নাচ ঘর
নাচ ঘর
গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ের আজ বাৎসরিক অনুষ্ঠান। জমিদার দুর্গেশ ব্যানার্জীকে সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। দুর্গেশ বাবুর পূর্ব পুরুষদের জমিদার হিসেবে যতোই বদনাম থাকুক না কেন দুর্গেশ বাবু কিন্তু পূর্বপুরুদের স্বভাবের ছিঁটেফোটা ও পাননি। উনি সৎ, শিক্ষিত ,দয়াবান ,মানুষ হিসেবে অতুলনীয়। প্রজাদের পয়সায় আয়েস করেন না। নিজের ব্যবসায় অর্জিত পয়সা দিয়ে নিজের সংসার চালান এবং গ্রামের অনেক গরীব দুঃখীর ও সাহায্য করেন।
তার আমল থেকেই জমিদারের নাচঘরে তালা পড়েগেছে। কারাগার গৃহ এখন পশুপালন কক্ষ হয়ে গেছে।আর গুমঘর হয়ে গেছে এখন ভাঙাচোরা রাখার স্টোররুম।
স্কুলের স্টুডেন্টরা খুব সুষ্ঠভাবে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করলো।যার উপর এই অনুষ্ঠান পরিচালনার ভার দেওয়া হয়েছিল ক্লাস টুয়েলভের ছাত্রী মহামায়ার তৎপরতায় দুর্গেশবাবু মুগ্ধ হয়ে গেলেন।হেডমিষ্ট্রেসের কাছ থেকে জানলেন ও শুধু নামেই মহামায়া নয় শিক্ষায় সামাজিকতায় এবং রূপেও যেন সাক্ষাৎ দশভূজার অবতার।
দুর্গেশবাবুর ছেলে অগ্নেশও বাবার মতো শিক্ষিত সৎ মানুষ।দুর্গেশবাবু অনেকদিন ধরেই মহামায়ার মতো এমনি চৌকস একটি মেয়ে অগ্নেশের জন্য খুঁজছিলেন ।যে পরবর্তী কালে তাঁর বিষয়াদির দেখভালে অগ্নেশের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারবে।
ছেলে অগ্নেশকে নিয়ে দুর্গেশবাবু একদিন মহামায়াদের বাড়িতে গেলেন। অগ্নেশকে মহামায়ার সাথে আলাপ পরিচয় করিয়ে অগ্নেশের সম্মতিতেই একদম ওদের বিয়ের দিন পাকা করে এলেন।
মহাধুমধামে জমিদারের একমাত্র পুত্রের বিয়ে হলো। একমাস ধরে গ্রামের লোকেরা খেয়ে গেল আর ধন্য ধন্য করে জমিদার বাবুর সুখ্যাতি করে গেল।
মহামায়ার এই বিশাল বাড়ির প্রত্যকের ঘর চিনতেই তো প্রায় একমাস লেগে গেল ।
বাড়ির একদিকে একটি সুন্দর ভবনকে তালা বন্ধ দেখে মহামায়ার খুব কৌতুহল হল। ভবনটা সম্বন্ধে যাকেই ও কিছু জিজ্ঞাসা করতে যায় সেই ওকে এড়িয়ে চলে দেখে মহামায়ার বন্ধ ভবনের প্রতি কৌতুহল উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকলো। ও সুযোগ পেলেই ভবনটার আশেপাশে ঘুর ঘুর করে।
একদিন হঠাৎই মহামায়ার নজরে পড়ে ভবনের তালা খোলা ।ও এদিক ওদিক তাকিয়ে গুটিগুটি পায়ে ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়লো। ভেতরটায় বিশাল ঝাড়বাতি। তাছাড়া ও আরো কত সুন্দর সুন্দর বাতিদানি। মখমলের তাকিয়া দিয়ে সাজানো অনেক লোকের বসার জায়গা।
মহামায়া হতবিহ্বল হয়ে ঘরের সৌন্দর্য, কারুকার্য দেখছে। হঠাৎ করে ঘরের বাতি গুলো সব জ্বলে উঠলো । তবলা সানাইয়ের সুরে ঘরটা যেন সজীব হয়ে উঠলো।এক অতি সুন্দরী সেই সুরের মূর্ছনায় নেচে উঠলো। কী অপূর্ব নৃত্য শৈলী! দেখতে দেখতে মহামায়া বিভোর হয়ে গেল।
দর্শকদের মধ্যে থেকে একজন মহামায়ার দিকে আঙুল তুলে বললো ও কে জানকী বাঈ? ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো।
জানকীবাঈ ক্রুদ্ধকন্ঠে বলে উঠলো । ও আমার মেয়ে আছে। ওর দিকে নজর দিবেন না বাবু।যা চাই আমাকে বলুন আমি দেব।
বাবুটি হেসে বলল তুমি আর কতদিন? এবার আমাদের নতুন কিছু চাই ওকে নিয়ে এস।
জানকী বাঈ মহামায়াকে বললো তুই পালা বিটিয়া।
মহামায়া বললো কীভাবে পালাবো ?ওরা যে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
জানকী বাঈ পিছনের একটা দরজা দেখিয়ে বললো । জলদি ওই দরোয়াজা দিয়ে পালা আমি ওদের আটকাচ্ছি।
মহামায়া উর্ধশ্বাসে দরজা দিয়ে ছুটে পালাতে পালাতে শুনতে পেল জানকী বাঈ এর সাথে বাবুর বচসা চলছে।একটু পরে একটা গুলির শব্দ আর সঙ্গে সঙ্গে আ্য্যঁ-----করে জানকী বাঈএর গলার আওয়াজ পেল। তারপর সব চুপচাপ।
মহামায়াকে এমন ছুটে আসতে দেখে একজন কাজের মেয়ে জিজ্ঞাসা করলো কী হয়েছে বৌরানী? তুমি এমন হাঁপাচ্ছো কেন?
মহামায়া ভীতকন্ঠে বললো ওই ভবনে--------
মহিলা গম্ভীর হয়ে বললো তুমি আবার ওইদিকে গেছো ?বলেছি না ওদিকে যেতে নেই। বাড়ির লোকেরা জানতে পারলে তোমাকে কত বকবে জান?
সেদিনের পর মহামায়া আরো কয়েক বার ওই বন্ধ ভবনের বাইরে ঘুরপাক করেছিল। কখনো ভবনটি শান্ত থাকে , কখনো আবার ও ভবনের ভেতরে থেকে বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ শুনতে পায়
এরমধ্যে মহামায়া স্বপ্নেও জানকী বাঈকে দেখতে পেল । ওকে বলছে আমাকে মুক্তি দে বিটিয়া।
ঘেমে নেয়ে মহামায়ার ঘুম ভেংগে যায়।ও অগ্নেশকে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছিল জানকী বাঈ কে? ওর সাথে কী হয়েছিল ?ও কেন মহামায়ার কাছে মুক্তি চায়?
অগ্নেশের এই প্রশ্নগুলোর কোন উত্তরই জানা ছিল না।ও বরং অন্যসব গল্প শুনিয়ে মহামায়ার ধ্যান অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো।
রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মহামায়া ঘোরতর অসুখে পড়লো। কতো ডাক্তার বদ্যিকে দেখানো হলো মহামায়া আর সুস্থ হয়না।ও শুধু ঘুমের মধ্যে জানকী বাঈ জানকী বাঈ বলে কেঁদে ওঠে।
অগ্নেশের একবন্ধু মহামায়ার অসুস্থতার কথা শুনে বললো , আমাকে একটা চান্স দে , আমি হয়তো ভালো কিছু করলেও করতে পারি।
ছেলেটি পেশায় সাইক্রিয়াটিস্ট। কিন্তু ওর সেই পরিচয় গোপন রেখে অগ্নেশের বন্ধু হয়েই ওদের বাড়িতে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতেএলো।
ধীরে ধীরে ও বাড়ির সবার সাথে ভাব জমিয়ে ফেললো। বিশেষ করে মহামায়ার সাথে।
বিভিন্ন ধরনের গল্পের মধ্যে দিয়ে ছেলেটি বুঝতে পারলো ওই বন্ধভবনের সাথে মহামায়ার অসুস্থতার কোন যোগসূত্র আছে।
ও অগ্নেশকে ওই ভবন খুলে দেখানোর অনুরোধ করলো।
অগ্নেশ অসম্ভব বলে বন্ধুকে থামিয়ে দিল।ও ঘরে কারো ঢোকার অনুমতি নেই সে কথাও বেশ কড়াভাবে জানিয়ে দিল।
ডাক্তার বললো মহামায়ার সুস্থতা নির্ভর করছে ওই ঘরের উপর। মহামায়া ওই ঘরে এমন কিছু দেখেছে বা কল্পনা করছে যার জন্য ও খুব ভয় পাচ্ছে বা অনুতপ্ত হচ্ছে। আমাদের একবার ওই বন্ধভবনে যেতে হবে দরকার হলে মহামায়াকেও ওখানে নিয়ে যেতে হবে।যতক্ষন না ওর ভয় বা ভুল ভাঙানো যাচ্ছে ততক্ষন ও সুস্থ তো হবেই না হয়তো খারাপ কিছুও করে ফেলতে পারে।
অগ্নেশকে কোন ভাবেই রাজি করাতে না পেরে ডাক্তার নিজের আসল পরিচয় দুর্গেশবাবুকে জানিয়ে মহামায়ার সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য ওই বন্ধভবনে যাওয়া কতোটা জরুরী বুঝিয়ে বললো। কিন্তু এখানেও কোন কাজ হলো না।বিফল মনোরথে ডাক্তার চিকিৎসার অন্য কোন উপায় আছে কিনা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলো।
সেদিন মাঝরাতে মহামায়া বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। ছিটকিনির আওয়াজে অগ্নেশের ঘুম ভেঙে গেল। মহামায়াকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যেতে দেখে অগ্নেশ ওকে আটকাতে চেষ্টা করলে মহামায়া অগ্নেশের হাত ছাড়ানোর জন্য পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগলো। কাঁদতে লাগলো ।অগ্নেশের কাছে কাকুতি মিনতি করতে লাগলো ওকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ।
এতো আওয়াজে বাড়ির সবার ঘুম ভেঙে গেল। শ্বশুর মশাই বৌমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ,তুমি কোথায় যেতে চাও মা?
ও বললো,ওই ভবনে।
উনি বললেন এতরাতে অন্ধকারে ওই ভবনে গিয়ে তুমি কী করবে?
ও বললো,না না অন্ধকার না । ওখানে অনেক আলোর রোশনাই আছে। জানকী বাঈ ওখানে আছে বাবা।ও আমাকে ডাকছে। আমাকে মুক্তি দিতে বলছে ।ও আমাকে সেদিন বাঁচিয়েছিল।আজ ও আমার সাহায্য চাইছে। সাহায্য করবোনা বাবা?
দুর্গেশবাবু বললেন , তুমি একা কেন আমরা সবাই মিলে ওকে সাহায্য করবো। এখন তো অনেক রাত কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা কর।
মহামায়া আতঙ্কিত হয়ে বললো ,কাল সকাল না ।অনেক দেরি হয়ে যাবে। ওর গুলি লেগেছে ও মরে যাবে , বলে ও হাউহাউ করে কেঁদে দিল।
কোনরকমে মহামায়াকে শান্ত করতে না পেরে অবশেষে ডাক্তার ওকে একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর মহামায়ার আবার উন্মাদনা শুরু হলে দুর্গেশবাবু ডাক্তারকে বন্ধ ভবনে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
ডাক্তার নিজে প্রথমে সরেজমিনে তদন্ত করে কিছু না পেয়ে বাড়ির আরো কিছু লোকের সাথে মহামায়াকে সেই ভবন অর্থাৎ জমিদারের পূর্ব পুরুষদের নাচঘরে নিয়ে এলো।
মহামায়া ঘরে ঢুকেই সেই জায়গায় ছুটে গেল যেখানে স্বপ্নে জানকী বাঈকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে থাকতে দেখেছিল।
কিছুক্ষন সেখানে বসে থাকার পর মহামায়া দেওয়ালে দেওয়ালে কান ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
অগ্নেশ জিজ্ঞাসা করলো কী করছো?
ও ইশারায় অগ্নেশকে চুপ করিয়ে বললো নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছো না? জানকী বাঈএর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
শ্বশুর মশাই ডাক্তার কে বললেন কী বুঝছো ? মাথাটা কী একদম খারাপ হয়ে গেছে?
ডাক্তার বললো এখনো বলতে পারছি না।আরেকটু দেখি।
এ দেওয়ালে ও দেওয়ালে কান ঠেকাতে ঠেকাতে মহামায়া হঠাৎ চিৎকার করে বললো, পেয়েছি।জানকীবাঈ এখানে আছে। তারপর সামনে পড়ে থাকা একটা রড দিয়ে দেওয়ালে সজোরে আঘাত করতে করতে বললো, জানকী বাঈ আর একটু অপেক্ষা করো আমি তোমাকে মুক্তি দেব।
মহামায়ার পাগলামি দেখে অবশেষে দুর্গেশবাবু দেওয়াল ভাঙার জন্য লোক ডাকতে পাঠালেন।
গাঁইতির ঘায়ে মজবুত দেওয়ালের থেকে একটু একটু করে পলেস্তার খসে পড়তে লাগলো।আর সেই পলেস্তারের সঙ্গে একসময়ে বেড়িয়ে এলো একটি নরকঙ্কাল। মহামায়া ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ সেই নরকঙ্কাল নিয়ে চলে যায়।পরে অবশ্য পুলিশ রিপোর্ট দেয় ,এটি প্রায় একশো বছরের পুরনো নারী দেহের কঙ্কাল । ওকে পিঠে গুলি করে মারা হয়েছিল।
আশ্চর্য ব্যাপার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মহামায়া একদম স্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো।
সেদিনের পর থেকে ও কখনো ওই বন্ধ ভবন বা জানকীবাঈ এর কথা বলেনি। বাড়ির কেউ এই নিয়ে ওকে কখনো একটা কথা ও বলেনি।
সবভুলে আজ অগ্নেশ মহামায়া বড় সুখে সংসার করছে। জানকী বাঈ এর আত্মা মুক্তি পেয়ে হয়তো ওদের চীর সুখী হওয়ার আশীর্বাদ দিয়ে গেছে।
সমাপ্ত
