STORYMIRROR

Sayandipa সায়নদীপা

Drama

5.0  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama

ম্যাজিকের মোহে

ম্যাজিকের মোহে

11 mins
1.9K


লকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া আরে ঘোড়ে কে দুম পে যো মারা হাথোড়া

আরে দৌড়া দৌড়া দৌড়া ঘোড়া দুমম… খ… খটকাই…!


ফুরফুরে মেজাজে জোরে জোরে গান করতে করতে মাঠের দিকে দৌড়াচ্ছিল নোনতা। মনে তার আজ বড় পুলক, বিকেলের জন্য জম্পেশ একখানা প্ল্যান হয়ে গেছে। কিন্তু মাঠে যাওয়ার পথে বকুদের বেড়ার ওপর খটকাইকে অমন করে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হল নোনতা। খটকাই তো এদিকটায় বড় একটা আসে না, তার ওপর ওর মুখটাও কেমন যেন ব্যাজার লাগছে না, এমন ভান করছে যেন নোনতাকে দেখতেই পায়নি! “এই খটকাই তোর ব্যাপার কি রে? এখানে বসে কি করছিস?”

“তুই এখন যা, আমার মন ভালো নেই। আমায় একলা থাকতে দে।”

“বাব্বা কি এমন হল রে যে তুই আমাকেও বলবি না! আমি না তোর প্রিয় বন্ধু।”

“হুঁ।”

“তাহলে?”


“দুঃখের কথা কি আর বলি বল… তাও এতো জোর করছিস যখন তখন বলেই ফেলি। কালকে আমার এক মামা এসেছিলেন বাড়িতে। সেই উপলক্ষ্যে বাবা অন্নেক বোয়াল মাছ এনেছিল। জানিসই তো আমি বোয়াল মাছ খেতে কত ভালোবাসি, কিন্তু মা না আমাকে আর পটকাইকে মাত্র একটা করে মাছ দিয়ে সব মাছ মামাকে আদর করে খাইয়ে দিলো। মা আমাকে একটুও ভালোবাসে না।” 

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো খটকাই, আর ওর কথা শুনে হেসে ফেললো নোনতা, “ওহ এই ব্যাপার! তুই মিছেই রাগ করছিস খটকাই, বাড়িতে অতিথি এলে তাকে আপ্যায়ন তো করতেই হবে। এতে মন খারাপ করতে নেই।”

“যা যা এই জন্য আমি বলতে চাইনি তোকে। আমার দুঃখু কেউ বোঝে না।”

“আরে বাবা রাগ করিসনা। শোন না, আজ যাবি আমার সঙ্গে একটা জায়গায়?”

“কোথায়?”

“ইস্কুলে।”

“এ বাবা না না, আমি ওসব পড়াশুনা করতে পারবো না।”

“ধুর বোকা পড়তে নয় রে, ম্যাজিক দেখতে।”

“ম্যাজিক!”

“হুমম ম্যাজিক। জানিস তো আমাদের ইস্কুলে কলকাতা থেকে ম্যাজিকের একটা বড় দল এসেছে। কাল ইস্কুলের মাঠে খুব বড় করে শো দেখাবে তারা। তা আমার সাথে ওদের ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে বলে ওরা আজ বিকেলে আমাকে ওদের প্র্যাকটিস দেখতে ডেকেছে।”

“অ। তা ম্যাজিকে কি দেখাবে রে?”

“অন্নেক কিছু…ফাঁকা টুপির ভেতর থেকে পায়রা বের করে দেখাবে, মানুষের কান থেকে ডিম বের করবে।”

“কান থেকে ডিম! বলিস কি!”

“হুহু এই তো মজা ম্যাজিকের।”

“তাহলে কান থেকে বোয়াল মাছ বের করতে পারবে?”

“তা তো জানিনা ঠিক।

 উমম... পারতেও পারে।”

“সত্যিই? তাহলে তো আমি যাবোই তোর সঙ্গে। বল্টু আর ফটকে আসবে তো?”

“অবশ্যই।”


     হন্তদন্ত হয়ে নোনতারা যখন বিকেলে ইস্কুলের মাঠে পৌঁছালো তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে গেছে, আর কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা নামবে ঝুপ করে। আসলে বল্টুকে ওর বাবা সেই দুপুর থেকে অঙ্ক কষাতে বসেছিলেন তাই ওদের এতো দেরি হয়ে গেল। কে জানে ম্যাজিশিয়ানদের প্র্যাকটিস করা শেষ হয়ে গেল নাকি! মনে মনে একটা আশঙ্কা নিয়ে স্কুলের পেছন দিকের ঘরটায় চলে গেল নোনতারা। স্কুলের এই হল ঘরটা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় ব্যবহার করা হয়। তাই এখন এই ম্যাজিশিয়ান দলের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এখানে। ঘরটার দরজাটা ভেজানো ছিলো, সেটা আলতো করে ঠেলতেই চমকে উঠল নোনতা। ওর ধারণা ছিলো শুধু ওকে আর ওর বন্ধুদেরই ম্যাজিশিয়ান ম্যাডাম দেখেছেন আজকে কিন্তু এ তো দেখছি আরও বেশ অনেকজন ছেলে মেয়ে এসে উপস্থিত। মনে মনে একটু দুঃখু পেলো নোনতা, একেই তো দেরি হয়ে গেল তারওপর যেটুকু দেখতে পাবে সেটাও পেছনে বসেই দেখতে হবে। খটকাই ফিসফিস করে নোনতাকে বলল, “এই বোয়াল মাছের ম্যাজিক হয়ে গেছে নাকি রে?”

“জানিনা আমি।” শুকনো মুখে জবাব দিলো নোনতা, আর তখনই ম্যাজিশিয়ান ম্যাডামের নজর পড়ল ওদের দিকে, “আরে নোনতা এন্ড ফ্রেন্ডস যে… এতো দেরি করলে কেন?” জবাবের অপেক্ষা না করেই ম্যাডাম নিজেই আবার বলে উঠলেন, “যাক গে। আসল ম্যাজিকটা হওয়ার আগেই এসে পড়েছো যাই হোক। কোনো চিন্তা নেই।”

“আসল ম্যাজিক!” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ফটকে।

ম্যাডাম মুচকি হেসে বললেন, “হুঁ হুঁ আসল খেলা তো এবার জমবে। তোমরা চুপটি করে বসে পড়ো দেখি।” এই বলে ম্যাডাম হাততালি দিয়ে উঠলেন, আর ওরা অবাক হয়ে দেখলো ঘরের হলদে আলোটা নিভে কোথার থেকে একটা নীলচে আলো জ্বলে উঠে গোটা ঘরের পরিবেশটাকে কেমন মায়াবী করে তুলল। আলোর এই পরিবর্তন দেখে স্বভাবতই ছেলেমেয়েরা কিচিরমিচির আরম্ভ করতেই ম্যাডাম গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, “চুপ। একদম চুপ, নয়তো এই খেলা দেখাতে পারবো না।”

ম্যাডামের নির্দেশে এমন কিছু ছিলো যার জেরে মুহূর্তের মধ্যে গোটা ঘরে আশ্চর্য রকমের নৈঃশব্দ্য নেমে এলো। বাচ্চারা চুপ করে গেছে দেখে বেশ খুশি হলেন ম্যাডাম। তিনি এবার নিজের ডান হাতটা উঁচিয়ে ধরলেন, নোনতারা দেখলো চেনে বাঁধা একটা গোল চাকতির মত জিনিস ঝুলে পড়ল তাঁর হাত থেকে, তারপর পেন্ডুলামের মত দুলতে শুরু করল টিকটিক করে। অদ্ভুত স্বরে ম্যাডাম বললেন, “সবাই এক দৃষ্টিতে এই চাকতিটার দিকে তাকাও, কেউ চোখ ঘোরাবে না অন্যদিকে।”


                 ★★★★★


“পটকাই এই পটকাই তোর ভাই কোথায় রে?”

“আমি তো জানিনা মা।”

“উফফ আচ্ছা ছেলে একটা। বেশি বোয়াল মাছ পায়নি বলে সেই যে সকাল থেকে গোঁসা করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে এখন সন্ধ্যে হয়ে গেল তাও ফেরার নামটি নেই…!”

“আহা তুমি রাগ কোরো না মা, আমি খুঁজে আনছি ভাইকে।”

“হুম সেই ভালো। যা গিয়ে খুঁজে আন, তবে নিজে আবার কোথাও বসে রয়ে যাস না।”

মা’কে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে আসে পটকাই। মোটামুটি সে আন্দাজ করতে পারে তার গুণধর ভাইটি কোথায় যেতে পারে। নিশ্চয় নোনতার বাড়িতে গিয়ে বসে আছে। 


   চুপি চুপি নোনতাদের বাড়িতে আসে পটকাই, কিন্তু ওদের বাড়িতে ঢুকে দেখে নোনতার মা আর দিদি কেমন যেমন উদ্বিগ্ন হয়ে কারুর অপেক্ষায় বসে। বাড়ির কোথায় নোনতা বা ওর বাবাকে দেখতে পায়না পটকাই। হতাশ হয়ে তাই সে বেরিয়ে আসে নিঃশব্দে, ভাবে একবার বল্টুর বাড়ি গিয়ে দেখবে। কিন্তু বল্টুর বাড়ি গিয়ে আরও বেশি অবাক হয়ে যায় পটকাই। সেখানে বল্টুর ঠাকুমাকে দেখে দাওয়ার বসে আঁচলের খুঁট দিয়ে ক্রমাগত চোখ মুছতে। পটকাইয়ের বুঝতে বাকি থাকে না যে কোথাও একটা কিছু গন্ডগোল হয়েছে, খুব বড় গন্ডগোল। তাও শেষ চেষ্টা হিসেবে সে ফটকের বাড়িতে একবার দেখে আসবে ঠিক করে। ফটকের বাড়িটা গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে তাই সেদিকেই পা বাড়ায় পটকাই। কিন্তু ফটকের বাড়ি অবধি আর পৌঁছাতে হয়না ওকে, তার আগেই দেখে দনাইয়ের পাড়ে বেশ কিছু লোকের জটলা হচ্ছে। গুটিগুটি পায়ে জটলার কাছে এগিয়ে যায় পটকাই, ভিড়ের মাঝেই নোনতা, বল্টু আর ফটকের বাবাকেও দেখতে পায় সেখানে। ওনাদের উত্তেজিত আলোচনা কানে এসে লাগে পটকাইয়ের,

“আমার বল্টুটা অঙ্ক কষে খেলতে বেরিয়েছিল, কোথায় যে গেল তারপর!”

“আমার ছেলেটাও তো রোজের মতোই বেরিয়েছিল বিকেলে তারপর এখন অবধি ফিরল না।”

“শুধু আপনাদের ছেলে নয় গ্রামের আরও কয়েকটা বাচ্চাও বাড়ি ফেরেনি এখনো।”

“আমার গিন্নি তো বলেছিল ওরা ইস্কুলের দিকে যাবে।”

“বিকেল বেলা ইস্কুলে কেন?”

“আরে ওই ম্যাজিক দলটা এসেছে না ওদের দেখতে।”

“তাহলে তো আমরাও ইস্কুলেই চলুন, ওখানেই হয়তো আছে এখনও।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ তাই চলুন।”


সিদ্ধান্ত হওয়া মাত্রই সবাই ইস্কুলের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু তখনই মনে হয় কেউ যেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে এইদিকেই, পায়ের আওয়াজ শুনে তাই এই মানুষগুলো একটু থমকে দাঁড়ায়। আর এদিকে যার পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল তিনি কাছাকাছি আসতেই দেখা যায় মানুষটা আর কেউ না স্বয়ং ইস্কুলের হেড মাস্টারমশাই। তাঁকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে অবাক হয়ে নোনতার বাবা জিজ্ঞেস করেন, “কি হয়েছে মাস্টারমশাই?”

এতগুলো মানুষকে একসঙ্গে দেখে মাস্টারমশাইও কম অবাক হননি। তিনিও বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে ওঠেন, “আপনারা এতজন এখন যাচ্ছিলেন কোথায়?” এরপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই মাস্টারমশাই আবার বলেন, “যাক গে। আপনাদের একটা জরুরি কথা বলতে এলাম।”

“কি কথা?” জিজ্ঞেস করে গ্রামের একজন।

“ভারী অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। আমি আজ বিকেলে একটু বেরিয়েছিলাম কাজে। বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে শুনলাম মা নাকি দুয়ারে বসে সেলাই করতে করতে দেখেছেন যে ওই ম্যাজিশিয়ানদের ঢাউস গাড়িটা হুশ করে যেন কোথায় চলে গেল। আমি তো এ কথা শুনে খুবই অবাক হলাম, কালকে শো আর আজকেই… যাইহোক আমি তড়িঘড়ি করে ইস্কুলের পেছনের হলঘরটায় গিয়ে দেখলাম সব ফাঁকা। কেউ

কোত্থাও নেই।”

“সেকি! তাহলে আমাদের বাচ্চারা কোথায় গেলো?” চিৎকার করে ওঠেন ফটকের বাবা।

“বাচ্চারা ওখানে গিয়েছিল নাকি? আমি তো বাড়ি ছিলাম না তাই ঠিক জানিনা, মানে…”

“এক মিনিট মিনিট… হায় ভগবান এ কি হল!” আর্তনাদ করে উঠে মাটিতে ধপ করে বসে পড়েন গ্রামের বয়স্ক মানুষ হরিসাধন ঘোষ।

তাঁকে এমন করতে দেখে অবাক হয়ে সবাই জিজ্ঞেস করতে থাকে, “কি হল কাকা?” “কি হল?”

হরিসাধন ঘোষ বিড়বিড় করতে করতে বলেন, “ম্যাজিক দল… বাচ্চা উধাও… দু’য়ে দু’য়ে চার…”

“আহা হরি বাবু স্পষ্ট করে বলুন না ব্যাপার খানা কি?” উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেন মাস্টারমশাই। 

“কি বলি মাস্টার! জানোই তো রোজ সকালে আমি বড় রাস্তার ধারে ননির দোকানে চাই চা খেতে। সেখানেই আজ সকালে দেখলাম খবরের কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে। একটা ছেলেধরার দল নাকি এমন ম্যাজিশিয়ানের ভেক ধরে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বাচ্চা চুরি করেছে। আমার তো মনে হচ্ছে…”

হরি দাদুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ভিড়ের কাছ থেকে চুপি চুপি সরে আসে পটকাই। হরি দাদুর কথাই যদি ঠিক হয় তার মানে… কি ভয়ঙ্কর কান্ড রে বাবা! দু’মিনিট একটু ভেবে নেয় সে, তারপরেই লাফিয়ে ওঠে… আইডিয়া! উফফ… এতক্ষণ এই কথাটা মাথায় কেন যে আসেনি! আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে বাম হাতের আঙ্গুলটাকে পটকাই ঠেকায় কপালের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়। খটকাই তার যমজ ভাই, তাই যত দূরেই থাক না কেন মনে মনে তারা ঠিক যোগাযোগ করতে পারে।


                 ★★★★★


কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলো খটকাই। ঘুমোতে সে বড্ড ভালোবাসে, যখন-তখন যেখানে-সেখানে সে নির্দ্বিধায় ঘুমিয়ে পড়তে পারে। এই জন্যই তো মায়ের কাছে বকাও খেতে হয় খুব। যাইহোক, এখন মাথাটা কেমন টিপিটিপ করছে কেন! চোখ বন্ধ করলো খটকাই, আর তারপরেই মাথার মধ্যে শুনতে পেলো পটকাই এর গলা, “এই খটকাই শুনতে পাচ্ছিস?”

“হুঁ।” মনে মনে উত্তর দিলো পটকাই। 

“তুই এখন কোথায়?” পটকাইয়ের প্রশ্নে ঝপ করে চোখ দুটো আবার খুলে ফেলল খটকাই, সত্যিই তো সে কোথায় এখন! এটা তো একটা গাড়ি মনে হচ্ছে। ওই তো নোনতা, বল্টু, ফটকে… ওরাও সবাই ঘুমুচ্ছে। কি হল ব্যাপারটা! মুহূর্তের মধ্যে খটকাইয়ের মনে পড়ে গেল সব কিছু। সেই যে ম্যাজিক দেখতে গিয়েছিল তারা... নোনতা যাকে ম্যাডাম বলছিল তিনি একটা হার দোলাচ্ছিলেন ওদের সামনে, সবাই তাকিয়েছিল ওটার দিকে… খটকাইও তাকিয়ে ছিল কিন্তু ওটার দুলুনি দেখতে দেখতে ওর ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল… তারপরেই ম্যাডাম বললেন সবাই উঠে দাঁড়াও, বলতেই সবাই উঠে দাঁড়ালো… তারপর ম্যাডাম সবাইকে গাড়িতে গিয়ে বসতে বললেন, সবাই চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসল… খটকাই ভেবেছিল এটাও বুঝি একটা ম্যাজিক তাই সেও চুপচাপ উঠে বসে পড়েছিল গাড়িতে আর তারপরে কখন যেন ঘুমিয়ে যায়।

  

   খটকাইয়ের কাছে সব কিছু শুনে ধমকে ওঠে পটকাই, “বলি তোর কি কোনো কান্ড জ্ঞান নেই! জানিস কাদের পাল্লায় পড়েছিস? ওরা ছেলেধরা। নোনতাদের নিয়ে পালাচ্ছে।”

“ধুরর এরা তো ম্যাজিশিয়ান।” পটকাইয়ের ভয়কে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে হেসে ওঠে খটকাই।

এতে আরও রেগে যায় পটকাই। সে চিৎকার করে ওঠে, “ওরে বোকা তোর শুধু খাওয়া আর ঘুম তাই না! এদিকে বাচ্চাদের না পেয়ে গ্রামের সবাই অস্থির হয়ে পড়েছে যে। ওরা সত্যিই ছেলেধরা। তুই ছিলি অথচ কিচ্ছু করতে পারলি না, গ্রামের এতগুলো বাচ্চাকে ওরা ধরে নিয়ে পালিয়ে গেল!”

“ওরে বাবা এখন কি হবে তাহলে?”

“কি আবার? আমাকেই বোধহয় যেতে হবে দেখছি। 

তোর কানটা টান দেখি বড় করে…”

পটকাইয়ের নির্দেশ মত নিজের বাম কানটা বড় করে টেনে ধরল খটকাই, আর তার মধ্য দিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফুরুৎ করে বেরিয়ে এলো পটকাই। খটকাই আনন্দে লাফিয়ে উঠল, কিন্তু পটকাই গম্ভীর গলায় বলল, “নাচানাচির সময় এখন নেই। আগে সম্মোহন কাটাতে হবে নোনতাদের।”

“সম্মোহন? সেটা আবার কি?”

“উফফ তুই না খটকাই! ইস্কুলে গিয়ে পড়া না শুনলে এই হয়। আমরা বাচ্চাগুলোর কানে ফু দিলেই সম্মোহন কেটে যাবে ওদের। কিন্তু এখনই এটা করলে চলবে না, আগে নোনতারটা কাটাই...”


এই বলে পটকাই নিজে গিয়ে আগে বেশ জোরে একটা ফু দিলো নোনতার কানে। চমকে উঠল নোনতা, “পটকাই তুই এখানে! আমি এটা কোথায়?” ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে নোনতাকে চুপ করতে বলল পটকাই। ছেলেধরা গুলো গাড়ির সামনের দিকে বসে আছে, ওরা শুনতে পেলেই মুশকিল। তারপর পটকাই নোনতাকে বুঝিয়ে দিলো এখন ওকে কি করতে হবে, “শোন তুই এখন ওদের কাছে গিয়ে বলবি তোর জোরে বাথরুম পেয়েছে। ওরা অবাক হয়ে যাবে প্রথমে, তারপর তোকে নিয়ে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়বে সেই সুযোগে আমি… একি এতো চিৎকার কেন?” 

পটকাইয়ের প্ল্যানটা পুরোটা বলা শেষ হওয়ার আগেই ওরা দেখলো খটকাই সব কটা বাচ্চার কানে ফু দিয়ে ওদের সম্মোহন কাটিয়ে দিয়েছে আর তাতেই হয়েছে বিপত্তি, হুঁশ ফিরতেই সবাই ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে লেগেছে। বাচ্চাগুলোকে চিৎকার করতে দেখে অবাক হয়ে সামনে থেকে দুটো লোক উঠে এলো। একজন আরেকজনকে বলল, “কেসটা কি? ম্যাডামের সম্মোহন এতো তাড়াতাড়ি তো কাটে না!”

“আরে সে নিয়ে পরে ভাববি। আগে এদের নিয়ে কি করি সেটা ভাব।”

“বাচ্চারা চিৎকার কোরো না।” লোকদুটো কিছু করার আগেই এগিয়ে এলেন ম্যাডাম, “এটাই আমার বিশেষ ম্যাজিক। তোমাদের মনে হচ্ছে তো নিশ্চয় যে তোমরা একটা গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছ? এটাই আসলে ম্যাজিক।” 

ম্যাডামের কথা শেষ হওয়া মাত্রই সব বাচ্চা চুপ করে গেল, কিন্তু প্রতিবাদ করে উঠল নোনতা, “তোমরা মিথ্যে কথা বলছো। তোমরা ছেলেধরা, আমাদের নিয়ে পালাচ্ছ...” নোনতার কথা শুনে আবার কাঁদতে শুরু করল বাচ্চাগুলো। পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে দেখে ম্যাডামের এক সঙ্গী ঘাবড়ে গিয়ে পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে উঁচিয়ে ধরল এবার, “চোপ একদম চোপ।”

বাচ্চাগুলো বন্দুক দেখে ভয় পেয়ে গেল ভীষণ, চিৎকার থামলেও ফোঁপাতে লাগলো তারা। কিন্তু তারপরেই বন্দুক হাতে লোকটার কাছ থেকে এক লাফে দূরে ছিটকে গেলেন ম্যাডাম আর তার আরেকজন সঙ্গী। লোকটা কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে বলল, “কি হলো?” 

ম্যাডাম একটা ঢোঁক গিলে আস্তে আস্তে আঙ্গুল তুলে লোকটার হাতের দিকে ইশারা করলেন। লোকটাও অবাক চোখে নিজের হাতের দিকে তাকিয়েই জোরে চিৎকার করে উঠল, “ওরে বাবা রে সাপ সাপ…!” 

“ওরে তোর হাতে বন্দুকের জায়গায় সাপ এলো কি করে রে!” 

“আ… আমি জানিনা।”


ওদের অবস্থা দেখে পটকাই হাসতে হাসতে নোনতার দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপল আর খিলখিল করে হেসে উঠল নোনতা। ওকে হাসতে দেখে ম্যাডাম রেগে তেড়ে এলেন ওর দিকে কিন্তু তার আগেই বাচ্চাগুলো হৈহৈ করে এসে চেপে ধরল ম্যাডাম আর লোকদুটোকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কুপোকাত হয়ে গেলো তারা। এদিকে বল্টু সিটের তলা থেকে দুটো দড়ি বের করে আনতেই বেঁধে ফেলা হল ওদের। কিন্তু একি গাড়িটা এমন এঁকে বেঁকে চলছে কেন! নোনতা আর পটকাই ছুটে ড্রাইভারের কেবিনে গিয়ে দেখল ড্রাইভার অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে মিটি মিটি করে হাসছে খটকাই। 

“এ কি করেছিস তুই!” হতাশা ঝরে পড়ল পটকাইয়ের গলায়।

“হুহু তোরা সবাই ওদের তিনজনকে সামলাতে অস্থির হচ্ছিলি আর দেখ আমি একাই কেমন কুপোকাত করে দিলাম একে।” বেশ গর্ব করে কথাগুলো বলল খটকাই।


খটকাইয়ের কথা শুনে কাঁদো কাঁদো গলায় নোনতা বলে উঠল, “হায় ভগবান এবার কি হবে রে পটকাই! গাড়ি যে চলছে এখনও, আমরা তো কেউ গাড়ি চালাতে জানিনা। যে কোনো মুহূর্তে এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে!” 

“তুই চিন্তা করিসনা না নোনতা, যে গন্ডগোল করেছে ঠিকও সেই করবে।

এই খটকাই আয় আমার সঙ্গে। আজ যদি এই বাচ্চাগুলোকে না বাঁচাতে পারি তাহলে দনাই এর ভুত পাড়ায় আর ফিরবো না কোনদিন।” এই বলে গাড়ির জানালা দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল পটকাই, ওর পিছু পিছু বেরোলো খটকাইও। ওরা দেখলো এমন এঁকে বেঁকে গাড়ি চলছে দেখে রাস্তার লোক থেকে শুরু করে কুকুর বিড়াল সব যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। পটকাই আর সময় নষ্ট করলো না, ওর হাত দুটোকে যতটা পারল লম্বা করে গাড়ির ডান দিকের শুরুর আর শেষের চাকাটা ধরে নিলো দুই হাত দিয়ে, আর পা দিয়ে চেপে ধরল মাঝের চাকাটাকে। পটকাইয়ের দেখাদেখি একই রকম করে বাম দিকের চাকাগুলোও আটকে দিলো খটকাই। গাড়িটা এবার থামল অবশেষে। দরজা খুলে হৈহৈ করে গাড়ি থেকে নেমে এলো বাচ্চাগুলো, ওরা বুঝতেও পারল না কে বাঁচালো ওদের। শুধু নোনতা, বল্টু আর ফটকে গাড়ি থেকে খটকাই আর পটকাইয়ের কানে কানে বলল, “থ্যাংকু বন্ধু।”

শেষ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama