ইচ্ছেডানা
ইচ্ছেডানা


"দিদি,বর এসে গেছে। চলো,শ্যুটটা করে নি।"
"তুই অর্ককে বল পোটট্রেটটা ভালো করে তুলতে,আমি এই লেন্সটা লাগিয়েই আসছি।"ক্যামেরার লেন্স চেঞ্জ করতে করতে সম্প্রীতি বলল। বিয়ের লগ্ন ছিল রাত ১২টায়।স্বাভাবিকভাবে সেদিনও সম্প্রীতির বাড়িতে ঢুকতে ৩ টে বেজেছিল।নকল চাবি দিয়ে দরজা খোলার আগেই সম্প্রীতির বাবা দরজাটা খুলে দেয়।- বাড়িতে ঢুকে জুতো খোলার সময় সম্প্রীতি তার বাবাকে বলল," আজকেও জেগে আছো? রোজ রোজ এত রাত পর্যন্ত কেন জেগে থাকো?"
- দরজায় তালা লাগিয়ে সম্প্রীতির বাবা বলল,"মেয়ে এত রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকলে কোন বাবার চোখে ঘুম আসে?"-"আমার কাজটা তুমি জানো,আর আমি যে সমস্ত ওয়েডিং ফটোগ্রাফারদের সাথে কাজ করি তারা আমাকে বাড়ির গেট পর্যন্ত পৌঁছে দেয় যতই রাত হোক না কেনো।"
-"আর আত্মীয়-স্বজন কি বলবে?"
প্রত্যেকবার কাজ থেকে ফিরে একই বিষয় নিয়ে বাবার সাথে কথোপকথন সম্প্রীতির প্রায় রোজকার রুটিন হয়ে গিয়েছিল।দুজনে ভিন্ন পথের পথিক হলেও দুজনের দিক থেকে তাদের পথ দুটোই নির্ভূল।সম্প্রীতি উত্তর কলকাতার সম্ভ্রান্ত - যৌথ - বনেদি পরিবারের অরুণাভ রায়ের একমাত্র মেয়ে।বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভেবে একমাত্র মেয়ে বাড়ির বাইরে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করবে সেটি বাবা হিসেবে অরুণাভ বাবুর কাছে যেমন দুশ্চিন্তার বিষয় তেমনই পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনরা পরোক্ষভাবে কথা শোনাতো যে মেয়ে হয়ে ফটোগ্রাফার তার ওপর অত রাতে বাড়ি ফেরা - তা কোনোভাবেই অরুণাভবাবু মেনে নিতে পারছিলেন না।
"মা,আমি আসছি।একটু আগে পত্রিকার অফিস থেকে ফোন এসেছিল বিশিষ্ট পরিচালক মুম্বাই থেকে আসছেন।আজ ওনার ইন্টারভিউ আছে।তাই ফটো কভার আপ করার জন্য ডেকেছে।"ক্যামেরা,লেন্স,স্ট্যান্ড সব কিছু ব্যাগে রাখতে রাখতে সম্প্রীতি তার মাকে বলল।
-"বিকেল পাঁচটায় মানুষ অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরে আর তুই এখন কাজে যাচ্ছিস।"
-"দশটা- পাঁচটার কাজ করার হলে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি ছেড়ে এই পেশায় আসতাম না।"মায়ের উপর রাগ করে সম্প্রীতি বলল।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সম্প্রীতির মা বলল,"তোর বাবা ভীষণ ভালোবাসে তোকে তাই তোকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে।"কলেজের পড়াশোনা শেষ করার এক বছরের মধ্যে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি পায় সম্প্রীতি।কয়েক মাসের মধ্যে তার কাজের জন্য প্রোমোশনও হয় কিন্তু কোথাও দশটা- পাঁচটার জীবন ও মোটা মাইনের চাকরি সম্প্রীতিকে সন্তুষ্টি করতে পারছিল না।গঙ্গার ঘাটে গিয়ে সূর্যাস্ত থেকে কলকাতার রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ছবি তোলা সবই কোথায় যেন হারিয়ে ফেলছিল সে ।মনের মধ্যে কোথাও পেশা আর নেশার মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল। অফিসের নিয়মমাফিক কাজের রুটিনের ছক তার নেশাকে ধীরে ধীরে ফিকে করে দিচ্ছিল।শেষ পর্যন্ত ছবি তোলার নেশার হাত ধরে দশটা- পাঁচটার গণ্ডি পেরিয়ে আসে।
ইন্টারভিউ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি এসে ডিনার করে ল্যাপটপ নিয়ে সম্প্রীতি এডিটিং - এর কাজ করে।রাতে বিয়ে বাড়ির কাজ না থাকলে এমনিতেই সারা রাত জেগে তার এডিটিং - এর কাজ চলে। হঠাৎ ফোনে ওয়াটস অ্যাপের মেসেজের নোটিফিকেশন আসায় ফোন হাতে নিয়ে দেখে জয়জিৎ(দা)- এর মেসেজ - "ক্যান ইউ টক টু মি? ইটস আর্জেন্ট।"মেসেজ দেখামাত্রই সম্প্রীতি জয়জিৎ কে ফোন -"হ্যালো,কি হয়েছে?"-"সরি, এতো রাতে তোকে বিরক্ত করার জন্য।"
-"আরে না না,ঠিক আছে কি সমস্যা হয়েছে বলো।"
-"কাল এক শিল্পপতির ছেলের বিয়ে,সেই বুঝে টিম সাজিয়ে ছিলাম।কিন্তু কিছুক্ষন আগে সৌরভ জানাল ওর মা হসপিটালাইজড,কাল ও যেতে পারবে না।আর এই মুহূর্তে তুই ছাড়া কেউ সৌরভের জায়গায় কাজটা করতেও পারবে না।জানি বিয়ের মরশুম আর তোর নিজের টিমও আছে।অনেক ব্যস্ত তুই।সব জেনেও তোর কথাই মনে এলো।"অনে
কটা আশ্বাস নিয়ে একটু সংকোচ করে এক নিমেষে জয়জিৎ কথাটি বলে গেল।-" তোমার হাত ধরেই আমার এই পেশায় আসা এবং তোমার কথার উপর বিশ্বাস করে নিজের টিম নিয়ে এখন কাজ করি।যতই কাজ থাকুক তোমার সমস্যায় পাশে আছি।"
-"তুই বাচালি আমাকে।আমি এক্ষুণি তোকে কনফারমেশন লেটার ইমেইল করে দিচ্ছি।"
চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সপ্তাহখানেক পর পরিবারের সদস্যের নানা মন্তব্য,বেকারত্ব, একাকিত্বের বিষন্নতা সম্প্রীতিকে গ্রাস করতে থাকে।কোন কিছুই তার ভালো লাগছিল না।এমনকি যার জন্য এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া সেই ক্যামেরাকেও অনেক দিন স্পর্শও করে নি।একদিন হঠাৎ করে ভোর বেলায় একাই ক্যামেরা নিয়ে কলকাতার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।তারপর থেকে ক্যামেরাই তার সাথী হয়ে গিয়েছিল এবং সেই ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে থাকে।এই সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারদের সাথে তার পরিচয় হয়।তাদের মধ্যে একজন হলেন জয়জিৎ গুহ।সম্প্রীতির পোস্ট করা ছবিগুলো দেখে পছন্দ হওয়ায় তার টিমে কাজ করার প্রস্তাব দিলে সম্প্রীতি রাজি হয়ে যায়।কিন্তু এই পেশায় যাওয়াটা তার পক্ষে এতটা সহজ ছিল না,কারণ সেই সময় মেয়েরা পেশা হিসেবে ফটোগ্রাফি করবে এটা সমাজ একটু বাঁকা চোখেই দেখত। পরিবারের অনেক আপত্তি থাকা সত্ত্বেও এই সুযোগ হাতছাড়া করেনি।বছরখানেকের মধ্যে নিজের কাজের জন্য কলকাতার অনেক বড় বড় ফটোগ্রাফারদের সাথে কাজ করার সুযোগ পায়।
একদিন হঠাৎ তার স্কুলের বান্ধবী তার বিয়ের ফটোশ্যুটের জন্য সম্প্রীতিকে বলে।সেই সময় জয়জিৎই প্রথম যে সম্প্রীতিকে সাহস জুগিয়েছে অন্যের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের টিম নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ছোট থেকেই সম্প্রীতির ছবি তোলার সখ। রিলের ক্যামেরা থেকে ডিজিটাল ক্যামেরা,মোবাইল ক্যামেরা সবই ছিল তার নখদর্পণে। এতদিন জন্মদিনে মামার কাছ থেকে পাওয়া ডিএসেলার ক্যামেরা দিয়েই ফটো শ্যুট করলেও নিজের রোজগারে প্রথম দামি ক্যামেরা দোকানে কিনতে গিয়ে একটা পোস্টার তার জীবনের একটি নতুন মোড়ের সূচনা করে।সেই পোস্টারে লেখা ছিল যে সমগ্র ভারতবর্ষের বাছাই করা মোট ৩০জন ফটোগ্রাফারদের নিয়ে তিনদিনব্যাপী কাজিরাঙা অভয়ারণ্যে একটি প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হবে।যদিও মাঝেমধ্যেই ও বেরিয়ে পড়ত প্রকৃতির টানে।বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন প্রজাতির জীবজগৎ বন্দি হত তার ক্যামেরায়।যদিও এর জন্য কম কথা শুনতে হয়নি সম্প্রীতির - মেয়ে হয়ে একা কলকাতার বাইরে যাবে ঘুরতে? পাহাড়ে জঙ্গলে একা মেয়ে হয়ে কি করে থাকবে? সব প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে সে এগিয়ে যাচ্ছিল নিজের মনের পথ অনুসরণ করে। ফটোগ্রাফি আবার কোনও পেশা হয় নাকি? এর ভবিষ্যৎ কী? এসব আবার মেয়েরা করে নাকি? বিয়ের পরও এসব কাজ করবে? এই ধরনের বিভিন্ন প্রশ্ন করা লোকের অভাব ছিল না। তাই এইবারও তিরিশজনের মধ্যে নির্বাচিত হয়ে সকলের সমস্ত প্রশ্নকে উপেক্ষা করে আসামে পাড়ি দেয়।
প্রতিযোগীতার একসপ্তাহ পর সম্প্রীতিকে ফোন করে জানানো হয় সে বিজয়ী হয়েছে এবং তার তোলা ছবিগুলো কলকাতার এক গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হবে।
প্রদর্শনের কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন সম্প্রীতির কাছে মুম্বাই থেকে ইমেইল আসে ভারতের সবথেকে বড় ফটোগ্রাফারের পক্ষ থেকে। ইমেইলে লেখা ছিল - প্রতিযোগিতা আয়োজক কোম্পানী তিরিশজনের তোলা ছবি নিয়ে ম্যাগাজিন করে,যেখানে সম্প্রীতির কাজ তার সবথেকে পছন্দ হয়েছে এবং তাকে সিনিয়র একজিকিউটিভ ফটোগ্রাফার হিসেবে নিযুক্ত করতে চান।
"দিদি এয়ারপোর্ট চলে এসেছে।"উবের ড্রাইভার কথাটি বলতে সম্প্রীতির খেয়াল হল সে এখনও গাড়িতেই আছে।পুরনো জীবনের লড়াইয়ের দিনগুলির কথা মনে করতে করতে কখন সে এয়ারপোর্ট এসে গেছে বুঝতেই পারেনি। কলকাতা সম্প্রীতির স্বপ্নের আঁতুড়ঘর ছিল,যেখানে প্রকৃতভাবে এই কাজের জন্য সে কারোর সমর্থন পায়নি বরং নিজের ইচ্ছেশক্তির দ্বারা সমস্ত বাধা পেরিয়ে কেবল এগিয়ে গেছে।এতদিন তার স্বপ্নের হাতেখড়ি হলেও এখন তা ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর সময়।কিন্তু সেই পথও কি কাঁটা দিয়ে মোড়া ?
সম্প্রীতির ফ্লাইট কলকাতার বুক চিরে উড়ে চলল এক নতুন পথে।