নিরুপমা
নিরুপমা


"পিউ তাড়াতাড়ি কর,ট্রেনটা মিস হয়ে গেলে আবার একঘন্টা পর ট্রেন।"বলে সমস্ত ব্যাগগুলো আবার গুনে নিলেন পিউ-এর মা।
বেড়ানোর মুহূর্তে কলিং বেল বাজাতেই পিউ দরজা খুলে দেখে কালকে অনলাইন থেকে অর্ডার করা পার্সেলটা আজকেই এসে গেছে।
হাতে পার্সেলটা নিয়ে ডেলিভারি বয় বলল,"নিরুপমা রায়ের পার্সেল।"
হাত বাড়িয়ে বাক্সটা নিয়ে পিউ বলল,"আমিই নিরুপমা রায়।"
ছেলেটি কিছুক্ষণের জন্য অবাক হয়ে বলল,"এখানে সইটা করে দিন।"
স্টেশনে যাওয়ার সময় গাড়িতে বসে নিরুপমা তার মা বাবাকে বলল,"আর নাম পাওনি তোমরা আমার।সেই ব্রিটিশ আমলের নামের জন্য সব জায়গায় আমাকে নিয়ে তামাশা হয়।আজকের ছেলেটাও এমনভাবে তাকিয়ে রইল মনে হয় নাম শুনে ভেবেছিল কোন ৮০-৯০ বছরের বুড়ির পার্সেল।"
মেয়ের কথা শুনে মা বাবা দুজনেই হেসে উঠল।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কল্যাণ রায় বললেন,"নিরুপমা কথার অর্থ হল নাই উপমা যাহার।অর্থাৎ যার সাথে কারোর তুলনা হয় না,অতুলনীয়।"
একটু রাগ করেই নিরুপমা বলল,"দরকার নেই নামের এত অর্থ।আমার নামটা কে রেখেছিল?"
নিরুপমার মা,অমৃতা রায় জানালেন নামটি নিরুপমার দিদার দেওয়া। প্রভারাণী বড়াইয়ের সব থেকে আদরের নাতনি হল নিরুপমা।প্রভারাণীর পাঁচ ছেলে মেয়ের মধ্যে অমৃতাদেবী তার কনিষ্ঠ সন্তান।যথা সময়ে বিবাহ হলেও অমৃতাদেবী গর্ভবতী হতে পারছিলেন না। প্রভারাণীর বহু মনস্কামনার ফল হিসেবে অনেক বছর পর অমৃতাদেবীর কোলজুড়ে আলো করে নিরুপমার জন্ম হয়।
কল্যাণবাবুর এতদিন রাঁচীতে পোস্টিং থাকার দরুণ প্রায় আটবছর পর জামাইষষ্ঠী উপলক্ষ্যে নিরুপমা তার দিদাবাড়ি শিমুরালির ধানকুড়ায় যাচ্ছে।দুপুরের ভোজনের পর নিরুপমা তার দিদার সাথে নানারকম গল্প করতে থাকে।কথার মাঝে হঠাৎ তার মনে পড়ল নিজের এই নামের কথা।'নিরুপমা' নামকরণের কারণ জানতে চাওয়ায় প্রভারাণী জানালেন যেদিন নিরুপমার জন্ম হয় সেদিন তিনি কবিগুরুর লেখা 'দেনাপাওনা' গল্পটি পড়ছিলেন।নিরুপমার চরিত্রটি তার মনে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল।নিরুপমা ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল, আত্মমর্যাদাশীল,কষ্টসহিষ্ণু,পরার্থপরকারী একজন নারী।জীবন সংগ্রামে প্রতিপদে লড়াই করে গেলেও মৃত্যু বিপক্ষের কাছে হেরে যায়।প্রভারাণী দেবীর নাতনি এই সকল গুণের অধিকারী হয়ে কখনও যেন সে জীবন যুদ্ধে হেরে না যায় তাই এই নামকরণ তার।কিন্তু এইসব নিরুপমার বোধগম্য না হওয়াতে বইয়ের তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে 'গল্পগুচ্ছ' বইটি নিরুপমার হাতে দিয়ে প্রভারাণী বললেন,"সময় করে 'দেনাপাওনা' গল্পটা পড়িস,সব বুঝে যাবি।"
অন্যদিকে নিরুপমার বড়মাসির বড়ছেলে-পুস্কর সেন নিরুপমার জন্য একটি সম্বন্ধের কথা বলেন কল্যাণবাবুকে।ছেলের বাড়ি মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে।পশ্চিমবঙ্গের জনৈক রাজবংশের উত্তরসূরী হলেন দিবাকর লাহিড়ী এবং তার একমাত্র ছেলে সৌম্যক লাহিড়ী বিলেত থেকে ডাক্তারি পড়ে কিছুদিনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে এসেছে।এর মধ্যেই ছেলের বিয়ে দিয়ে চান লাহিড়ীবাবু।
বিয়ের পর একমাত্র মেয়ে বিলেতে চলে যাবে তা ভেবে প্রথমদিকে আপত্তি করলেও অমৃতাদেবী এত ভালো সম্বন্ধ হাতছাড়া করতে রাজি না হলে পরে নিরুপমার মতামত ছাড়াই শিমুরালিতেই নিরুপমাকে দেখার জন্য ছেলের বাড়িতে ফোনে আমন্ত্রণ জানান কল্যাণবাবু।
একসপ্তাহ পরে কলকাতায় চলে আসার পর একদিন হঠাৎ লাহিড়ীবাবু ফোন করে জানান নিরুপমা তাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে।পাঁচমাস পর সৌম্যককে বিলেতে চলে যেতে হবে। সুতরাং এর মধ্যেই তাদের চার হাত এক করে দিতে হবে।সৌম্যককে বিলেতে ডাক্তারী পড়ানোর জন্য পূর্বপুরুষের জমিগুলি বিক্রি করে ফেলেছেন লাহিড়ীবাবু। ভিটে বাড়ি আর অল্প কিছু চাষের জমি রয়ে গিয়েছে।পাঁচমাস পর নিরুপমাসহ সৌম্যককে বিদেশে পাঠাতে এবং ওখানে তাদের বসবাসের ব্যবস্থার জন্য আট লক্ষ টাকা নগদ চেয়েছেন লাহিড়ীবাবু।সাথে এও বলেন এই টাকা যেন পণ হিসেবে না দেখা হয়।তাদের কাছে এই নগদ ছিল নিরুপমার সুখের জন্য বিনিয়োগ মাত্র।
টাকার বিনিময়ে সুখ কিনে বিয়ে করতে চায়না বলে নিরুপমা নিজেই সৌম্যককে ফোন করে বিয়ে না করার প্রস্তাব দেয়।নিরুপমার এই পদক্ষেপের জন্য সে সৌম্যকের মনে এক বিশেষ স্থান করে নেয়। কোনও প্রকার দেনাপাওনা ছাড়াই তাদের বিয়ে হয়।এই ঘটনার জন্য শ্বশুরবাড়ির চোখের বালি হয়ে গিয়েছিল নিরুপমা।বিদেশে বাসস্থানের ব্যবস্থা করে নিরুপমাকে নিয়ে যাবে ততদিন তার মা-বাবার দায়িত্ব নিরুপমার হাতে দিয়ে সৌম্যক বিলেতে পাড়ি দেয়।
সৌম্যক বিলেতে চলে যাওয়ার পর থেকে নিরুপ
মার প্রতি তার শ্বশুরবাড়ির ব্যবহার ধীরে ধীরে কঠোরতর হতে লাগল।সকাল বিকেল মেয়েটাকে নানাভাবে অপমান করতে শুরু করল।একদিন খাওয়ার সময় বিয়ের আগের অভ্যাসবশত তার প্রিয় আলুপোস্ত শাশুড়ির কাছ থেকে একটু বেশি চাওয়াতে শাশুড়ি বলল,"আঃ কোথাকার লাটসাহেবের বেটি?জানো পোস্তর দাম কত এখন?বাবার থেকে টাকা নিলে আজ বিদেশে থাকতে।সৌম্যককে বিদেশে আবার পাঠাতে গিয়ে তোমার শ্বশুরকে লোন নিতে হয়েছে।সে সব নিয়ে তো কিছুই ভাবো না।শুধু এখানে বসে বসে অন্ন ধ্বংস করছো।"তারপর থেকে মেয়েটা পছন্দের খাবার বেশি খাওয়া তো দূরের কথা যা খেতে দিত কখনো যৎসামান্যই খেত আবার কখনো সবটাই তুলে রেখে দিত।
সৌম্যক বিলেত থেকে ফোন করলে কখনও নিরুপমা কাজে ব্যস্ত আছে বলে দিত না আবার কখনও ফোন দিলেও শাশুড়ি সামনে বসে তাদের সমস্ত কথোপকথন শুনত।স্বামীর সাথে একান্তে দুটো কথা বলার জন্য আকুল হয়ে একদিন সে তার নিজের ফোন থেকে সৌম্যককে ফোন করে।যা বাড়ির কাজের মেয়ের থেকে জানতে পেরে তার শ্বশুর-শাশুড়ি খেপে ওঠে।তাদের নামে কুকথা বলে ছেলের মগজধোলাইয়ের চেষ্টা করছে এই ভেবে তারা নিরুপমার ফোন ভেঙে দেয়।তবুও সেদিন সব কিছু মুখ বুঝে সহ্য করেছিল মেয়েটি।সকলের আদরে বেড়ে ওঠা নিরুপমা আজ মানসিক নির্যাতনের শিকার তা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে না পেরে কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি যেতে চায় তা শ্বশুর-শাশুড়িকে জানালে তারা সুচতুর ভাবে সৌম্যককে দিয়ে ফোন করিয়ে নিরুপমাকে জঙ্গিপুরেই থাকার কথা বলে যতদিন না সৌম্যক দেশে ফিরছে।সৌম্যক নিরুপমাকে ভীষণ ভালোবাসে।সে যদি জানতে পারে তার নিরু এত কষ্টতে আছে তার পক্ষে বিদেশে থাকা সহজ হবে না।নিজের জন্য সৌম্যকের পেশাগত জীবনে যেন কোন প্রকার আঁচ না আসে এই ভেবে তাকে না জানিয়ে দিনের পর দিন সব কিছু মুখ বুঝে সহ্য করছিল নিরুপমা।
কল্যাণবাবু রোজই ফোন করে মেয়ের খোঁজ নেন।কিন্তু পরপর দুদিন মেয়ের ফোন বন্ধ থাকায় চিন্তিত হয়ে লাহিড়ীবাবুকে ফোন করলেও মেয়ের সাথে কথা তারা কখনই বলায় নি উপরন্তু নানা কটূ কথা বলে অপমান করে ফোন কেটে দিত। একসপ্তাহ পরে কারোকে কিছু না বলে কল্যাণবাবু মেয়েকে আনতে চলে যান।নিরুপমার জীর্ণ শরীর, চোখের নিচে কালো দাগ,শুষ্ক মুখ দেখে কল্যাণবাবু মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে,"চল মা,নিজের বাড়িতে চল।এখানে থাকলে মরে যাবি।"বাবার চোখের জল মুছে নিরুপমা জানায় সৌম্যককে কথা দিয়েছে সে না আসা পর্যন্ত এখান থেকে কোথাও যাবে না।সৌম্যককে সেই মুহূর্তে ফোন করতে চাইলে নিরুপমা বাধা দেয়।মেয়ের করুণ দশা দেখে তার শ্বশুরবাড়িতে টাকা দেওয়ার কথা বললে নিরুপমা তার বাবাকে বলে,"আমি কি টাকার সমতুল্য,টাকা দিলেই আমার সম্মান হবে!বরং এই টাকা দিলেই আমার অপমান।"মেয়ের মাথায় বুলিয়ে কল্যাণবাবু বললেন,"সত্যি তোর নাম সার্থক আজ,নিরুপমা-অতুলনীয়।ভালো থাকিস মা।"
সারা পশ্চিমবঙ্গে চারিদিকে যখন ডেঙ্গুর ছড়াছড়ি তখনই নিরুপমা প্রচণ্ড জ্বরে শয্যাশায়ী। মেয়েটার সমস্ত শরীর তাপে পুড়ে গেলেও একজনও কেউ তার শুশ্রুষা করতে এল না।দুদিন মেয়েটা ঘরে না খেয়ে একাই পরে থাকতে দেখে লাহিড়ীবাড়ির দারোয়ান বনবিহারীর স্ত্রী চম্পা নিজের হাতে মেয়েটির শুশ্রুষা করে একটু সুস্থ করে তুললেও মানসিক দিক থেকে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে নিরুপমা।
"এই বাড়িতে কি কেবল আমি পণ্য বস্তু!যার মূল্য টাকা দিয়ে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।সৌম্যক কি আমাকে বিদেশে নিয়ে যেতে পারবে?না আমি এই নরকে তিলে তিলে মরব?কয়েকমাস পর বাবা রিটায়ার্ড করবে,বাবার কাছে গিয়ে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না।এই ভাবে রোজ অল্প অল্প করে না মরে একে বারে মরে গেলেই এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারি।যদিও আমার আত্মার তো কবেই মৃত্যু হয়ে গেছে,কেবল জীর্ণ দেহটাই পড়ে আছে।"হঠাৎ করে একদিন নিরুপমা ভাবতে লাগল।সেদিন রাতেই সুইসাইড নোটের শেষে নিজের নাম লিখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় নিরুপমা।নিজের নাম দেখে দিদার কথা মনে পড়তেই বইয়ের আলমারি থেকে 'গল্পগুচ্ছ' বইটি বার করে 'দেনাপাওনা' গল্পটি পড়ে দিদার কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পারে নিরুপমা। ভোর রাতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে বনবিহারীর ফোন থেকে সৌম্যককে ফোন করে নিরুপমা এতদিনে ঘটে যাওয়া সমস্ত কিছু তাকে জানায়।এরপর বনবিহারী ও চম্পার সাহায্যে কলকাতায় মা-বাবার কাছে এসে আইনি পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিলে সৌম্যক তাতে পূর্ণ সহমত পোষণ করে,কারণ স্বাধীনচেতা সৌম্যক প্রথম থেকেই এই ঘৃণিত কাজকে অসমর্থন করে এসেছে।আর যাতে কোনও নিরুপমাকে পণপ্রথার শিকার হতে না হয় তাই জীবনযুদ্ধে প্রতিপদে লড়াই করে শেষপর্যন্ত পণপ্রথাকে হারিয়ে দেয় আজকের নিরুপমা।