নীরব ভালোবাসা
নীরব ভালোবাসা
নিজেই গাড়ি চালিয়ে সুপ্রিয় নার্সিংহোম থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার মাঝ খানে একটা জটলা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। গাড়ি থেকে নেমে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় । একটা এক্সিডেন্ট! নীরব দর্শকদের মাঝ খান থেকে আহত যাত্রীকে গাড়িতে তুলে,তার বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে সোজা একেবারে নার্সিংহোম। ছোট মেয়েটিকে একজন নার্সের হেফাজতে দিয়েই আহত মেয়েটির চিকিৎসা শুরু করে দেয়। সারা রাত সেদিন সুপ্রিয় আর বাড়ি ফিরতে পারে না। ভোরের দিকে মেয়েটির জ্ঞান ফেরে।
চোখ খুলেই সে তার মেয়ে সুরুতি কে দেখতে চায়। সুপ্রিয় তাকে মেয়ের ব্যপারে আশ্বস্ত করে। একটু পরে মেয়েকে নিয়ে এসে তার সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে যায়। জানতে চায় তাদের বাড়ির ঠিকানা, তার নাম। মেয়েটি তাকে জানায় - তার নাম দেবীকা। বাড়িতে চিন্তা করবার মত তার কেউ নেই, কারণ মেয়ে ছাড়া তার আর কেউ নেই। সুপ্রিয় অবাক হয়ে কথাগুলি শোনে। বিকালের দিকে সুরুতিকে তার মায়ের সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় দেবীকা কে বলে যায়, যতদিন না সে সুস্থ্ হচ্ছে ততদিন তার মেয়ে সুপ্রিয়র কাছেই থাকবে। দেবীকার মুখের থেকে কোনো কথা সরে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে সুপ্রিয়র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুরুতিকে নিয়ে সে তার বাড়ি নিয়ে আসে। বাড়ি বলতে সে আর তার কাজের মাসি। সুপ্রিয় সারাজীবনই একটু পরোপকারী। এর মাঝে একদিন সে সুরুতি ও দেবীকার জন্য কিছু জামা কাপড় কিনে নিয়ে আসে। নিজের মনেই ভাবে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছে নাতো? এই ভাবে প্রায় দিন পনের কেটে যায়।দেবীকারও ছুটি হয়ে যায়। তার আপত্তি সত্ত্বেও সে দেবীকাকে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। নার্সিংহোম এ থাকাকালীন সময়ে সে দেবিকার কাছ থেকে তার সম্মন্ধে মোটামুটি সব জেনে নেয়। ভালোবেসে মা বাবার অমতে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল। অরুন মানে দেবীকার স্বামী ছিলো বেসরকারী সংস্থার একজন সামান্য চাকুরীজীবি। সুখেই ছিলো তারা। অভাব থাকলেও দুজনের ভালোবাসার মধ্যে তা কখনোই প্রভাব ফেলতে পারেনি। মেয়ের যখন চার বছর বয়স; তখন হঠাৎ করেই অরুনের ক্যানসার ধরা পরে। বলতে গেলে প্রায় বিনা চিকিৎসায় অরুন মারা যায়। কয়েকটি টিউশনি আর দোকানে দোকানে সেলাই করেই কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে আছে।
দেবীকা ও তার মেয়ে সুপ্রিয়র বাড়িতেই থেকে যায়। দেবীকার সাথে সুপ্রিয়র খুব একটা দেখা হয় না বললেই চলে। শুধু রোজ বেরোনোর আগে খাবার টেবিলে একবার দেবীকার সাথে সুপ্রিয়র দেখা হত; সুপ্রিয় বুঝতে পারে আস্তে আস্তে সে দেবীকার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। সুরুতিকেও যতটুকু সময় সে ঘরে থাকে তাকে সে কাছ ছাড়া করতে চায় না। সুরুতি ও ডাক্তার আঙ্কেল কে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। অধিকাংশ রাতে সে আঙ্কেল এর ঘরেই বসে থাকতে থাকতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। পরে তার মা এসে তাকে নিয়ে যায় বা সুপ্রিয় এসে তাকে পৌঁছে দিয়েই চলে আসে।
কাজের মাসির কাছ থেকে সুপ্রিয়র অতীতের কথা আস্তে আস্তে দেবীকা সব জেনে নেয়। সুপ্রিয়র বাবা ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী। প্রায়ই ব্যবসার কাজে তাকে বাইরে যেতে হত। একদিন ব্যবসার কাজে শিলিগুড়ি যাওয়ার মাঝপথ থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। সুপ্রিয় তাকে বড় নার্সিংহোমে ভর্তিও করে। কিনতু সকলের সব চেষ্টা বিফল করে চিরদিনের মত চলে যান। হঠাৎ করে স্বামীর এই চলে যাওয়াকে সুপ্রিয়র মা কিছুতেই মানতে পারেননা; তিনি খুবই ভেঙ্গে পড়েন ও তিন মাসের মধ্যে তিনিও বিদায় নেন। সুপ্রিয়ও তখন সম্পূর্ণ একা ঐ পৃথিবীতে।
সুপ্রিয় যে নার্সিংহোমে চাকরী করে সেখানেই আয়ার কাজ করতেন তার এই কাজের মাসি। অধিকাংশ সময়েই সুপ্রিয় কাজের শেষে নার্সিংহোম থেকে বাড়ি ফিরে যেতনা। নাওয়া, খাওয়া ঘুম কোনোকিছুরই ঠিক ছিলোনা। দুমাস এভাবে কাটার পর এই মাসিই তাকে বলে, "ডাক্তারবাবা আমার তো এখন আর কেউ নেই; একটা মেয়ে ছিলো| তুমি টাকা পয়সা খরচ করে তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছো। তোমাদের আশীর্বাদে সে ভালোই আছে। এই বয়সে আমার আর চাকরি করে কি লাভ? আমাকে তোমার সাথে তোমাদের বাড়ি নিয়ে চলো। তোমাকে দুটি রান্না করে দেবো আর নিজে দুটি খাবো।"
মহিলা তার ডাক্তারবাবাকে খুবই ভালোবাসেন কারন সুপ্রিয় ভীষণ পরোপকারী ছেলে। মানুষের বিপদ দেখলেই সে ঝাঁপিয়ে পরে। মহিলার মুখে এই কথা শুনে ও তার কাতর মিনতিতে তাকে সে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। আর সেই থেকে এই মাসিই সুপ্রিয়র বাড়ির সর্বময় কত্রী। দেবীকা মনেমনে ভাবে মানুষটা দেখি সব হারিয়ে আমার মতই দুখী পৃথিবীতে। এ রকম মনের মানুষ আজকের দিনে পৃথিবীতে দুর্লভ! এইভাবে সময় পেলেই মাসির কাজের ফাঁকে দেবীকা সুপ্রিয় সম্পর্কে আনেক কিছুই জেনে নেয়। অনেক সময় মাসির কাজের সাহায্যের জন্য দেবীকা এগিয়ে গেছে। কিনতু মাসি তাকে কোনই কাজ করতে দেয়নি যেহেতু তার ডাক্তারবাবা তাকে নিষেধ করে দিয়েছেন।
একদিন নার্সিংহোম থেকে সুপ্রিয় সন্ধ্যা নাগাদ বাড়িতে ফিরে এসে সুরুতি কে নিয়েই তার ঘরে সময় কাটাতে থাকে। হঠাৎ কাজের মাসি এসে তাদের লুচি, আলুরদম টিফিন দিয়ে যায়। সুপ্রিয় একটু অবাক হয়েই মাসির কাছে জানতে চায়, "তুমি এটা করলে মাসি?" "আমি না দিদিমনি করেছে"- কথাটা বলে মাসি বেড়িয়ে যায়। খাওয়া শেষ করে সে অপেক্ষা করতে থাকে কখন দেবীকা সুরুতিকে ডাকতে আসে আর সে তার মনের কথাগুলি তাকে বলতে পারে। কিন্তু না - ডাক পড়লো একেবারে খাবার টেবিলে। আজ দেবীকাই সুপ্রিয় ও সুরুতিকে খেতে দিলো।
সুপ্রিয় জানতে চাইলো মাসিকে দেখতে পারছে না কেন?
"মাসিকে আজ আমি খেয়ে শুয়ে পড়তে বলেছি।"
"আমি আছি তো- আপনার কোনো অসুবিধা হলে আমায় বলুন না!"
দেবীকার কথায় সুপ্রিয় তার দিকে তাকালো ।
পরক্ষনেই মুখটি নীচু করে নেয়- পাছে তার দুর্বলতা ওই ডাগর চোখ দুটিতে ধরা পড়ে যায়। খেতে খেতেই সে বুঝতে পারে এটা মাসির রান্না নয়। সে দেবীকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, "খামোখা অসুস্থ্ শরীরে এই পরিশ্রম করার কোনো দরকার ছিল?"
"আপনি এতো কিছু করলেন আমাদের জন্য আর আমি একবেলা রান্না করে খেতে দিলাম এটা খামোখা হোলো?"
সুপ্রিয় কোনো উত্তর দেবার মত ভাষা খুঁজে পেলো না। বার বার বলা সত্ত্বেও দেবীকা একসাথে খেতে বসে না। টেবিল ছাড়ার আগে সুরুতির হাত ধরে চলে যেতে যেতে সে বললো, "তুমি খেয়ে সুরুতি কে নিয়ে এসো।"
পরদিন সকাল বেলা সুপ্রিয় যখন তৈরী হচ্ছে নার্সিংহোম যাবার জন্য; তখন মেয়ের হাত ধরে দেবীকা তার ঘরে ঢুকেই ঢিপ হয়ে তাকে এক প্রনাম করলো। মায়ের দেখাদেখি মেয়েও তাকে অনুসরণ করলো। সুপ্রিয় তাকে কোলে তুলে নিয়ে দু'গালে দুটি চুমু খেলো।
সুরুতি তাকে বলল, "দেখো আঙ্কেল মা কিছুতেই আমার কথা শুনছে না, বলছে -আজই বাড়ি চলে যাবে। তুমি মাকে একটু বোঝাও না,আমার তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না।"
সুপ্রিয় এ কথা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। সুরুতিকে কোল থেকে নামিয়ে দাঁড়িয়েই থাকলো। যখন ঘোড় কাটল দেখে মেয়ের হাত ধরে দেবীকা ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে সুরুতিকে বললো,"আচ্ছা তুমি একটু ওই ঘরে যাও- আমি মাকে বুঝিয়ে বলছি।"
সুরুতি চলে গেলো। সুপ্রিয় দেবীকার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। দেবীকা মাথা নীচু করেই আছে।
-- "কোথায় যাচ্ছ?"
--"জানিনা, তবে আর কতদিন থাকবো এখানে?যেতে তো হবেই।"
--"কেন যেতেই হবে কেন? কে তোমাদের যেতে বলছে? তোমাদের কিছুতেই যাওয়া হবে না।"
সুপ্রিয় আর একটু দেবীকার কাছে এগিয়ে যায় ,আলতো কোরে তার মুখটি তুলে ধরে বলে,"আমার দিকে তাকাও দেবী|"
দেবীকা তার জল ভরা ডাগর চোখ দুটি মেলে সুপ্রিয়র মুখের দিকে তাঁকিয়েই ফুঁফিয়ে কেঁদে ও
ঠে। মূহূর্ত্বে সে সুপ্রিয়র পায়ের কাছে বসতে যায়। সুপ্রিয় শক্ত হাতে দেবীকাকে তুলে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলে,
--"তোমার জায়গাটা ওখানে নয়; তোমার জায়গা এখানে।"
--এতো বোকা তুমি? নিজের মনের কথাটা না হয় বলতে পারছ না; আমার মনের কথাটাও কি বুঝতে পারছ না? যাওয়ার কথা বলছ কি করে? আমারও তো কেউ নেই। সেই কবে সবাইকে হারিয়েছি। তোমাদের পেয়ে আমিও আমার জীবনকে খুঁজে পেয়েছি। একাকিত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছি। সব কিছু হারানো দুটি মানুষ আমরা। একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছি। তা হলে কেনও এই চলে যেতে চাওয়া? না- কিছুতেই হবে না এটা। আমি এ কটা দিনে বুঝে গেছ- তোমাদের ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না। ওই মিষ্টি ছোট্ট মেয়েটার মুখ থেকে আমি বাবা ডাক শুনতে চাই। তোমাকে নিজের করে পেতে চাই; আমায় বঞ্চিত কোরো না- দেবী"।
দেবীকা সুপ্রিয়র বুকের উপর মাথা রেখে শুধু কেঁদেই চলে, মুখে কোনো কথা বলে না। সুপ্রিয় তার মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলাতে থাকে।
কতটা সময় এভাবে দুজনের কেটে গেছে কেউই তা বুঝতে পারেনি। এদিকে সুরুতি অপেক্ষা করে করে আর না পেরে 'মা', 'মা' ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢোকে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই বলে ওঠে, "মা তুমি কাঁদছো কেন?" সুপ্রিয় তার কথার উত্তর দেয়, "মাকে খুব বকেছি। তাই তো মা কাঁদছে|" কথা বলতে বলতে সে সুরুতিকে কোলে তুলে নেয়। আর বলে,
--মা আর যেতে চাইবেনা বলেছে। এখন থেকে এখানেই থাকবে বলেছে। কিনতু মা এও বলেছে তারজন্য তোমাকে একটি কথা শুনতে হবে।
দেবীকা অবাক হয়ে সুপ্রিয়র মুখের দিকে তাকায়। সুপ্রিয় একটু হেসে আবার সুরুতিকে বলতে শুরু করে,
--মা যে কথাটা বলেছেন তুমি শুনবে তো ?
--হ্যাঁ, মা যা বলবে আমি তাই শুনবো। কিন্তু ডাক্তার আঙ্কেল আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবোনা।
--না না তুমি যদি মায়ের কথাটা শোনো তাহলে আমায় ছেড়ে তোমায় কোনদিনও কোথাও যেতে হবেনা। শুধু এই ডাক্তার আঙ্কেলটা বলা যাবেনা।
--তাহলে কি শুধু নাম ধরে ডাকবো?
সুরুতির কথায় ওরা দুজনেই হেসে ফেলে। সুপ্রিয় সুরুতির মুখে একটা চুম্বন করে বলে,
---না, নাম ধরে ডাকবেনা; আমাকে তুমি বাবা বলে ডাকবে।
দেবীকা কথাটা শুনে হেসে দেয়! সুরুতি তার মাকে বলে,
--আমারও না মা ডাক্তার আঙ্কেলকে বাবা বলে ডাকতে ইচ্ছা করে। ডাকবো মা ?
দেবীকা মাথা নেড়ে তার সম্মতি জানায়। সঙ্গে সঙ্গেই সুরুতি সুপ্রিয়র গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, 'বাবা'।
"আর একবার বলো?" সুরুতি মুখটা অন্য কানের কাছে নিতে নিতে বলে, "এবার এই কানটায় বলবো, "বা --বা"। সুপ্রিয় তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলে, "আর কোথাও তোমাদের যেতে হবেনা। এখন থেকে আমরা তিনজনেই একসাথে এই বাড়িতেই থাকবো।" দেবীকা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সুপ্রিয় তাকে বলে, "আজ মনে হচ্ছে নার্সিংহোম আর যাওয়া হবেনা।"
উত্তরে দেবীকা হেসে পরে আর হাসতে হাসতেই বলে, "সেটা আমি আগেই বুঝেছি।" সুপ্রিয় খুব জোরে হেসে উঠে। সুপ্রিয়র এত জোরে হাসি দেখে সুরুতি আবাক হয়ে যায়।
---তুমি এত জোড়ে হাসতে পারো বাবা?
--তুমি আর তোমার মা দুজনে মিলে এভাবে আমার হাসির রাস্তাটা তৈরী করে দিলে যে মা! আমি তো হাসতেই ভুলে গেছিলাম। কোনদিন যে এভাবে আবার হাসতে পারবো সেটা তো স্বপ্নেও ভাবিনি!
দেবীকা কিছুক্ষণ চুপচাপ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। চলে যাওয়ার সময় বলে যায়, ''ব্রেকফাস্টটা করে নিলে হতনা?''
--হ্যাঁ চলো।
মেয়েকে কোলে নিয়ে সুপ্রিয় ডাইনিংএর দিকে এগিয়ে যায়।
দু'দিন পর সুপ্রিয় এক ভদ্রলোককে নিয়ে বাড়িতে আসে। দেবীকার কাছে এসে বলে' ,
--দেবী, সব থেকে আগে যেটা দরকার সেটা হোল সুরুতিকে আগে একটা স্কুলে ভর্তি করা। ওকে আমি দত্তক নিতে চাই; তাই এক উকিলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আমি চাই ও আমার পরিচয়ে পরিচিতি পাক। তোমার কোন আপত্তি নেই তো ?
দেবীকা অবাক দৃষ্টিতে সুপ্রিয়র দিকে তাকিয়ে থাকে। সুপ্রিয় আবার তাকে বলে,
--কই উত্তর দিলেনা ?
--আপনি যদি এখনও আমাকে এইসব বলেন তাহলে আমি কিনতু খুব কষ্ট পাই! ও তো আপনাকে বাবা বলে ডাকে সুতরাং ও আপনারাই মেয়ে; তাহলে আমার কাছে জিগ্গেস করা কেন? যাতে ওর ভালো হবে আমার থেকে আপনিই তো ভালো বুঝবেন। আপনি ওঘরে যান আমি আসছি।
--আমার বুক থেকে একটা ভারী পাথর নামিয়ে দিলে তুমি। খুব টেনশানে ছিলাম যদি তুমি আপত্তি করো। কিনতু দেবী একটা ব্যাপারে কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছিনা।
দেবীকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুপ্রিয়র মুখের দিকে তাকালো। সুপ্রিয় হাসতে হাসতে বললো,
---মেয়ে তো বাবা বলছে কিনতু মেয়ের মা তো সেই আপনিতেই দাঁড়িয়ে আছে; কি করি বলো তো?
দেবীকা একগাল এসে পরে সুপ্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলে,
---মেয়ের মা সময় মতো ঠিক বলবে!
মেয়েকে দত্তক নেওয়া, নামী স্কুলে ভর্তি করানো-একে একে সবই হয়ে যায়।
সুপ্রিয় দেবীকার ইচ্ছানুযায়ী ম্যারেজ রেজিস্টারকে তার বাড়িতেই নিয়ে আসে। অনাড়ম্বর পরিবেশে সুপ্রিয়র এক মাসি ও মেসোকে স্বাক্ষী রেখে দেবীকা ও সুপ্রিয় দুজনে মিলে এক হয়ে যায়।
সেই রাতে ওই মাসি সুপ্রিয়কে ডেকে বলেন জে ওই রাতটা সুরুতি তাদের কাছেই থাকুক। কিনতু সুপ্রিয় এতে মত দেয়না। সে তাদের অবাক করে দিয়ে বলে, "ও যতদিন না বড় হচ্ছে ততদিন ও রাতে আমাদের কাছেই থাকবে। কতক্ষণ সময় আমি আর বাড়িতে থাকি! এই সময় টুকুর এক মুহুর্ত আমি আমার মেয়েকে কাছছাড়া করতে চাইনা।" কথাগুলি সবই দেবীকার কানে যায়। সে ভাবে গত জম্মের কোন পুন্যের ফলেই এ জীবনে সুপ্রিয়র মত মানুষের সাথে তার দেখা হয়েছে।ইতিমধ্যে সুপ্রিয় ঘরে ঢোকে। দেবীকা গলায় বস্ত্র নিয়ে ভক্তিভরে তাকে প্রনাম করে।
----এটা কি হোল? আমি তো আগেই তোমাকে নিষেধ করেছি!
দেবীকা উঠে দাঁড়ানোর আগেই সুপ্রিয় তার বাহুদুটি ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়।
---ভগবানকে তো চোখে দেখিনি আপনি আমার কাছে ভগবান স্বরূপ!
---এসব বলবেনা দেবী। আমি ভগবান নই; অতি সাধারণ একজন মানুষ! যার পৃথিবীতে তোমরা দুজন ছাড়া কেউ নেই। তাই তোমাদের পেয়ে আমি খড়কুটোর মত আগলে ধরেছিলাম। যাক ওসব কথা। একটা কথা আমায় বলতো- এখনও কি সেই সময় আসেনি যে তুমি আমায় 'তুমি'বলবে ?
দেবীকা সলজ্জ দৃষ্টিতে সুপ্রিয়র মুখের দিকে তাকিয়েই আবার মুখটা নীচু করে বলে, "হ্যাঁ এসেছে।" সুপ্রিয় দেবীকার একমাথা সিঁদুর, গা ভর্তি গয়না, লাল ঢাকাই জামদানী শাড়িতে দেবীকার অপূর্ব সাজের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দুহাত বাড়িয়ে নিজের বুকে টেনে নেয়। তারপর আলতো করে মুখটি তুলে ধরে বলে,"সত্যি বলছি দেবী, এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি, ভগবান যদি তোমাদের আমার কাছে পাঠিয়ে না দিতেন- জীবনের মানেটাকেই আর খুঁজে পেতামনা। তিন' মাসের ব্যবধানে মা, বাবা দুজনকেই হারিয়ে আমার আর বাঁচার ইচ্ছা ছিলোনা। ওই মাসি যদি চাকরী ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে চলে না আসতো আমি মনে হয় এতদিনে শেষ হয়ে যেতাম। মাসি আমায় খুব ভালোবাসে আর আমিও মাসিকে খুব শ্রদ্ধা করি। আমার ভাগ্যটা যে এতো ভালো হবে তোমাদের কাছে না পেলে আমি তা কোনদিনও অনুভব করতে পারতামনা। আজ আমি খুব খুশি, খুব সুখী।"
দেবীকা সুপ্রিয়র বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ভাবে, 'আমিই কি কোনদিন ভেবেছি আমার জীবনের ওই চরম দুর্যোগের পর স্বয়ং ভগবান এসে আমার হাতদুটি ধরবেন; আমার সমস্ত দুঃখ, কষ্ট ভুলিয়ে দিয়ে আমার মেয়েকে, আমাকে নিজের করে নিয়ে আমাদের কাছে টেনে নেবেন। আমার জীবন থাকতে আমি আর কোনদিন তোমায় কোন কষ্ট পেতে দেবোনা সুপ্রিয়। সারাটা জীবন আমরা মা, মেয়ে তোমায় ঘিরে থাকবো। আর তুমি থাকবে আমাদের জীবনে ঠিক বটগাছের ছায়ার মত।" দেবীকা আরও নিবিড়ভাবে সুপ্রিয়কে জড়িয়ে ধরে।