মা
মা
জন্মের সময়েই মাকে হারায় শ্রেষ্ঠা | বিধবা পিসি দিদা আর বাবার এক দুর্সম্পকের দিদি যাকে শ্রেষ্ঠা মনিপিসি বলে ডাকে তারাই কোলেপিঠে করে তাকে মানুষ করেন | বহু জোড়াজুড়িতেও অতীশ আর বিয়ে করেনা | কারণ হিসাবে পিসিমা আর আত্মীয়স্বজনদের বলে ,
--- পরের মেয়েকে অন্য কোন মেয়ে এসে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসবেনা | আমার জীবনে স্ত্রী সুখ যদি থাকতো তাহলে শ্রেষ্ঠার জন্মের সময় তার মা মারা যাবে কেন ? আমার এখন একটাই উদ্দেশ্য মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করে তোলা | পিসিমা আর দিদি মিলে ঠিক ওকে বড় করে তুলতে পারবে |
বিয়ে করবেনা বলে ধনুক ভাঙ্গা পণ করে বসে ছিল অতীশ | কেউ তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও সরাতে পারেনি | পিসিমা ছাড়া এই যে দিদি নিরূপা ---একই গ্রামে বাস কিন্তু কেউ কাউকেই চিনতো না |অল্প বয়সেই স্বামীকে হারিয়ে ভায়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল | কিন্তু সারাটাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরেও দুবেলা পেট ভরে খেতে পারতোনা | পিসিমা একবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তার দুঃখের কাহিনী শুনে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন যে তাকে সাথে করেই অতীশের বাড়িতে নিয়ে আসেন | তখন শ্রেষ্ঠা মায়ের পেটে |
--- বৌমা তোমার এই শরীরের অবস্থা , আমারও বয়স হচ্ছে তাই নিরূপাকে সাথে করেই নিয়ে আসলাম | তাছাড়া মেয়েটার কেউ নেই | কাজকর্ম করবে , খাওয়াপরায় সারাটাজীবন ও এখানেই কাটিয়ে দেবে | তুমি একটু অতীশকে বুঝিয়ে বোলো |
স্ত্রীর মুখে একথা শুনে অতীশ হেসে বলেছিলো ,
-- নিয়েই যখন এসেছেন তখন তো আর তাড়িয়ে দেওয়া যায়না | তুমি বরং পিসিমাকে একটু বুঝিয়ে বোলো অন্যের দুঃখে কাতর হয়ে আর যেন কাউকে নিয়ে না আসেন |
অতীশ ভালো চাকরি করতো | সে ছিল সরকারি এক্সজিকিউটিভ অফিসার | নিজেই পছন্দ করে সায়নীকে বিয়ে করেছিল | সেও ছোটবেলাতেই তার বাবা মাকে হারিয়েছে | এই পিসিই তাকে মানুষ করেছেন | অতীশ পিসিমাকে যথেষ্ঠ ভক্তি শ্রদ্ধা করে , ভালোবাসে | শালিনী গ্রামের মেয়ে | অতীশ তার চাকরি জীবনে প্রথমদিকে কলকাতায় একটি মেসে থাকতো | শনিবার অফিস করে গ্রামে যেত পিসির কাছে | আবার সোমবার খুব ভোরে বেরিয়ে পরে অফিস করতো | এমনই একদিন বাড়ি যাওয়ার পথে রাস্তায় শালিনীর সাথে তার দেখা | মেয়েটিকে প্রথম দেখাতেই তার ভালো লেগে যায় | পথে কেউ একজন তাকে শালিনী বলে ডাকাতে অতীশ নামটা মনে রেখে দেয় | পিসিমা যখন তার বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে শুরু করলেন ঠিক তখনই অতীশ ঝোপ বুঝে কোপটা মেরেছিলো |
শ্রেষ্ঠাকে তার পিসিদিদা আর মনিপিসি সংসারের যাবতীয় কাজ ছোট থেকেই শিখিয়ে পারদর্শী করে তুলেছিল | পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে সে তাদের সাথে হাত লাগিয়ে সমস্ত কাজ অত্যন্ত নিপুণভাবে করতো | তার দিদা ও পিসি শ্রেষ্ঠার এই গিন্নি গিন্নি ভাবটা দেখে নিজেদের খুব গর্বিত মনে করতেন | আর মনেমনে ভাবতেন যে বাড়িতে ও যাবে তাদের আদর , আপ্যায়ন আর ভালোবাসা দিয়ে প্রত্যেকের মন জয় করে নেবে | গ্রাজুয়েশন শেষ করে সে একটা কম্পিউটার কচিনসেন্টারে ভর্তি হয় | সেখানেই পরিচয় হয় ধনীর দুলাল আবিরের সাথে | পরিচয়ের সূত্র ধরে দুজনে কাছাকাছি আসতে বেশি সময় নেয়না | বাবাকে কোন কথাই সে গোপন করেনা , আবিরের নামধাম সব সে তার বাবাকে জানিয়ে দেয় | অতীশ সব খোঁজ নিয়ে জানেন বিশাল ব্যপসায়ীর একমাত্র ছেলে আবির | এখন আবির বাবার বিজনেসই দেখাশুনা করে | কিন্তু এতো বড়লোক বাড়িতে মেয়ের বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে তিনি যাবেন কি করে ? অনেক ভেবেচিন্তে তিনি শ্রেষ্ঠাকেই বলেন ,' আবিরকে তার সাথে দেখা করার জন্য |'
আবিরের কাছ থেকেই তিনি জানতে পারেন সে তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান | বাবার বিজনেসের অধিকাংশ এখন সেই দেখাশুনা করে | মা গৃহবধূ | মা ভীষণ ভালো মনের মানুষ | মায়ের বাপের বাড়ি গ্রামে | এখনো প্রতিবছর পুজোতে মা মামাবাড়িতে যান কারণ মামাবাড়িতে দুর্গাপুজো হয় | আবির তার মাকে শ্রেষ্ঠার ছবি দেখিয়েছে | মায়ের পছন্দ হয়েছে | তিনিই বলেছেন এখন যাতে এ বাড়ি থেকেই বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে যাওয়া হয় | এসব শুনে অতীশবাবু বুকে বেশ বল পেলেন | তিনি সেখানে গেলেন এবং বিয়ে পাকা করেই ফিরলেন |
যথা সময়ে আবির ও শ্রেষ্ঠার বিয়ে হয়ে গেলো | সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে এই অট্টালিকা সম বাড়িতে ঢুকে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো | লোকজন , ঠাকুর , চাকর --- বড়বড় দামি আসবাবপত্র | কিন্তু বধূবরণ করলেন অতি সাধারণ এক আটপৌরে মহিলা | আবির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো ," আমার মা |" এতক্ষণে শ্রেষ্ঠা ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে তার এবং আবিরের মুখটা হুবহু এক | ভীষণ মায়াভরা মুখটি | তিনি নিজে হাত ধরে শ্রেষ্ঠাকে ঘরে নিয়ে আসেন | শ্রেষ্ঠা তার গায়ের থেকে অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ পায় | সবাই বলে মায়ের গায়ে একটা গন্ধ থাকে এটাই কি তবে সেই মা মা গন্ধ ? কিন্তু কোনদিন তো পিসিদিদা কিংবা মনিপিসির গায়ের থেকে এরকম কোন মায়াময় গন্ধ শ্রেষ্ঠা পায়নি | শ্রেষ্ঠাকে খাটের উপর বসিয়ে তার শ্বাশুড়ি বললেন ,
--- আমি কিন্তু তোকে তুই বলেই কথা বলবো | তুই জামাকাপড় ছেড়ে নে | আজ কালরাত্রির | আমি তোর কাছেই শোবো | আমার একটা মেয়ের খুব শখ ছিল | এ বাড়িতে তুই আমার মেয়ে হয়েই থাকবি | আর আমাকে আপনি আজ্ঞে একদম নয় | তোর যা কিছু দরকার আমাকেই বলবি | আমি তোর মা আর তুই আমার মেয়ে --- |
শ্রেষ্ঠা এতক্ষণ মন দিয়ে কথাগুলো শুনছিলো | এবার শ্বাশুড়ীকে 'মা' বলে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলো |
--- আরে তুই কাঁদছিস কেন ?
--- জীবনে প্রথম মা বলে ডাকলাম | আমি তো জন্মের পরেই মাকে হারিয়েছি | মা ডাকটা যে এতো মধুর আমি জানতামই না | খুব ভয় ছিল বিয়ের আগে | কিন্তু এখন মনেহচ্ছে ভগবান আমায় ঠিক জায়গাতেই পাঠিয়েছেন তানাহলে আমি যে এতো সুন্দর একটা মা পেতাম না |
শ্বশুড়িমা তার কপালে একটা চুমু করে বললেন ,
--- নে তুই ফ্রেস হয়ে নে আমি নিচুতে গিয়ে সকলের খাবার দিতে বলি |
শ্রেষ্ঠা ফ্রেস হয়ে খুশিমনে বারবার মনেমনে "মা , মা , মা"-- বলে ডেকে এক অদ্ভুত অনুভূতির স্পর্শ পেতে থাকে |
শেষ