নিউটাউনের সেই সোনালী বিকাল
নিউটাউনের সেই সোনালী বিকাল


সেদিন ছিল পি এস সির কোনো একটা পরীক্ষার দিন। আমার সিট পড়েছিল রাজারহাট নিউটাউনের আলিয়া ইউনিভার্সিটিতে। রাজারহাট নিউটাউন কোলকাতা মহানগরীরই পাশে গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিযুক্ত উপনগরী। নিউটাউন মানেই সিটি সেন্টার,ইকোপার্ক,ইকোস্পেস, বিশ্ব বাংলা গেট,ঝাঁ তকতকে রাস্তাঘাট আর গগনচুম্বী মনমাতানো ফ্ল্যাট। সম্প্রতি গ্রীন সিটির তকমা তো পেয়েইছে।
যাই হোক ,সকাল থেকেই আমি নার্ভাস। কি হবে ,কি হবে। প্রশ্ন কেমন হবে! কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স কমন পাব তো। প্রিপারেশন ভালো ছিল বলে আত্মবিশ্বাস টাও ছিল সাথে। যাই হোক, সকালে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের বইটা একটু ঘেঁটে রওনা দিলাম পরীক্ষা হলের উদ্দেশ্যে। প্রথমে ঠিক করেছিলাম বিধাননগর থেকে অটোতে যাব। কিন্তু অটোওয়ালা যখন দুম করে তিনশো টাকা হেঁকে বসল মাথা ঘুরে গেল। সঙ্গেই তো আছে দেড়শো টাকা মতোন,তাও আবার যাতায়াতের জন্য। ঠিক করলাম অটোর কোনো প্রয়োজন নেই,বাসেই যাব। বিধাননগর থেকে করুণাময়ী অবধি গেলাম অটোতে,সেখান থেকে নারকেলবাগান যাওয়ার জন্য বাস ধরলাম।
সল্টলেক ছাড়তে না ছাড়তেই আশপাশের দৃশ্যে মন ভরে গেল।রাস্তার দু পাশে ফাঁকা জায়গা,দিগন্তে আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাটবাড়ি। নারকেলবাগানে নেমে আবার আলিয়া ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্য বাস ধরলাম। চারপাশের পরিবেশে মন ভরে গেল। ইউনিভার্সিটির অপূর্ব ক্যাম্পাস।ফাঁকা মাঠ,সবুজের গালিচা পাতা,কোথাও বা দীঘি,ঢোকার মুখে সুন্দর মসজিদ ও প্রার্থনা করার জায়গা। সুন্দর ফুলের গাছ দ্বারা সাজানো। কোথাও লনে বন্ধুরা বসে একসাথে গল্প করছে। হলে ঢোকার মুখে লম্বা লাইন ভেরিফিকেশনের জন্য।
যাই হোক,পরীক্ষা হলে ঢুকলাম। তিনতলায় সিট পড়েছিল। এখান থেকে কলেজ ক্যাম্পাস আর নিউটাউনের সংলগ্ন অঞ্চলের অনেকটাই দেখা যায়। এই ইউনিভার্সিটিটা ইকোস্পেসের খুব কাছেই। যাই হোক,পরীক্ষা পর্ব সমাপ্ত হল। এরপর অন্যান্য পরীক্ষার্থী আর পরীক্ষার্থিনী দের সাথে আলোচনা কোন্ প্রশ্নের উত্তর কি হবে, কাট অফ কেমন যাবে ,ক্লিয়ার করতে পারব কি না- উদ্যম,উৎসাহ আর উদ্দীপনার এতোটাই বাড়বাড়ন্ত যেন তার পরের দিনই রেজাল্ট বেরোবে। একে তো শরীরের মধ্যে অ্যাড্রিনালিনের ফ্লো হচ্ছিলই, সব থেকে বড়ো ব্যাপার জেনারেল তো, তাই চাপটাও বেশি।
যাই হোক, একজনের সাথে আলাপ হল। নাম ঈপ্সিতা। ঈপ্সিতা মুখার্জী। একটা প্রশ্নের উত্তর কি হবে,রীতিমতো তর্ক বিতর্ক বাধার উপক্রম। ঈপ্সিতার সাথে গল্প করতে করতে( বলতে গেলে ঐ টপিক টা নিয়ে তর্ক করতে করতে ) বাইরে এলাম। বাইরে তখন অপূর্ব পরিবেশ। রোদ পড়ে আসছে,শীতের বেলা। আকাশ সামান্য মেঘলা করে এসেছে। আর তার মধ্যেই বইছে বাদলা হাওয়া। কাঁধ অবধি খোলা চুলের আর টপ-স্কার্ট পরা ঈপ্সিতা কে অপূর্ব লাগছে। ভুলে গেলাম,গুরুগম্ভীর তর্ক বিতর্ক। প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাদকতার পরশে মনের অনুভূতিগুলি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে।সব ভুলে গিয়ে ধরলাম ঈপ্সিতার কোমল হাত।নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে থাকলাম সেই গৌরবর্ণা সুস্তনী তন্বীর দিকে। ঈপ্সিতাও হয়তো বুঝতে পারল আমার মনের সূক্ষ্ম অনুভূতি। আমার দিকে তাকিয়ে মন চুরি করা এক মিষ্টি হাসি হাসল।
ঈপ্সিতার সাথে সব প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে( অবশ্যই ওটা ওর সাথে টাইম পাস করার ছল) ধরলাম নারকেল বাগান যাওয়ার বাস। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী আলোয় নারকেলবাগানের বিশ্ব বাংলা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে খালি আফসোস হচ্ছিল মনে, ঈশ্ এম সি কিউ আর কাট অফ এর চক্করে পড়ে ওর ফোন নাম্বার টাই নেওয়া হল না। পশ্চিম দিগন্তে অস্তমিত রক্তিম সূর্য। বইছে মৃদুমন্দ বাতাস। এই অঞ্চলটা যেমন অনেকটা ফাঁকা,গাছপালা প্রচুর,তেমনি এখানে কোলকাতার মূল অংশ থেকে দূষণও অনেকটা কম। খোলা বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেবার সময় মনে একটাই অনুশোচনা জেগে উঠছিল,প্রেমাস্পদার সাথে আর দেখা হল না। জনবহুল মহানগরীর মাঝে কোথাও যেন হারিয়ে গেল ঈপ্সিতা। মন ভরে যাচ্ছিল ভালোবাসার বা ভালোলাগার মানুষ থেকে বিচ্ছেদের ধূসর বিষাদে। কিন্তু,এই মন খারাপের মধ্যেও ছিল আশার সোনালী কিরণ । হয়তো আবার দেখা হবে ঈপ্সিতার সঙ্গে,আবার মিলবে প্রেমিকযুগল অদূর সোনালী ভবিষ্যতে!