Keya Chatterjee

Drama

3  

Keya Chatterjee

Drama

নির্বোধ

নির্বোধ

3 mins
3.2K


"এমন বুদ্ধি নিয়ে যে কিভাবে সংসার করতে এলে, ভেবে পাইনা"; "এটাও বোঝো না কোন কাজটা আগে করতে হবে? এত দিন তো হলো, আর কবে বুঝবে?" ; "তোমার মা হওয়ারই যোগ্যতাই নেই, বাচ্চার প্রয়োজনগুলো বুঝতে শেখনি এখনো!"

কথাগুলি একনাগাড়ে আট বছর ধরে শুনে শুনে ক্লান্ত চৈতালি। কি যে তার যোগ্যতা, আর কি যে তার গুণ সবই ভুলতে বসেছে সে এই ক'বছরে। ধীরে ধীরে নিজের ওপর একটা বিতৃষ্ণা জন্মাচ্ছে তার, বুঝতে পারছে। সত্যি এতদিনেও কাজ শিখল না, রন্ধন পটিয়সী হলো না সে। ওদিকে পাশের বাড়ির বৌদি, নতুন বউরা তার কাছে উদাহরণ হয়ে উঠছে। তার বাগ্মী, তারা উপস্থিত বুদ্ধিধারী, তারা চটুল, তারা চতুর। চৈতালি সে পর্যায়েই পড়ছে না। কথা বলতে গেলে চারবার ভাবে কি বলতে যাচ্ছে, রাঁধে তবে তা শুধুই গলাদ্ধকরণ করা যায়,( বরের কথা অনুযায়ী,)সাজতে জানে না, রূপসীও নয়। এক কথায় ঢেঁড়স।

নিজেকেই নিজে ঘৃণা করতে শুরু করে চৈতালি। সে ভুলতে থাকে তার প্রিয় হারমোনিয়ামের ধূলো ঝাড়তে, সে ভুলে যায় কবিতার খাতা খুলে চার কলম লিখতে, সে ভয় পায় একলা সময়ে গান ধরতে।

কিছুদিন হলো চৈতালি বুঝতে পারছে তার সাত বছরের ছেলে বুবুনও তাকে ঘৃণার চোখেই দেখছে। বাচ্চাটাও বা আর কি করবে! ছোটবেলা থেকেই তো শুনে আসছে মায়ের অপারগতার বৃত্তান্ত। সেই প্রভাবেই হয়তো বা বাস্তবিক অপটুতার জন্য সেও বিরক্ত মায়ের উপর। চিৎকার করে কথা বলা, রেগে যাওয়া, “কাজ পারোনা” শব্দবন্ধ ব্যবহার করা তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। চৈতালি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে সে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। শান্ত স্বভাবটা মুছে যাচ্ছে। ধৈর্য্য ভেঙে যাচ্ছে। রাগ হচ্ছে। চিৎকার করছে। ছেলে দুটো কথা শোনালে তার পিঠে আরো চারটে চড় পড়ছে। শাশুড়ি বলল, “সংসারে অলক্ষী ঢুকেছে।” চাইতালু বুঝতে পারছে না তার রাগটা কার উপর, নিজের ওপর না বাড়ির সকলের ওপর। বাপের বাড়িতেও একই রকম অবস্থান তার। সম্মান তো দূরের কথা গুরুত্বটাই নেই। সেটা বিয়ের আগে থেকেই। নানান চিন্তায় চৈতালির মাথাটা গুলিয়ে আসে। চোখে এক উদাসীনতা ভর করে। কাজে আরো ভুল হতে থাকে। সবার কাছে আরো বেশি হাসির খোরাক হয়ে ওঠে। মুখের ভাষা হারিয়ে যায়।

একদিন এক সন্ধে বেলা সে স্বামী পুত্র সহ যায় স্বামীর অফিস পার্টিতে। সে না যেতে চাইলেও তাকে জোর করেই নিয়ে যায় তার স্বামী। চারিদিকের চাটুকারিতা ও চতুলতার মাঝে চৈতালি সেই আবার বেমানান। হোটেলের ছাদ থেকে তার চোখ আটকে যায় ওপরের ফুটপাথের কিছু ভিখিরি বাচ্চাদের উপর। খিদের জ্বালায় কাঁদছে আর তাদের কান্না থামাতে মা বেদম প্রহারে রত। যেন মার খাইয়ে সে বাচ্চা গুলোর খিদে ভোলাতে চাইছে। এদিকে ছাদের ওপরে মুখোশেরা থালা ভর্তি খাবার ফেলে দিচ্ছে ডাস্টবিনে। বৈপরীত্য বরাবরই চোখে লাগে চৈতালির। আজ কেন কে জানে বসে থাকতে পারল না। এক প্লেট খাবার নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল নীচে। প্লেট নিয়ে নামতে দেখে সবাই অবাক। তার স্বামী এবং পুত্রটিও। দারোয়ান বাধা দিলেও থামল না সে। এক দৌড়ে রাস্তা পার করে মাটিতে বসেই খাওয়াতে লাগল শিশু দুটিকে। ব্যাপারটা এতটাই অকস্মাক যে চৈতালির স্বামী পুত্র ছাড়াও পার্টির সকলে এমনকি বাচ্চা গুলির মা টিও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল চৈতালির দিকে। খাওয়া শেষ হতেই উঠে দাঁড়াল সে। পিছন ফিরতেই এক অমোঘ চড় এসে পড়ল তার গালে। “পাগল। জীবনটা হেল করে দিল।” স্বামীর মুখে এই কথাটিই শোনা হয়তো বাকি ছিল। দেখল ছেলেটিও ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল বাবার হাত ধরে। ভাগ্যক্রমে গাড়িতে স্থান পেয়েছিল সে সেই রাতে।

পরের সন্ধে স্বামী ফিরে এসে তার খবর নিল। চৈতালি তখন চা পানে রত। স্বামীর ব্যবহারে বিস্মিত হল সে। হঠাৎ তার খোঁজ? অপরাধ বোধ? ফ্রেস হয়ে বৈঠকখানায় বসে মায়ের কাছে রহস্যের ঝুলি খুললেন পতিদেব। “তোমার বৌমার পাগলামিতে আমার মাথা কাল হেট হলেও একটা উপকার হল মা। স্যার আমায় আজ ডেকে আমাদের অফিসের যে নতুন ব্রাঞ্চ হয়েছে রাজারহাটে সেখানকার একটা গুরু দায়িত্ব আমায় দিলেন। জানো কি কাজ, এন. জি.ও গুলির সঙ্গে যোগাযোগ করা আর আমাদের কোম্পানির সাথে তাদের যুক্ত করা। আজ স্যারের বাড়িতে আমাদের নিমন্ত্রন। উনি তোমাকেও নিতে চান এই প্রজেক্টে। রেডি হয়ে থেকো কিন্তু…”

শুনতে শুনতে হাসতে লাগল চৈতালি। প্রথমে নীরবে তারপর জোরে আরো জোরে। “চৈতালি চৈতালি, অমন নির্বোধের মত হাসছো কেন? চৈতালি।” চৈতালি হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে তার চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। দূরে দাঁড়িয়ে ছেলে দেখে কিছু নির্বোধ অবাক চোখে তাকিয়ে তার মায়ের দিকে।

★★★★★★★★★★★★

সমাপ্ত

★★★★★★★★★★★★


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama