আতঙ্ক
আতঙ্ক
মোহিত সোম। একজন অত্যন্ত সিধাসাধা নিপাট ভালো মানুষ । সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এখন একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
ওনার একছেলে ও একমেয়ে । তাদের বিয়ে থা দিয়ে মোহিত বাবু এখন নির্ঝঞ্ঝাট। একটি গাড়ি কিনে ছুটিছাটার দিনে গিন্নীকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে বেড়িয়ে পড়েন। দু'জনে বেশ ভালোই আছেন।
একদিন মাঝরাতে হঠাৎ বিল্ডিং এর একজন অসুস্থ হয়ে পড়লে, পরোপকারী মোহিত বাবু নিজে গাড়ী নিয়ে বেড়িয়ে ডাক্তার নিয়ে আসেন।অ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষা না করে নিজের গাড়িতে চড়িয়ে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সারারাত সেখানে প'ড়ে থাকেন। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় গিন্নীকে গাড়ীর চাবি দিয়ে বলে গেলেন, চাবিটা রেখে দাও যদি ওদের কোন দরকারে লাগে।
সপ্তাখানেক হাসপাতালে থেকে রোগীকে বাড়ীতে আনা হলো।এই সাতদিনে মোহিত বাবুর গাড়ী রোগীর বাড়ীর লোকেদের এমন গাড়ীর আদত করে দিল এখন তারা মোহিত বাবুর গাড়ী ছাড়া আর একপাও চলতে পারেন না। মুখচোরা মোহিত বাবু মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও মুখফুটে কিছুতেই আর না বলতে পারেন না ।
পুত্র স্নেহে যত্নকরা মোহিত বাবুর গাড়ীতে এখন প্রায়ই কোন না কোন স্ক্র্যাচ বা অন্য কোন ডিসপিউট দেখা যায়। ওদের জিজ্ঞাসা করলে বলে ওটাতো আমরা ব্যবহারের আগের থেকেই দেখেছি।
গিন্নী মাঝেমাঝে প্রতিবেশীর নির্লজ্জতায় অত্যিষ্ঠ হয়ে দু'একটা কড়া কথা শুনিয়ে দিলে, প্রতিবেশী তার সাথে ঝগড়া তো করেই, আবার মোহিত বাবু অফিস থেকে এলেই তার কাছে গিন্নীর নামে ইনিয়ে বিনিয়ে পাঁচ কথা শুনিয়ে মোহিত বাবুর কান ভেঙে দেয়।ফল স্বরূপ সংসারে অশান্তি।
এই গাড়ী যেন মোহিত বাবুর সুখের সংসারে রাহু হয়ে দাঁড়ালো। উনি প্রায়ই রাগ করে বলেন গাড়ীটাকে এবার বিক্রিই করে দেবো।
সেদিন রাতে , মোহিত বাবুরা ঘুমিয়ে পড়েছেন হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠলো।
প্রথমে উনি বেলকে ইগনোর করলেও , কয়েক বার বেলটি বেজে উঠলে উনি মেইন দরজা খুলে দেখেন সেফ্টি ডোরের ওপারে এক অপরিচিত ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে।
কী ব্যাপার জিজ্ঞাসা করলে লোকটি অমায়িক হেসে বললো আমাকে চিনতে পারছেন না? আমরা তো একই অফিসে কাজ করতাম । ডিপার্টমেন্ট অবশ্য আলাদা ছিল। লোকটি মোহিত বাবুর ডিপার্টমেন্টের অনেকের কথা বললো যাদের সাথে একাকালে মোহিত বাবুর অনেক দহরম মহরম ছিল।
এতো রাতে অফিস ক্লান্ত মোহিত বাবুর এই অচেনা লোকের সাথে এতো কথা বলতে ভালো লাগছিল না।একটু বিরক্তির হয়ে বললেন , এখন অনেক রাত হয়েছে আপনি বরং ছুটির দিন সকালে আসুন।
লোকটা হন্তদন্ত হয়ে বললো না না আমি আপনাকে আর বিরক্ত করবোনা । আপনি আপাতত আমার এই সুটকেসটা আপনার কাছে রাখুন ।কাল সকালে কিন্তু আমাকে আপনার আরেকটি উপকারও করে দিতে হবে।
মোহিত বাবু জিজ্ঞাসা করলেন কী উপকার?
ও বললো সামনের গ্রামের পার্টি অফিসে সুটকেসটা পৌঁছে দিতে হবে তাই কয়েক ঘণ্টার জন্য আপনার গাড়ীটা চাই।
মোহিত বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন আপনাকে চিনিনা জানিনা গাড়ী দিতে যাবো কোন দুংখে?আর এই সুটকেসেই বা কী আছে?
লোকটা সুটকেস খুলে দেখালে , মোহিত বাবুর চক্ষুতো একেবারে চড়কগাছে।
সুটকেসে ভর্তি থড়েথড়ে সাজানো ২০০০টাকার বান্ডিল।
মোহিত বাবু জানে পরশু ওগ্রামে ইলেকশন।
উনি কোন কথা না বলে ধরাম করে দরজা বন্ধ করে , দরজার সামনে বসে হাঁফাতে লাগলেন।
দরজার ওপাশে লোকটা তখনো হিসহিস করে বলে যাচ্ছে, পার্টির কথা অমান্য করে কাজটি কিন্তু ভালো করলেন না। লোকটা সাবধান করে বললো একদম নীরব হয়ে থাকবেন , আজকের কথা যদি ঘুনাক্ষরেও কেউ টের পায় , আপনাকে নির্বংশ করে দেব। ছেলে, মেয়ে,বৌ,জামাই, নাতি, নাতনী আপনার মৃত্যু কালে জল দেওয়ার জন্য কেউ কিন্তু থাকবে না।
ভোরবেলা মোহিত বাবু কারসেলে গাড়ীবিক্রির আবেদন করে দিলেন।
গিন্নী শুনেই হাউমাউ করতে লাগলো। ওনার কোন বাঁধা কর্তা শুনছেন না দেখে ছেলে মেয়েকে খবর দিলেন।
ওরা এসে বাবার কাছে কতরকম করে গাড়ী বিক্রির কারণ জিজ্ঞাসা করলো।
মোহিত বাবু মুখে কুলুপ এঁটে রাখলেন। শুধু তাই না পরিবারের সবাই দেখলো মোহিত বাবু ক্রমশঃ কেমন জানো নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছেন । সবসময় মনে হয় যেন উনি কোন আতঙ্কের মধ্যে আছেন। ওরা কারণ জিজ্ঞাসা করলে কোন উত্তর দেন না।
উত্তর দেবেন কী ! ওনার তো সবসময় মনে হয় কেউ যেন ওঁর কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে একদম নিঃশব্দ থাকবেন নতুবা নির্বংশ হয়ে যাবেন।
ধীরে ধীরে মোহিত বাবু বাইরে যাওয়াই ছেড়ে দিলেন।অতো ভালো মাহিনার চাকরিটাও আর করলেন না।
একসময় দেশের ইলেকশন শেষ হয়ে গেল। সরকার গঠন হয়ে গেল। সাময়িক সময়ের জন্য অরাজকতা বন্ধ হয়ে দেশের জনসাধারণ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো।
কিন্তু মোহিত বাবু আর স্বাভাবিক হলেন না। বরং একেবারে নিঃশব্দ হয়ে গেলেন। বাড়ির লোকেরা অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে সবারই এক মত , উনি কোন কারণে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন।যতক্ষন ভয়ের কারণ জানা না যাচ্ছে কোনরকম ট্রিটমেন্ট অসম্ভব।
কতো ভোট আসবে কতো ভোট যাবে কতো নতুন নতুন স্বপ্ন নিয়ে মানুষ সরকার গঠন করতে ভোট দেবে ,যারা ভোটের অরাজকতার কারণে চীর কালের জন্য নিঃশব্দ হয়ে গেল তাদের মনের ভেতরে বন্দি হয়ে থাকা শব্দগুলোর অনুসন্ধান করতে কোন দিন কোনো জনপ্রতিনিধি আসবে না।
সমাপ্ত
