ে বড়দিনে ঘর সাজায়।

---- পুতুল দিয়ে?

---- হ্যাঁ রে। এই পুতুলটার নাম সান্তা না কি যেন। ছোটোবাচ্চাদের নাকি উপহার দেয় এই বুড়োটা।

---- এই পুতুলটা উপহার দেয়???

---- ধুরর একটা সত্যি বুড়ো আছে, পুতুলটা তো সেই বুড়োটাকে দেখে বানানো। 

---- সত্যিই? কাকে উপহার দেয় রে?

---- জানিনা। আমাদের তো কোনোদিনও দেয়না…

শেষ কথাগুলো বিড়বিড় করে বলতে বলতে আবার পাতা সরিয়ে মিষ্টি তোলায় মন দিল মানু। 


---- ওগুলো তুলো না, ওগুলো তো নোংরা হয়ে গেছে।

পাশ থেকে কথাটা ভেসে আসতেই ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকাল মানু। দেখল একটা বড় মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে মানু দেখেছে অনেকবার, এই মেয়েটা ওই সামনের বাড়িটাতে থাকে। আজ তো মনে হয় ওদের বাড়িতেই কি অনুষ্ঠান ছিল, তার জন্যই এতো পাতা ফেলেছে এখানে। যাহ বাবা! বেশ তো একমনে মিষ্টি খুঁজে খুঁজে পলিথিনে ভরছিল মানু। সে পাড়ায় এক বাড়িতে বাসন মেজে এক ঠোঙা মুড়ি পেয়েছে, এবার এই মিষ্টি নিয়ে সে আর ভাই খাবে ভেবেছিল। কিন্তু এই মেয়েটা এই ফেলা মিষ্টিও তুলতে দেবে না নাকি!

---- আমি ফেলা মিষ্টি তুললে তোমার কি গো? ঝাঁঝিয়ে বলল মানু।

মানু দেখল ওর রুক্ষ প্রশ্নে খানিক ঘাবড়ে গেছে মেয়েটা। সেই যবে থেকে মা মরে গেছে মানু শিখেছে এরকম করে সবসময় জোর গলায় কথা বলতে হয়,ভালো মানুষ সেজে থাকলেই লোকে সুযোগ নেবে।

মেয়েটা কিছুক্ষণ মানুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, 

---- এই মিষ্টিগুলো নোংরা তাই বলছিলাম।

---- তোমাদের নোংরা। আমাদের কিছু হবে না। আমরা একেই খাবো। এখন তুমি যাও দিকি বাপু।

মানু দেখলো ওর মুখ ঝামটা খেয়েও মেয়েটা নড়ল না সেখান থেকে। বিরক্ত হল মানু। সে আবার মুখ তুলে বলল,

---- কি হল টা কি?

---- শোনো…


     ----- মা

খানিক ভয়ে ভয়েই মাকে ডাকলো তাতাই। মায়ের সেই সবে খাওয়া শেষ হয়েছে। মা মুখ না তুলেই বললেন,

---- কিরে?

---- মা এদেরকে এনেছি। দুটি খেতে দেবে?

মা বাবা দুজনেই মুখ তুলে তাকালেন এবার। মানু আর তার ভাই ভানুকে দেখে ভ্রু টা কুঁচকে গেল তাদের। তাতাই দেখলো মা বাবা দুজনের চোখেই প্রশ্ন। তাতাই জানে না মা বাবা কিভাবে নেবেন ব্যাপারটা। তবুও সে সাহস করে বলল, 

---- মেয়েটা বাইরে আমাদের এঁটো খালার থেকে মিষ্টি তুলছিল খাবে বলে। তাই আমি ডেকে আনলাম ওদের। 

মিনিট খানেক মা বাবা কেউ কোনো উত্তর দিলেন না। বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো তাতাইয়ের। একটু পরেই বাবা একগাল হেসে তাতাইয়ের পিঠ চাপড়ে বললেন, 

---- তুই এমন শুকনো মুখে ডাকলি ভাবলাম কি না কি হয়ে গেছে বোধহয়। তা ভাইয়ের জন্য এতো বড় সারপ্রাইজ পার্টি প্ল্যান করলি আর এই ভাই বোনকে খেতে দিতে পারবি না? 

   বাবার কথা শুনে তাতাইয়ের মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মা বললেন,

---- আয়, আমার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে দে। তাড়াতাড়ি খেতে দিয়ে দিই ওদের। 

মানু ভানুকে কোলে নিয়ে একপাশে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাতাই দুটো চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল ওদের। মানু নড়ল না। বাবা এবার বসতে বলতে ইতস্তত করে এগিয়ে এসে চেয়ারে বসল মানু। তাতাই আর মা খাবার বেড়ে রাখল ওদের সামনে। খাবারগুলো পাওয়া মাত্রই ভানু গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করল। দেখেই বোঝা গেল বড্ড খিদে পেয়ে গিয়েছিল তার। এদিকে তাতাই দেখল মানুর হাতটা কাঁপছে, তার চোখ থেকে একটা সরু জলের ধারা নেমে পড়ছে গাল বেয়ে। 

---- কি হল তোমার?

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল তাতাই।

মানু চট করে হাতের চেটো দিয়ে চোখের জলটা মুছে বলল,

---- কিছু না।

---- তাহলে খাও।

---- হুঁ

খাওয়া শুরু করল মানু। রান্না অনেকক্ষণ হয়েছে। শীতকাল বলে খাবারগুলো ঠান্ডাও হয়ে গেছে। তাতাই বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে দেখল এই ঠান্ডা হয়ে যাওয়া খাবারগুলোও কি তৃপ্তি করে খাচ্ছে ভাইবোন। তাতাইয়ের মনে পড়ে গেল খানিক আগেই সে থালায় কত খাবার নষ্ট করেছে। এছাড়া তাদের অতিথিরাও প্রত্যেকেই ফেলে নষ্ট করে খাবার খেয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাতাই। এটাই আমাদের সমাজ। কেউ ইচ্ছে করে খাবার নষ্ট করে আবার কেউ প্রয়োজনেও খাবার পায়না। বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত কষ্ট মিশ্রিত ভালোলাগা অনুভূত হচ্ছে তাতাইয়ের। একদিকে এদের অবস্থার কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে আর অন্যদিকে ওদের তৃপ্তি ভরা মুখটার দিকে তাকালে মনটা ভালো লাগায় ভরে যাচ্ছে। আজকে এই বড়দিন, তার ওপর ভাইয়ের জন্মদিনে তাতাই আর দুজন ভাইবোনের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে এই ভেবেই একটা অন্যরকম শান্তি হচ্ছে মনে যা এতক্ষণ এতো আড়ম্বর আয়োজনেও হয়নি। আনন্দ হয়েছিল, উদ্দীপনা ছিল কিন্তু এমন মানসিক পরিতৃপ্তি কি পেয়েছিল!


---- মা বাবা

---- কিরে?

---- আর একসপ্তাহ বাদেই নতুন বছর আসতে চলেছে।

---- হ্যাঁ, তো?

---- এই নতুন বছরে আমি একটা সংকল্প নিতে চাই। আর তার জন্য তোমাদের অনুমতি নিতে চাই।

---- তোর সংকল্পের জন্য আমাদের অনুমতি! কি এমন সংকল্প শুনি।

---- আমি চাই এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সাল থেকে আমার আর পিচাইয়ের জন্মদিনে কোনো আড়ম্বর না করে মানু আর ভানুর মত যেসব বাচ্চারা রোজ ভালো করে খেতে পায়না তাদের জন্য ভালো খাবার আয়োজন করব। পার্টি হবে, কিন্তু ওদের নিয়ে। আমাদের তো সেই ক্ষমতা নেই যে রোজ ওদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারব,তাই বছরের যদি দুটো দিন অন্তঃত…


   তাতাইয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বাবা। তারপর কানে ফিসফিস করে বললেন, "আজ আমার ভীষণ গর্ব হচ্ছে তোর বাবা হিসেবে। তোর এই বিশেষ সংকল্পে অবশ্যই আমরা তোর সঙ্গে আছি।"

মাও পাশ থেকে বলে উঠলেন, "তবে তাই হোক। আমার ছেলে মেয়ের জন্মদিনে তাদের মঙ্গলকামনায় পুজো হোক, তবে তা মানুষের পুজো।"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational