মাতৃ দিবস
মাতৃ দিবস


অতনু গাড়ি থেকে নেমে মায়ের স্যুটকেসটা নামিয়ে মা কে আস্তে আস্তে ধরে ধরে নামালো। ভাড়া মিটিয়ে মায়ের একটা হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। না, নিজের বাড়ির ভিতরে না একটি বৃদ্ধাশ্রমের ভিতরে। বেশ মোটা টাকা ডোনেশন ও করেছে সে এই বৃদ্ধাশ্রমে। আজ সে তার মা কে এখানে রেখে তার পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে একেবারের জন্য বিদেশে চলে যাবে। নিউ ইয়র্কে তার পাকাপোক্ত চাকরি আছে তাছাড়া এদেশে চাকরির যা অবস্থা তা আর বলার নয়। মা ও কোনোদিন ওই দেশের চলাফেরার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারবে না, তাই এটাই ভালো যে মা কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে সে ফিরে যাবে ওই দেশে। গত মাসে বাবার গত হওয়ার পর ভারতে ফিরে তার বাবার শেষ কার্য সম্পন্ন করেছে সে। মা একা একা ওই বাড়িতে কি করেই বা থাকবে এসব অনেক সাতপাঁচ ভেবে শেষে ইন্টারনেটে খুঁজে পেলো এই বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা। দু'দিন আগে এসে কথা বলে গিয়েছিল সে। আজ মা কে দিতে এসেছে শুধুমাত্র।
"মা এই ঘরটাই তোমার। এমনিতে সবাই কে আলাদা ঘর দেওয়া হয়না তবে আমি মোটা টাকা ডোনেশন দিয়েছি তাই তোমার জন্য আলাদা ঘর দিয়েছে। অন্যান্য কিছুজনের ও আলাদা ঘর আছে যারা টাকা ডোনেট করেছে, তুমি কিন্তু সাবধানে থেকো। আমার ফোন নম্বরগুলো সব ওদের কাছে দেওয়া রয়েছে আর এই তোমার নীল ডায়েরিতে সব দরকারি ফোন নম্বরগুলো লিখে দিয়েছি। আসছি তাহলে ভালো থেকো।" এক নিঃশাসে বলে গেল অতনু।
"তুই ফিরে যাবার আগে একবার আমার সাথে দেখা করে যাবি বাবা?" চোখের কোনায় জল এনে মা জিজ্ঞেস করলো অতনু কে।
"আমার বোধহয় সময় হবে না মা। তাছাড়া এতগুলো দিন ছুটি নিলাম কাজ থেকে, বস নেহাতই ভালো বলে এতদিন ছাড়লো। বাড়িটা বিক্রি হলেই চলে যাবো। তোমার আর আমার যে জয়েন্ট একাউন্ট আছে সেটায় টাকা ফেলবো। দরকার পড়লে কাউকে নিয়ে গিয়ে টাকা তুলে নিও। আসছি।"
কোনোরকম তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়ে পড়লো অতনু। আজ আবার বিকেলে বাড়ি দেখতে লোক আসবে তাই তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে তাকে। ফোনে একটি ক্যাব বুক করলো পাঁচ মিনিট এর মধ্যে গাড়ি চলে এলো গাড়ির সামনের দরজা খুলে বসতে যাবে এমন সময় দেখলো ড্রাইভারের পাশের সিটে একটা রংবেরঙের ফুলের গুচ্ছ এবং একটি সোনালী রঙের প্লাস্টিক মোড়ানো উপহার। অগত্যা পিছনেই বসে পড়লো। অনেকটা পথ যেতে হবে এদিকে হাতে একদম সময় নেই। গাড়ি চলতে শুরু করলো। গাড়ির যে চালক তার খুব একটা বয়স না এই কুড়ির ঘরেই হবে। এতটা পথ চুপচাপ তো আর যাওয়া যায়না তাই অতনু নিজেই কথা শুরু করলো।
- "কারুর জন্মদিন বুঝি?" কৌতূহলী সুরে বললো অতনু।
- "হ্যাঁ? ওহ এইগুলো? আজ্ঞে না জন্মদিন নয়।" পাশে রাখা জিনিষগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললো গাড়ি চালক।
- "তবে?" জিজ্ঞেস করলো অতনু।
- "ওগুলো আসলে মায়ের জন্য। আজ যে মাতৃ দিবস। তাই মায়ের জন্য যথাসাধ্য এই ফুলগুলো কিনলাম আর ওই বাক্স তে একটা ফটো ফ্রেম আছে মায়ের জন্যে।"
- "আজ মাতৃ দিবস বুঝি?" একটু লজ্জাপ্রাপ্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো অতনু।
- "হ্যাঁ আপনি জানেন না? এই একটা দিনই তো সন্তানের ভালোবাসা পায় মায়েরা। নাহলে সারাবছর তো ছেলেপিলেরা ফিরেও তাকায়না মায়ের দিকে। জানেন আমিও ওই সব সন্তানদের মতনই ছিলাম। অবাধ্য, মায়ের কথা শুনতাম না, মা যখন কোনো কিছুতে বাঁধা দিতো খুব স্বার্থপর মনে হতো মা কে। তবে একদিন বুঝতে পারলাম নিজের ভুলটা। যখন মা আমাকে বাঁচানোর জন্য নিজের বুকে একটা গুলি নিয়ে নিলো।"
- "গুলি? মানে?" কাঁপা কাঁপা গলায় ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো অতনু।
- "ভয় পাবেন না। আসলে কিছু ভুল মানুষের সাথে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। তাদের সাথে মিশে নানা খারাপ কাজ করতে লাগলাম। জুয়ায় টাকা লাগানো, লোকজনদের হুমকি দেওয়া এরকম অনেক খারাপ কাজ। এমন কি ড্রাগের লেনদেন ও ছিল। একদিন একটা দল ড্রাগ কেনার আগাম টাকা দেয় তবে সময়মতো জিনিষ না পাওয়ায় আমাকে রাস্তায় পেয়ে অনেক মারে। পাক্কা এক মাস হাসপাতালে কড়া নজরে রেখে আমার চিকিৎসা করা হয় তবে যেদিন আমি হাসপাতাল থেকে ছুটি পাই সেদিন হঠাৎ খবর পেয়ে আমার গাড়ি আটক করে তারা। গাড়ি থেকে যেই নেমেছি ওমনি ওদের দলের নেতা আমার দিকে লক্ষ্য করে বন্দুক ধরে। নানা তর্ক বিতর্কের পর হঠাৎ গুলি চালায় সে কিন্তু গুলি আমার গায়ে লাগার আগেই আমার মা আমাকে উদ্দেশ্যে করা গুলি নিজের শরীরে নিয়ে নেয়।"
একটি অস্বস্তিকর নীরবতা ঘিরে ধরলো গাড়িটাকে।
- "সত্যি মায়েরা চিরকাল এমনই হয়। এখন কেমন আছেন তোমার মা?" একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে অতনু।
- "মা আর বেঁচে নেই। ওই ঘটনায় আমি আমার মা কে হারিয়ে ফেলি তবে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা পাই। সৎ পথের ডাল ভাত ও অসৎ পথের মাংস ভাতের চেয়ে ঢের ভালো। মায়ের জন্য নতুন ফটো ফ্রেম কিনলাম মায়ের বাঁধানো একটা ছবি ঘরে টাঙিয়ে রাখবো। নতুন বাড়ি করেছি এই সৎ পথের রোজগারে এবারে মায়ের একটা ফটো দেওয়ালে লাগালে আশা করছি মা আর রেগে থাকবে না আমার উপরে।"
কিছুক্ষন আর কেউই কিছু বললো না। প্রায় অনেকক্ষন চুপ থাকার পর গাড়ি চালক নিস্তব্ধতা ভাঙলো।
"দাদা আপনার ঠিকানা এসে গেছে।"
অতনু গাড়ি থেকে বেড়ানোর জন্য সবে গাড়ির দরজা খুলে এক পা বের করেছে এমন সময় কিছুক্ষন কি ভাবলো এবং গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে গাড়িতে বসে বললো,
"না যেখান থেকে উঠেছিলাম সেখানে নিয়ে চলো। যা টাকা লাগে দেবো।"
গাড়ি আবার ফেলে আসা পথে ছুটতে লাগলো। পকেট থেকে ফোন বের করে অতনু একজন কে ফোন করলো,
"হ্যালো আমি অতনু বলছি। আপনাদের আজ বাড়ি দেখতে আসার কথা ছিল। আসলে বাড়িটা আর বিক্রি করছি না। ঠিক করেছি আমি একেবারের জন্য এখানে চলে আসবো। ভালো থাকবেন।"
অতনু ঠিক করে ফেলেছে মা কে নিয়েই নিউ ইয়র্কে গিয়ে সব বিক্রি করে একেবারের জন্য ভারতে চলে আসবে। এখানেই একটা চাকরি খুঁজে নেবে অন্তত মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে না আর। যতদিন মা বেঁচে আছে আর একটা দিন ও তাকে একা রাখবে না আর।