STORYMIRROR

শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Tragedy Inspirational

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Tragedy Inspirational

নতুন সূর্যের আলো

নতুন সূর্যের আলো

7 mins
253


মিতিল তাড়াতাড়ি করে খাবারটা খেয়ে বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে কাঁধে ব‍্যাগ ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।

-----------মিতিলের বাবা বিকাশ বাবু বলে উঠলেন, সাবধানে রাস্তায় চলা ফেরা করবি, আর সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়েছিস তো? আমি বললাম সঙ্গে যাচ্ছি একদিন না হয় অফিস ছুটি নিয়ে নিতাম ?

----------মিতিল এগিয়ে যেতে যেতে বলল, আমি পাড়বো বাবা, অত চিন্তা করোনা, আর এতদিন তো সবকিছু তুমিই করে এসেছো একদিন না হয় আমি করেই নিলাম।

----------মিতিলের মা প্রভাদেবী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাতজোড়া কপালে ঠেকিয়ে দূগ্গা... দূগ্গা.... বলে উঠলেন, আর মনে মনে বলে উঠলেন,মেয়েটাকে একটু দেখো প্রভু, ওর এত কষ্ট যেন স্বার্থক হয়। মিতু আমার নিজের সব সখ আহ্লাদ ত‍্যাগ করে দিয়েছে, চঞ্চল, ছটপটে অবুঝ মেয়েটা কেমন দায়িত্ববোধ সম্পন্ন বোঝদার শান্ত হয়ে গেছে কদিনের মধ‍্যেই । এত আঘাত সহ‍্য করে, লোকের এত কটু কথা শুনেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল আছে। প্রভাদেবী চোখের কোনে জমে ওঠা জলটা শাড়ির আঁচলে মুছে বাড়ির ভীতরে ঢুকে গেলেন। 


মিতিল বাস স্ট‍্যান্ডে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল বাস আসার। হঠাৎ দূরে একটা অাবঝা মুখ দেখে মিতিলের ভিতরটা কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে উঠল। কিছু পুরনো স্মৃতি উঁকি দিতে লাগল যা মনকে শুধু কষ্টই দেয়। মিতিল হাত ঘড়ির দিকে বারবার দেখতে লাগল।এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না, আবঝা মুখটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। জীবনের প্রতিটা সেকেন্ড এখন মিতিলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। একসময় একটা মানুষের জন‍্য নিজের একান্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ের কোনো গুরুত্ব দেয়নি মিতিল, তাই আজ সময়ের সাথে সেই মানুষটার চোখে গুরুত্বহীন হয়ে পরেছে। একটা অস্পষ্ট ডাক কানে আসল মিতিলের। মিতিল সেই ডাককে উপেক্ষা করেই বাসে উঠে পড়ল। বাসে উঠে ভীড় ঠেলে ভীতরে ঢুকতেই একজন মিতিলকে দেখে বলল

--আরে আপনি এইখানে আমার সিটে বসুন আমি দাঁড়াচ্ছি।

----------মিতিল বলে উঠল না... না...., ঠিক আছে অসুবিধা নেই আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পাড়ব।

পাশ থেকে একজন বয়স্ক মহিলা বলে উঠল, এই অবস্থায় বেশিক্ষন ভীড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধা হবে, ঠেলা ঠেলিতে কষ্ট হবে,তুমি বসে পড়ো মা...।

----------মিতিল আর কথা না... বাড়িয়ে সাবধানে সিটে বসে পড়ল।

----------বয়স্ক মহিলাটি হাসি হাসি মুখে বলে উঠল, তা ক...মাস চলছে?

----------মিতিল বলে উঠল, এই সাতমাস,

----------বয়স্ক মহিলাটি বলল, তা..... বর কোথায়? একা দেখছি যে...?

------------মিতিল দৃঢ কন্ঠে বলল, বর নেই...!!! আমি সিঙ্গেল মাদার।

----------বয়স্ক মহিলাটি বিড়বিড় করে বলে উঠল, আজ কালকার ছেলে মেয়েদের ব‍্যাপার স‍্যাপার কিছু বোঝা যায়না বাপু।

মিতিল কথা না বাড়িয়ে মাথাটা জানলায় ঠেকালো, এইসব কথা এখন রোজকার জল ভাত খাওয়ার মত, শুনতে শুনতে মিতিল অভ‍্যস্ত হয়ে গেছে, প্রথমদিকে খুব কষ্ট হত কিন্তু এখন আর ভাবেনা এইসব কথা নিয়ে। হাওয়ায় চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়তে লাগল। মিতিল বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল উদাসী দৃষ্টিতে, আর চোখের পাতায় জলছবি হয়ে ফুটে উঠতে লাগল টুকরো টুকরো স্মৃতি।

***************************************

মিতিল বেঁচে থাকার মানেই ভুলে গেছিল! কিন্তু.... আজ আবার নতুন করে বাঁচতে শিখেছে। আসলে মিতিল কোনদিন ভাবতেও পারেনি এত বছরের ভালোবাসার সম্পর্ককে এক নিমেষেই শেষ করে দিতে পারবে রনিত। কিন্তু মিতিলের সমস্ত ভাবনাকে ভুল প্রমান করে দিয়ে রনিত বলে উঠেছিল.

-তোমার সাথে সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয় মিতু!

এই একটা কথায় মিতিলের পায়ের তলা থেকে মাটি যেন সরে গেছিল, মিতিল রনিতের হাত ধরে বলে উঠেছিল


--এটা তুমি কি.... বলছ রনিত? আমাদের এত বছরের সম্পর্ক, আর তার থেকেও বড় আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন বেড়ে উঠছে আমার মধ‍্যে, এখন আমাদের সম্পর্কের সুন্দর পরিনতি পাওয়ার কথা,আর এখন তুমি সেই সম্পর্ককে ভেঙ্গে দিতে চাইছো! এইরকম বলতে পারোনা তুমি রনিত!যে... আসছে তার কথা একটুতো ভাবো।

----------রনিত মিতিলের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠেছিল, আমার তো... মনে পড়েনা আমি তোমাকে কোন রকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিলাম, সারা জীবন একসাথে থাকার! তোমার এই ঘ‍্যানঘ‍্যানানি আমার সহ‍্য হয় না.. একদম, আমি আমার জীবনটাকে সুন্দর করে উপভোগ করতে চাই, আর আমার পক্ষে আর এই সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়! আর যে..... আসতে চলেছে তাকে না.... আনলেই হলো! যা.... খরচ খরচা হবে আমি সব দিতে রাজি।

-----------মিতিল রনিতকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ ধরে বলেছিল, এই তুমি এইসব কি.... বলছ? তুমি কি.....কোন সমস‍্যায় পড়েছো আমাকে বলো কিন্তু এই রকম কথা বলোনা...! যে আসছে সে আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন, আর তাছাড়া তার কি... দোষ?,? কেন তাকে এই পৃথিবীর সুন্দর আলো দেখতে দেবনা আমরা??

--------রনিত মিতিলের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, এই রকম ন‍্যাকা কান্না কেঁদো... নাতো আমার ভালো লাগছেনা, মুক্তি... চাই আমি মুক্তি.... সমস্ত কিছু থেকে। সেই স্কুল লাইফ থেকে শুনে আসছি মিতিল রনিতের জন‍্য সবদিক থেক বেস্ট। কিন্তু আমার এখন সেটা বিশ্বাস হয়না, বরং মনে হয় মিতিল আমার যোগ্য নয়!!! মিতিলের চেয়েও ভালো কাউকে আমি ডিজার্ভ করি। আর হ‍্যাঁ.... আমাকে দয়া করে মুক্তি দাও, আমি আসি, এই সম্পর্কের বোঝা আমি আর নিতে পারছিনা।

মিতিল সেদিন পিছন থেকে অনেক বার করে রনিত কে... ডেকেছিল, কিন্তু রনিত আর পিছনঘুরে দেখেওনি, সাড়াও দেয়নি!!! মানুষের ভীড়ে হারিয়ে গেছিল, মিতিল কাঁদতে কাঁদতে ধপ করে বসে পড়েছিল। কি...করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলনা। বাবা মার সামনে কোন মুখে দাঁড়াবে!!! সমাজ ওকে মেনে নেবে কিনা!!!অনেক চিন্তা ভীড় করে এসেছিল মিতিলের মাথার মধ‍্যে। রনিত যে.... ওকে প্রবল স্রোতের মুখে ফেলে দিয়ে চলে যাবে বুঝতে পারেনি মিতিল!!!

কিন্তু মিতিল হেরে যায়নি!!! উঠে দাঁড়িয়েছিল, আর এই উঠে দাঁড়ানোর সময় ওর সব থেকে বড় অবলম্বন হয়ে ছিল ওর বাবা। কোনদিনও দূর্বল হয়ে পড়তে দেয়নি মিতিলকে। সবসময় সবকিছু থেকে আগলে রেখেছিল। মিতিল বাবা মার ভরসায়, ভালোবাসায় শুরু করেছিল নতুন করে বেঁচে থাকার অন‍্য যুদ্ধ।

*****************************************

হঠাৎ বাসটা ব্রেক কসে দাঁড়াল মিতিল চোখের কোনে আসা জলটা মুছে, জানলা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল। নার্সিংহোমের ভিতরে ঢুকল। মিতিল যখন আগত নতুন প্রানের হার্টবিটটা শোনে তখন বেঁচে থাকার এক নতুন মানে খুঁজে পায়। এরজন‍্য এত জনের এত কথা শুনেও মিতিল নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে। সে তার সন্তানকে আলো দেখাবে, পৃথিবীর এই সুন্দর আলো।

নার্সিংহোম থেকে বেড়িয়ে মিতিল সামনে এগিয়ে গিয়ে পার্কের মধ‍্যে ঢুকল। এবং নিজেদের সেই পরিচিত বেঞ্চে বসে সামনে বিস্তৃত ঝিলের দিকে চেয়ে রইল। ঝিলের স্বচ্ছ জলে নীল আকাশের সুন্দর জলছবি ফুটে উঠছে, আর তার সাথে সূর্যের আলোর ছটায় জলটা চকচক করছে মনে হচ্ছে আপন তালে নৃত‍্য করে চলেছে। কত ফেলে আসা দিনের স্মৃতি উজ্বল হয়ে উঠছে মিতিলেন মন ক‍্যানভাসে। একদিন মিতিল কত স্বপ্নের জলছবি এঁকেছিল মন ক‍্যানভাসে রনিতকে নিয়ে। কিন্তু আজ সেইসব কথা ভাবলে মিতিলের খুব কষ্ট হয়, কেন এত ভালোবেসেছিল রনিতকে!!!! কেন অন্ধেরমত বিশ্বাস করেছিল!!! মিতিলের কাছে আজ আর ভালোবাসার সম্পর্কের কোন মূল‍্য নেই।

----------মিতিল নিজের পেটের ওপর হাত রেখে বলে উঠল, মাত্র আর কটাদিনের অপেক্ষা তারপর তুই আমার কোলে চলে আসবি, তুই শুধুমাত্র আমার সন্তান!!! মাতৃ পরিচয় হবে তোর পরিচয়। তোর ওপর আমি কারোর কালো ছায়া পড়তে দেব না।

হঠাৎ একসাথে অনেক মানুষের গলার আওয়াজ কানে ভেসে আসল মিতিলের। মিতিল পিছন ঘুরে দেখল কিছু মানুষের জটলা। মিতিল ধীরপায়ে এগিয়ে এসে দেখল রনিত দাঁড়িয়ে আছে আর ওর সামনে একটা মেয়ে। আর ওদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোকজন।

-----------মেয়েটি রনিতের গালে একটা সপাটে চড় মেরে বলল, কি ভেবেছ এত সহজে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে!!!!! মুক্তি চাইলেই মুক্তি পাওয়া যাবে! এতদিন সম্পর্কে থেকে হঠাৎ করে সম্পর্ক রাখবনা বললেই আমি সবকিছু চুপচাপ মেনে নেব,এতই সহজ!এর আগে কজনের সাথে এই... রকম করা হয়েছে শুনি?

-----------রনিত গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে, বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা!আসলে হয়তো ভাবেনি ওর সাথে কেউ এইরকম করতে পারে। হঠাৎ রনিতের চোখ গেল মিতিলের ওপর। আর রনিতের চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দিনের স্মৃতি যেদিন মিতিলকে একা ফেলে চলে এসেছিল রনিত, সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে, কিন্তু মিতিল সেইদিন এইরকম কিছুই করেনি বরং সব সময়ের মত রনিতের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ছিল মুখ বুজে।

----------রনিতকে গালে হাত দিয়ে ভাবতে দেখে মেয়েটি আবার একটা চড় মেরে বলল, কি.... রনিত বাবু ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন বুঝি?যদি তুমি ভেবে থাকো আমার হাত থেকে সহজে মুক্তি পাবে, সেটা তোমার ভুল ধারনা!!!! আমি এত সহজে মুক্তি দেবনা! তোমার ভালোবাসা নিয়ে খেলার শখ চিরতরে ঘুচিয়ে দেব।

----------রনিত তখনও মিতিলের দিকে চেয়ে আছে, ওর সাথে কি হচ্ছে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই!!!নিজের অজান্তেই রনিতের মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে উচ্চারিত হল মিতিলের নাম। রনিত মনে মনে বলে উঠল,আমি ভুল করেছি মিতু, অনেক বড় ভুল, এখন বুঝতে পারি, সবাই ঠিকই বলতো, রনিতের জন‍্য মিতিল বেস্ট। আজ আমার জন‍্য তোমাকে এতকিছু সহ‍্য করতে হচ্ছে।

------------মিতিলের চোখ রনিতের চোখে পড়তেই মিতিল আর এক মুহুর্ত ওখানে না... দাঁড়িয়ে দূরে চলে আসল। মিতিলের ফোনটা বেজে উঠল, ফোনটা ধরে মিতিল বলে উঠল চিন্তা করোনা মা.... সব ঠিক আছে, আমি আসছি। ফোনটা রেখে, চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে পার্ক থেকে বেড়িয়ে আসল। এবার যে.... বাড়ি ফিরতে হবে।

--------পিছন থেকে আবার ডাক আসল মিতু একটু দাড়াবে প্লিজ কথা ছিল।

---------মিতিল পিছন ঘুরে বলল, কে আপনি আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারছিনা, আর অচেনা মানুষের সাথে আমি কথা বলিনা!!!

-----------রনিত বলে উঠল, আই... অ‍্যাম... সরি... মিতু, আমার মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে!!! আমি বুঝতে পেরেছি, আমাকে কি ক্ষমা করা যায়না??? নতুন করে সবকিছু শুরু করা কি যায়না... মিতু??? তুমি আমি আর আমাদের সন্তানকে নিয়ে!!!!

-------মিতিলি দৃঢ় কন্ঠে বলল, সন্তান... কার সন্তান??? এই সন্তান শুধু আমার একার, নতুন করে চলা শুরুতো আমি কবেই করে দিয়েছি। আর একটা কথা... সব ভুলের ক্ষমা হয়না!কিছু কিছু ভুল ক্ষমার অযোগ্য। আর আমি চাইনা আমার নতুন জীবনে পুরনোর ছাপ পড়ুক।

মিতিল আর কথা না.... বাড়িয়ে বাসে উঠে পড়ল, আর রনিত চেয়ে দেখতে লাগল, বাসটা হর্ন দিতে দিতে একটু একটু কর দূরে আরও দূরে চলে যেতে লাগল,এবং কয়েক মুহুর্তের মধ‍্যে পুরোপুরি রনিতের চোখের বাইরে চলে গেল।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance