STORYMIRROR

Anjali Chakraborty

Abstract Horror

4  

Anjali Chakraborty

Abstract Horror

হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা

হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা

7 mins
352

অবশেষে অনেক চিন্তা ভাবনা করে শায়ক এবং অমৃতা বাড়িটা কিনেই ফেললো। এতো সস্তায় বলতে গেলে জলের দামে শহরের এতো কাছে এমন একটা বাড়ি বিক্রি হচ্ছে বলে প্রথমে ওদের মনে একটু খটকা ছিল।তাই ওরা বাড়ির সমস্ত কাগজ পত্র নিয়ে উকিলকে দেখিয়ে ছিল যদি কোন ডিসপ্যুট থাকে।

উকিল বাবু পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন কোথাও কোন গন্ডগোল নেই।

অ্যাকচুয়ালী বাড়ির মালিক প্রায় আশি বছর বয়স্ক বৃদ্ধ। ওনার স্ত্রী ও মনেহয় সত্তরের কম হবেন না। ওনাদের একমাত্র ছেলে অ্যামেরিকানকে বিয়ে করে ওখানকার গ্রীনকার্ড হোল্ডার হয়েগেছে। এদেশে ফিরে আসার ওদের কোন ইচ্ছেই নেই। ভদ্রলোক বৃদ্ধ মা বাবাকে অনেক দিন ধরে ওদেশে নিয়ে যেতে চাইছেন কিন্তু ওনার মা-বাবা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে এতোদিন কিছুতেই বিদেশে যেতে রাজি হচ্ছিলেন না।

এখন বয়স হওয়াতে প্রায়ই ওনাদের কোন না কোন শারীরিক অসুবিধা হয়েই যাচ্ছে।অতো দূর থেকে ছেলের পক্ষেও মা বাবাকে ছুটে ছুটে দেখতে আসা সম্ভব হচ্ছে না তাই এবার শুধু ছেলে না তার বিদেশিনী স্ত্রীও ওঁদেরকে ওদেশে নিয়ে যাওয়ার স্থির সংকল্প করে ফেলেছে।

এতো বড়ো বাড়ি ফেলে রেখে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিদেশে পাড়ি দিলে বাড়িটা বারোভূতে লুটে খাবে।তাই ওঁরা বাড়িটিকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন।

প্রথমে এই ডুপ্লেক্স বাংলোর দাম ওরা অনেক হেঁকে ছিলেন।

অনেকে দেখে অনেক রকম দরদস্তুরও করে গেছিল।

কিন্তু শায়ক , অমৃতাকে যে ওরা কি চোখে দেখলেন!!! অমৃতা যখন আব্দার করে বললো ও দিম্মা তোমার এই বাড়িটা আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে , কিন্তু আমাদের কাছে যে অতো পয়সা নেই।

বুড়িমানুষ এমন মিষ্টি মেয়ের কাছ থেকে সামান্য স্নেহের পরশ পেয়ে যেন একদম গলে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন কতো আছে?

অমৃতা একহাত জিভ বের করে বললো ,এ বাবা সে আর তুমি শুনতে চেয়ো না ।এবাড়ির দামের থেকে অনেক কম।

উনি বললেন ,আহা লজ্জার কি আছে ,? তোমরা কী দিতে পারবে তা একবার বলেই দেখোনা। আমার ছেলেকে বলে দেখবো। যদি ওর পোষায় দেবে ,না হলে অন্য পার্টি দেখবে।

শায়ক অমৃতাকে ওদের দাম বলতে মানা করছিল।দিম্মাই ওদেরকে জোরাজুরি করে ওদের দামটা জেনে নিয়েছিলেন।

প্রায় একমাস পর দিম্মার ছেলে আমেরিকা থেকে কথা বলে মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওদের সাথে ডিলটা ফাইনাল করে ফেললো।

অনেক দিনের পুরনো বাড়ি। বুড়োবুড়ি থাকতেন বলে সেভাবে মেইনটেইন ও করা হয়নি।

ওরা বাড়িটা কিনেই ওদের পরিচিত একবন্ধুকে বাড়িটার রিনোভেশনের দায়িত্ব দিয়ে দিল।

অমৃতার খুব সখ এতো বড় হলঘরটাতে খুব সুন্দর একটা ঝাড়লন্ঠন লাগাবে ,যেমন আগেকার দিনের রাজা জমিদারদের ঘড়ে থাকতো।

ওদের বন্ধু ওদেরকে পরামর্শ দিল ওর পরিচিত একটি অ্যান্টিক শপ আছে। অমৃতা যেরকম ঝাড়লন্ঠনের কথা বলছে সেখানে গেলে ঠিক পাওয়া যাবেই।

অ্যান্টিক শপ শুনে শায়ক না না করে উঠলো।কারণ ও জানে অ্যান্টিক পিসের মূল্য সাধারণের থেকে অনেক বেশি হয়।

অমৃতার জোরাজুরিতে ওরা বন্ধু র সাথে সেই শপে গেল

অনেক রকম ঝাড়লন্ঠন দোকানদার ওদেরকে দেখালো । কিন্তু কোনটাই অমৃতার ঠিক মনের মতো হচ্ছে না।ওনিজে দোকানের এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে একেবারে দোকানের গুদামঘড়ে চলে গেল।

একগাদা আবর্জনার মধ্যে থেকে অমৃতা খুঁজে পেল ওর মনের মতো সেই ঝাড়লন্ঠনটাকে।

ইউরেকা ইউরেকা বলে আনন্দে নাচতে নাচতে ও দোকানদারকে ওই ঝাড়লন্ঠনটার কি দাম জিজ্ঞেস করল।

দোকানদার একটু আমতা আমতা করে বললো , ওটাই আপনার পছন্দ হলো!!!

শায়ক সন্দিগ্ধ হয়ে বললো ,কেন ওটায় কী আছে?

দোকানদার নিযেকে সংযত করে বললো না তেমন কিছু না।ওটা আবর্জনায় অনেক দিন ধরে পড়ে আছে তো তাই বললাম।

ছোট বাচ্চার মতো উৎফুল্ল হয়ে অমৃতা বললো ওটার কী দাম কাকু বললেন না তো?

দোকানদার বললো আগে ওটাকে পরিস্কার করে দেখে নেই ওটার কন্ডিশন কেমন তারপর দাম বলছি।

ওরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ঝাড়লন্ঠন সুসজ্জিত হয়ে ওদের কাছে এলো।

দোকানদার ওদেরকে জ্বালিয়ে দেখালো।

ঝাড়লন্ঠনের ছটায় অমৃতার গলা থেকে গান বেরিয়ে এলো --হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা রাতটা কে যে দিন করেছে---

শায়ক বিরক্ত হয়ে অমৃতাকে থামিয়ে দিয়ে বললো থাক এর পরের টুকু আর গাইতে হবে না।

ঝাড়লন্ঠনের দাম জিজ্ঞেস করলে দোকানদার নিস্পৃহ হয়ে বললো যা হয় কিছু একটা দিয়ে দেবেন ।

শায়ক অবাক হয়ে বললো জিনিস আপনার আর দাম ঠিক করবো আমরা!তাও আবার যা ইচ্ছে হয় তাই!এটা কেমন ব্যাপার হলো।

দোকানদার বললো আসলে আমার দোকানের ভিতরে সাজানো জিনিস গুলো পরখ করে তার দাম ধার্য্য করি। কিন্তু ওটা আনার পর থেকে ওখানেই পরে আছে ম্যাডাম নিজে খুঁজে বের না করলে ওটার কথা আমার মনেও আসতো না।তাই ওটার কি দাম নেব বুঝতে পারছি না।

একটুক্ষণ চুপ করে দোকানদার বললো ওটার দাম তো ম্যাডামই গান গেয়ে বলে দিলেন।

অমৃতা বিস্মিত হয়ে বললো , হাজার টাকা!!

দোকানদার হেসে বললো , আচ্ছা তাই ই দিন।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে অমৃতা শায়ককে বললো আমাদের লাকটা কিন্তু এখন খুব ভালো যাচ্ছে। এমন জলের দরে বাড়ি । এমন রাজসিক ঝাড়লন্ঠন,তাও এমন জলের দরে!! তুমি না এখন একটা লটারির টিকিট কেটে নাও দেখো সেটাও ঠিক লেগে যাবে।

আজ অমৃতারা ওই স্যাঁতসেতে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজেদের দোতলা বাংলোতে এসে উঠেছে। ওদের বন্ধু এতো সুন্দর করে বাড়িটা সাজিয়েছে!! তার মধ্যে হলঘরের মধ্যখানে ঝাড়লন্ঠনটা যেন চারচাঁদ হয়ে আলো ছড়াচ্ছে। অমৃতা কতোক্ষনে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনকে ওর ঘর দেখাবে তার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো।

সামনের রবিবার ওরা একটা পুজো আর গেট টুগেদারের ব্যবস্থা করলো।

রাতেরবেলা শায়ক আগেই শুতে চলে গেছে। অমৃতা কিচেনের কাজ শেষ করে বড় লাইটগুলো অফ করে নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে শুতে এলো।

মাঝরাতে জল খাবে বলে অমৃত উঠে দেখে ঘরে জল আনতেই ভুলে গেছে। কিচেনে জল আনতে যাবে বলে দরজা খুলে অমৃতা দেখে হলঘরের ঝাড়লন্ঠনটা জ্বলছে। অমৃতার স্পষ্ট মনে আছে ও লাইটটা বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে কে জ্বালালো? পরক্ষনেই ওর মনে হলো হয়তো শায়ক উঠে জ্বালিয়ে রেখে গেছে।ও জল নিয়ে আবার লাইটটা বন্ধ করে দিয়ে শুতে গেল।

সকালবেলা চা খেতে খেতে অমৃতা শায়ককে বললো সারারাত এতোবড় ঝাড়লন্ঠন জ্বালিয়ে রাখার দরকার কি? নাইট ল্যাম্প জ্বালালেই হয়না?

শায়ক বললো , ভালো কথা মনে করেছো। আমিও তো তাইই তোমাকে বলবো ভাবছিলাম।

অবাক হয়ে অমৃতা বললো মানে! আমি রাতে তো অফ করে শুয়েছিলাম। তুমি আবার জ্বালাও নি?

শায়ক বললো আমিই তো অফ করে দিয়েছিলাম।

অমৃতা জিজ্ঞাসা করলো তুমি কখন অফ করেছো?

শায়ক বললো এই তো তিনটে নাগাদ।

অমৃতা বললো কি বলছো? আমি তো একটা নাগাদ উঠে দেখছি লাইটটা জ্বলছে। ভাবলাম তুমি জ্বালিয়েছো। কিন্তু আমি তো তখনও অফ করে দিয়েছিলাম।

শায়ক বললো পুরনো জিনিস। কোথাও বোধহয় সর্টসার্কিট হয়ে গেছে।দেখি বাজারে যাওয়ার সময় একটা ইলেকট্রিশিয়ান ধরে নিয়ে আসবো।

ইলেকট্রিশিয়ান নানা ভাবে চেক করে ও ঝাড়লন্ঠনের কোন ফল্ট পেলোনা। উপরন্তু লন্ঠনের গায়ে লেখা বাবু কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত।সন ১৮৯০ । লেখাটা পড়ে শোনালো। বললো বৌদি এটা ইংরেজ আমলে কোন জমিদারের ঝাড়লন্ঠন ছিল মনে হচ্ছে। দারুণ মূল্যবান অ্যান্টিক পিস পেয়েছেন গো।

এরপর প্রতি রাতে ঝাড়লন্ঠন তার নতুন নতুন খেল দেখানো শুরু করলো।

কখনো তারার মতো জ্বলে নেভে। কখনো হলঘর থেকে সারেঙ্গীর আওয়াজ তবলার আওয়াজ আসে। কখনো ঘুঙুরের শব্দ। কখনো কাঁচের গ্লাসের ঠুঙঠাঙ শব্দ, কখনো বা লাস্যময়ী নারীর হাসির শব্দ। আবার কখনো মনে হচ্ছে কেউ যেন গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে যাচ্ছে।

রাতটা যেন শায়ক অমৃতার কাছে বিভিষীকাময় হয়ে উঠলো শায়ক ওর বন্ধুকে ডেকে বললো চল এই ঝাড়লন্ঠন খুলে দোকানে ফেরৎ দিয়ে আসি।

ওর বন্ধু বললো বাড়িটাও তো পুরনো আমলের তাই দোষ বাড়ির না ঝাড়লন্ঠনের বুজবো কী করে? তার থেকে বরং আমার চেনা জানা এক সাধুবাবা আছে। তাকে একবার দেখিয়ে নিশ্চিত করেই নেই। তারপর বরং ঝাড়লন্ঠন ফেরতের কথা ভাবা যাবে।

সাধুবাবা সমস্ত বাড়ি তার কমন্ডলী থেকে জল ছড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে নানা রকম মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলো।

বহুক্ষণ ধরে বহু কসরৎ করে উনি অমৃতাদের বললেন আমি নিশ্চিত এই বাড়িতে কোন দোষ নেই।

ওরা ঝাড়লন্ঠনের কথা বললে উনি বললেন এটা কে পরীক্ষা করার জন্য আমাকে রাত বারোটার পর একটা যজ্ঞ করতে হবে।

শায়ক অবশ্য এতোসব ঝঞ্ঝাট না করে ঝাড়লন্ঠনটাই ফেরৎ দিতে চেয়েছিল।

কিন্তু বাবাজী বললো এখানে যদি অশুভ ছায়া পড়ে থাকে সে কিন্তু এতো সহজে এ বাড়ি ছেড়ে যাবে না।

অগত্যা রাত বারোটায় অমৃতাদের হল ঘরের ঈশান কোণে সেই যজ্ঞ শুরু হলো। সেই প্রেতাত্মা অবশ্য সব রকম চেষ্টা করেছিল যজ্ঞ না হতে দেওয়ার। কখনো হোমের কাঠই জ্বলতে চায়না। কখনো ঝাড়লন্ঠনটার এতো বেশি উজ্জ্বল আলো বেরোচ্ছে যে চোখ মেলে তাকানো পর্যন্ত যাচ্ছেনা।

যজ্ঞ যতো সমাপ্তির দিকে যাচ্ছে তত যেন ঘরটাতে উদ্ভট উদ্ভট কান্ড ঘটতে শুরু করে দিলো।

হঠাৎ করে ঘুঙুরের আওয়াজে কান ফেটে যেতে লাগলো। কখনো সে কী করুন সুরে হৃদয়বিদারক কান্না ব্যথায় যেন ওদের বুকটা খান খান করে দিচ্ছে।

সব শেষে সাধুবাবা যখন তার মন্ত্রপূত জল দিয়ে যজ্ঞের আগুন নিভিয়ে দিল , প্রচন্ড শব্দ করে ঝাড়লন্ঠনটা ভেঙে চুরচুর হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

ওরা সবাই মিলে দেখলো সেই ভাঙা ঝাড়লন্ঠনের টুকরো গুলোর মধ্যে থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করলো । সেই ধোঁয়াগুলো একত্রিত হয়ে গোলগোল করে কুন্ডলী পাকিয়ে একটি নারীর অবয়ব ধারণ করলো। সেই নারী ছায়ামূর্তি সাধুবাবাকে এবং অমৃতাদের হাতজোড় করে প্রনাম করে দমকা হাওয়ার মতো বাইরে বেরিয়ে আকাশের সাথে মিশে গেল।

সাধুবাবা পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করে ওর আত্মার শান্তি কামনা করে অমৃতাদের আশ্বস্ত করে বললেন এবার তোমরা নিশ্চিন্তে এবাড়িতে থাকতে পারবে । অতৃপ্ত আত্মার মুক্তি হয়ে গেছে।

রবিবার দিন মহাধুমধামে অমৃতাদের বাড়ির পূজো এবং গেট টুগেদার অনুষ্ঠান হলো। সবাই ওদের বাড়ির ভীষণ প্রশংসা করলো । কিন্তু সবায়েরই এক অভিযোগ এমন সুন্দর হলঘরে একটা ঝাড়লন্ঠন না হলে মানায়?

অমৃতা হাতজোড় করে বলে রক্ষে করো বাবা আরো গোটা দশেক লাইট লাগিয়ে হলঘরটাকে আরো আলোকিত করে দিতে পারি কিন্তু ঝাড়লন্ঠন! নৈব নৈব চ।


সমাপ্ত



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract