মনের মিতা
মনের মিতা
ভোর সকালের দিকে রওনা হওয়ার আগেই বিছানা ছাড়ে কেকা। সংসারের কত কাজ। সেসব তো সময়ে শেষ করতে হবে। সকালের চা করতে করতে এইসব সাংসারিক গল্পই করে ও নীলার সঙ্গে। নীলা ওর বাড়িতেই প্রথম কাজে আসে সকালবেলা। র’চায়ে চুমুক দিতে দিতে আর প্রতিদিন মালকিনের এক গল্প শুনতে শুনতে এ কথা সে কথার মাঝে ও প্রায়ই বলে “মাসি এবার দাদার একটা বিয়ে দাও, তোমার সাহায্য হবে”
“আমি বিয়ে দেওয়ার কে রে, তোর মেসো আছে। তিনিই যা করার করবেন”
নীলা আর ও বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে আবার অন্য বিষয়ে চলে যায়।
ঘরে শুয়ে প্রায় প্রতিদিন এই আলোচনা শুনতে পায় বিতান, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বয়েস এগোতে এগোতে প্রায় চল্লিশ বছর ছুঁই ছুঁই করছে, আর কবে একটা মনের মতো সাথী হবে ওর। হবে বলেও আর আশা নেই। বন্ধুদের মধ্যে কতজন বিয়ে করে এক দুটো সন্তানের গর্বিত বাবা হয়ে গেছে। দোষ ও কাউকে দেয় না, দোষ যদি কারো থেকে থাকে তা হল যে সময়টাতে ওর পৃথিবীতে আগমন সেই সময়টার। নাহলে জন্মের সাত বছরের মধ্যে ক্যান্সার মাকে কেড়ে নিতে পারে? ও তখন বছর সাতের আর বৈশাখী বছর দুয়ের। ছোট্ট বোন আর ওকে মানুষ করার নামে বাবা আবার বিয়ে করে। দ্বিতীয় মাও পাঁচ বছরের মধ্যে স্বর্গত হয়। এরপর কেকার আগমন ওদের জীবনে।
কেকা সব জেনেই ভুবনবাবুর তৃতীয় স্ত্রী হতে রাজি হয়েছিল কিন্তু এ বাড়িতে পা দেওয়ার পর তার ব্যবহার জানান দিতে শুরু করলো যে সে ওদের পছন্দ করছে না। কিন্তু পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাতে যেতে না পারে তাই নানারকমের রীতিনীতি চাপিয়ে দিলো ওদের ওপর। জননীর নানা রকমের নিয়ম নীতির শেকলে ওরা এমন বাঁধা পড়লো যে স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর বন্ধ হয়ে গেলো। প্রেমেও পড়লো না ভাই বোনের দুজনে। কলেজ পাশ করতে করতে ভালো পাত্র দেখে বৈশাখীর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল। ততদিনে বাবা অবসর গ্রহণ করেছে ছোট ভাইয়ের (এ পক্ষের) পড়াশোনা শেষ হয়নি। বিতান চাকরির হাত ধরলো, যা যখন পেলো, সংসারে সাহায্য করতে হবে তো। কিন্তু গ্রাজুয়েশনের বেশি পড়াশোনা এগোয়নি তাই চাকরি ভালো জুটলো না, মোটামুটি। সেরকম আয় নেই যে ছেলের তার সম্পর্কে বাবা মায়ের কোন উচ্চ ধারণা থাকে না স্বাভাবিক ভাবেই। তাই বিতানের বিয়ে সম্পর্কে কোন উচ্চবাচ্য শোনা গেলো না। প্রথম প্রথম মেয়েদের দিকে আকর্ষিত হলেও বেশী দূর ব্যাপারটা এগোবে না জেনে বিতানও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল।
“কি রে শরীর খারাপ নাকি?” বাবার প্রশ্নে বিতান চোখ খুলে তাকালো আর চোখাচোখি হয়ে গেলো ভুবনবাবুর সাথে। ও উঠে বসলো বিছানার ওপর, বলল “না না শরীর খারাপ না। উঠবো উঠবো করছিলাম, তুমি ডাকলে। কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ আজ সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি ফিরলে তোর সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলবো”
“ঠিক আছে আজ তাহলে ক্লাবে যাবো না”
অফিস যাওয়ার পথে ও চিন্তা করেও বুঝতে পারেনি কি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাবা কথা বলতে চায়। তবে কি মায়ের সাথে আবার কোন বিষয়ে মতান্তর হয়েছে? সন্ধ্যায় ফিরলে বিতান দেখল বাবা বসে বসে কাগজ পড়ছে, প্রতিদিনই মতো আর মা বেরিয়েছে হাঁটতে। স্নান সেরে বাবার কাছে এসে বসলো ও। ভুবনবাবু মুখ তুলে বললেন “শোন রবিবারের কাগজ ঘেঁটে তোর জন্য কয়েকটা পাত্রী প্রাথমিক ভাবে বাছাই করে রেখেছিলাম। তাদের চিঠি পাঠিয়েছিলাম, কয়েকজনের বাড়ি থেকে উত্তর এসেছে। তুই একবার তাদের বায়োডাটা আর ছবি দেখে বল কোনজন তোর পছন্দ। আর বল সামনের রবিবার তোর সুবিধে হবে কি না। তাহলে তার বাড়িতে খবর পাঠাবো যে আমরা দেখতে যাচ্ছি”
বিতান বাবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর বাবার এগিয়ে দেওয়া ছবি আর বায়োডাটা দেখতে শুরু করলো। ছবিতে মেয়েগুলো চেহারা যেমনই হোক না কেন, মেয়েদের একটা গুণ বেশী আছে ওর থেকে, সবাই উচ্চপদে চাকুরিরতা। এরকম মেয়ে কি ওকে ওর মনের সাথী করে নেবে? ভুবনবাবু বোধহয় ছেলের মনের কথা বুঝেছিলেন তাই বললেন “অত চিন্তা কি ওরা তো আগ্রহ দেখিয়েছে। আগে চল দেখে আসি তারপর বাকিটা বোঝা যাবে”
এরপর কয়েকটা রবিবার ওরা দেখে এলো বাছাই করা মেয়েদের। কিন্তু প্রাথমিক কথাবার্তার পর বিশেষ এগোলো না কোনটাই। কেকা এই বিষয়ে একটা কথাও বলল না। তবে পাড়ার লোকেদের কাছে এমন সব আলোচনা করে এলো যা ঘুরেফিরে ওদের কানে পৌঁছালো আর তাতে বোঝা গেলো ছেলের বৌ আনাটা তার একেবারে অপছন্দের। কারণ যা দর্শিয়েছে তা হল আধুনিকা বৌমা এলে বাড়ির কাজ তো করবেই না, শ্বশুর শ্বাশুড়িকেও মানবে কিনা সন্দেহ। শেষে তার না ঝিয়ের দশা হয়।
ভুবনবাবু এতদিন অশান্তির ভয়ে বাড়িতে সেরকম মুখ খুলতেন না তবে এবার আর স্ত্রীর অশান্তির ভয়ে চুপ করে থাকার চেষ্টা করলেন না। এবার কাগজে ছেলের জন্য পাত্রী চাই কলামে বিজ্ঞাপন দিলেন। সময়মতো দু চারটে চিঠিও এসে পৌঁছালো বাড়িতে।
সেদিন আবার পাত্রী দেখতে উপস্থিত এক বাড়িতে। ওদের খবর দেওয়াই ছিল তাই আসতেই সাগ্রহে আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে এলেন মেয়ের বাবা নিতাইবাবু। কিন্তু ঘরে ঢোকার মুহূর্তে বিতানের মনে হল কারও ছায়ামূর্তি সাঁ করে ভেতরে সরে গেলো। কে ছিল? প্রশ্ন উঠলো বিতানের মনে। বসার ঘরে এ কথা সে কথার মাঝে মায়ের পেছন পেছন পাত্রী এলো শরবতের গ্লাস বসানো ট্রে নিয়ে। শরবৎ এগিয়ে দিতেই নিতাইবাবু বললেন “এই আমার মেয়ে লিপি” হাত উঠলো নমস্কারের ভঙ্গীতে আর তার সাথে চার চোখের মিলনও হল। এই দেখাতেই বিতানের মনে হল এ হতে পারে মনের মানুষ।
এদিকে শুরু হল স্বাভাবিক প্রশ্নোত্তর পর্ব। ভুবনবাবু একাধারে প্রশ্ন করে গেলেন আর লিপি উত্তর দিলো। বিতান কোন প্রশ্ন করলো না ওর চোখ কান দুটোই লিপির দিকে নিবদ্ধ ছিল, প্রতিটা কথার উত্তর কি ভঙ্গীতে দেয় তা দেখছিল। আর যত দেখছিল ওর মন তত ওকে কাছে পেতে চাইছিল। ভুবনবাবুর প্রশ্নপর্ব শেষ হতে উনি বললেন “আমি তো আমার যা জানার ছিল জানলাম। লিপি’মা তোমার যদি কোন প্রশ্ন থাকে করতে পারো”
লিপি মাথা নেড়ে জানালো কোন প্রশ্ন নেই তার। জল মিষ্টি খেয়ে বিতানরা বাড়ি ফিরলো। একসময় ভুবনবাবু ছেলেকে বললেন “এই মেয়েটাকে কেমন লাগলো রে তোর?”
বিতান মনে মনে ভাবছিল বাবা কখন প্রশ্নটা তোলে, বলল “ভালো”
“হুম আমারও ভালো লেগেছে তবে একটাই অসুবিধা মেয়ে চাকরি করে না। আমরা তো চাকুরিরতা পাত্রী চাইছিলাম। তোর সাথে কাঁধ মিলিয়ে সংসারের হাল ধরলে তোদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হতো। জানিস তো আমি অবসর নিয়েছি, বেশী কিছু নেইও ব্যাঙ্কে, ছোটটা এখনো কিছু করে উঠতে পারেনি, তবে হয়েও যাবে। কিন্তু ওর আয় তো ওকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ওর ভবিষ্যতের জন্য। তাই চাকুরিরতা বৌমা হলে ভালো হতো”
বিতান বিমর্ষ হয়ে পড়লো এও কি আসবে না ওর জীবনে? আশা ছিল এবার নিশ্চই ভাগ্য পাল্টাবে।
কিন্তু ভালোবাসার স্বপ্ন দেখা বেশীদিন এগোতে পারলো না। ওর বিয়ে প্রায় ঠিক এই আশঙ্কায় কেকা আবার অশান্তি শুরু করলো আর তার ফল হল মারাত্মক। ভুবনবাবু এমনিতেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। একদিন মাথা ঘুরে ঘরের মধ্যে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। হাসপাতাল ডাক্তার ঘুরে জানা গেলো হৃদয় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছে এক্ষুনি ভর্তি করতে হবে অপারেশনের জন্য। নিজের হৃদয়ের দুয়ার বন্ধ করে বাবার দুশ্চিন্তা করতে শুরু করলো বিতান। অপারেশন টেবিলে যাওয়ার আগে ভুবনবাবু বললেন “মেয়েটার ছবি ফেরত পাঠিয়ে দিস। এখন তো এ বিষয়ে আর এগোনো গেলো না কিন্তু ওদের হাতে যদি অন্য কোন ভালো পাত্রের সন্ধান থাকে তাহলে ওরা এগিয়ে নিয়ে যাক কথাবার্তা। আমাদের জন্য কোন মেয়ের বিয়ে আটকে যাওয়া উচিত হবে না”
বছর গড়িয়ে গেলো। এর মধ্যে ভুবনবাবু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তবে বিতানের বিয়ে নিয়ে আর কোন কথা এগোয়নি। ও আগের মতোই অফিস ঘর আর বাবার জন্য ডাক্তারের চেম্বার করে চলছিল। হঠাৎই একদিন লিপির এক আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো ডাক্তারের চেম্বার। ভদ্রলোক চিনতে পেরেছিলেন ওকে। এ কথা আর সে কথার পর যথারীতি ওর বিয়ের কথা উঠলো। উনি ভেবেছিলেন বিতানের বিয়ে হয়ে গেছে কিন্তু ও জানালো বাবার অসুস্থতার কথা অপাররেশনের কথা। তখন উনিও জানালেন ঘটনাচক্রে লিপিও এখনো কুমারী। বিতানের মনে আশার আলো জ্বলে উঠলো। তবে কি লিপি এবার আসবে ওর জীবনে?
বাড়ি ফেরার পর বাবাকে কথায় কথায় সব জানালো বিতান। ইতিমধ্যে ভুবনবাবু আবার ছেলের বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন। ছোটজন চাকরি পেয়ে গেছে, ওর ব্যাপারে আর চিন্তা নেই। ওনার আর কেকার যথেষ্ট বয়েসও হয়ে গেছে। এখন বাড়িতে বৌমা আনতেই হয়। ছেলের কথা শুনে ভাবলেন কিছু তারপর বলল “ঠিক বলেছিস লিপিকে আমারও খুব মনে ধরেছে রে। আমার অসুখ না ধরা পড়লে... তাছাড়া এখনো ওর বিয়ে হয়নি। মনে হয় ঠাকুরেরও তাই ইচ্ছে ও তোর স্ত্রী হয়। ওনাদের ফোন নম্বরটা দে তো দেখি কথা বলে”
কেকার সব আপত্তি নস্যাৎ হয়ে গিয়ে এক শুভ দিনে লিপি বিতানের হাত ধরে এ বাড়ির আঙিনায় পা দিলো নতুন বৌয়ের চেহারায়।
***********
আজ বিতান খুব খুশি। আজ ওর আর লিপির বিয়ের এক বছর পার হল। অনেক উত্থান পতন গেছে সংসারের দিনলিপিতে কিন্তু লিপি বেশ সুন্দর করে সংসার করে চলেছে, কেকাকে সঙ্গে নিয়ে।