মা চলে গেল
মা চলে গেল


মা কে হারিয়ে প্রায় দু'বছর হবে। তবে আজ ও যখন ওই রাতের কথা মনে করি যখন মা আমাদের ছেড়ে চলে যায় প্রচুর আফসোস হয় মায়ের জন্য , নিজের জন্য। কত একা ছিলাম আমরা সেদিন । তবে ওই রাতের আর কিছু লোকের সঙ্গ ছিল তাই সম্পুর্ন একা ছিলাম না অন্তত সেই রাতের জন্য। ওই ক্ষণ টা কে মনে করে এই কাহিনী টি লিখেছি। আমার মায়ের যাওয়া টা , ওই দিন টা ভুলতে পারিনি। আর ওই টার থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে এই কাহিনী টি লিখেছি।
"মা! মা! মা প্লিজ মা । একটু দাঁড়াও। মা । "
"পিউ মায়ের হৃদস্পন্দন কমে আসছে। ফেনা ... মুখে ! মা । পিউ অ্যাম্বুলেন্স ডাক। " দিদি র কথা ভেঙ্গে যাচ্ছে।পিউ তানাবানায় অ্যাম্বুলেন্স ডাকছে। মা অ্যাম্বুলেন্স এর নাম শুনে আরো আতঙ্কিত হয়ে যায়। শেষ অবধি ও মায়ের এক কথা "আমি হাসপাতাল যাবো না। " হাসপাতাল বলতে এক কথা যেটা প্রথম মনে আসে ওই টা হচ্ছে আবর্জনা র সরঞ্জাম। শেষে মা গেল না। যেতে পারলেন না।
দিদি চিত্কার করছে ,"মা।" এইটা কোনো পাওয়া র নয় হারানো র চিত্কার। মা চলে গেল। আর নেই। আর কথা টা আমি সহজে গ্রহণ করতে পারছিনা। দিদি কাঁদছে আর বলছে , না চিত্কার করছে,"মা নেই, আর নেই।" আমাদের অবিশ্বাসের ঘুম টা ভাঙ্গার চেষ্টায়ে ছড়াচ্ছে দিদি র চিত্কার । রাতের আকাশ নিস্তেজ , নিঃশব্দ হয়ে থাকল। কেউ শুনতে পারলেন না , অচেনা পাড়ায় যেখানে বহু বছর মা কে দেখেছে ওই অচেনা মুখ।
মা আর নেই।
মায়ের মতন আমি ও শান্ত , চুপচাপ আর অন্তর্মুখী । চিত্কার না করে ওর ফেরার অপেক্ষা করলাম। না আর ফিরবে না।
আমরা কি করব ঠিক করতে পারছিলাম না। তলায় গিয়ে কাছে পিটের এক দাদা কে খবর দিলাম। ও এক চিকিৎসক কে ডেকে আনে । আমাদেরকে নিশ্চিত করলো মা চলে গেছে। কাছে পিটের দাদা বলল মৃত মানুষ কে এরকম ছাড়া যায় না। সর্বপ্রথম আমরা মা কে হাসপাতাল নিয়ে যাব। ওখান থেকে ডাক্তারের প্রমাণ পত্র নিয়ে আসব । তার মধ্যে আমাদের আত্মীয় স্বজন দের খবর দেওয়ার জন্য বলল।
মায়ের যাওয়া আর আমাদের বেরুবার মধ্যে খুব একটা ব্যবধান ছিল না। আর এই সব ঘটলো রাত বারোটা র দিকে। বেরিয়ে পড়লাম রাত কে ভয়ে না পেয়ে। সরকারি হাসপাতালে পৌঁছে আমি মায়ের মৃত দেহের সাথে দাঁড়িয়েছি । ঠাণ্ডা মৃত দেহ টা স্থান পেল না কোনো বেঞ্চে বা খাটে। তলায় মেজে রাখা হল। পাসে কোনো রোগী র প্রস্রাবের গন্ধ আর কোনো রোগী র রক্ত দেখে আমি ঠাণ্ডা দেহের সাথে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি দিদির।
ওরা (দিদি, বাবা আর কাছে পিটের দাদা)ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। কে জানে মৃত প্রমাণ পত্র এইখানেই দেবে? জানিনা , এইতো প্রথম বার মা কে হারালাম। ওরা এল ডাক্তারের কাছ থেকে। না ডাক্তার প্রমাণ পত্র দেবেন না , যেহেতু মানুষ টি এইখানে মারা যায় নি। আমাদেরকে অন্তিম সংস্কার করা র পর পৌরসভার থেকে প্রমাণ পত্র নিতে বললেন।
আত্মীয় স্বজন দের কোনো খবর নেই। খবর না হওয়া টা স্বভাবিক। ফোন তুলে এই কথা বলা টা ও স্বাভাবিক যে এখন ওরা এত রাতে আস্তে পারবে না। সকালে আসবে। তবে সকাল অবধি মৃত দেহ টা এরকম পড়ে থাকবে? উচিত নয়। অন্তিম সংস্কারে আর দেরি না করাটাই ভালো। এখন কেউ এই কাজে র জন্য থাকবে বসে? চল দেখি। কোনো শব দাহ স্থানে।
নিশা ভেঙ্গে , গভীর ঘুম ছেড়ে ওরা ও যে এই কাজে র জন্য বেরুবে তা কি ভাবা যায়। সত্যি কার কখন যে কি হবে কেউ জানেনা, ভাবতে পারা যায় না। আমাদের ভাবনার চেয়ে বেশি ওরা দরকার মতন সজাগ থাকে ওই টা বুঝতে হবে। সংস্কারের কাজ করার জন্য সবাই ছিল। য্যানো ওরা জানতো এখন কোনো মানুষ ইহ লোক ছেড়ে যাবে , তাকে বিদায় জানাতে হবে।
দাহ সংস্কার হয়ে গেল। এত ক্ষণ যেই মৃত দেহ টা র সঙ্গে আমরা গহন রাতে ছিলাম সে ওই মূহুর্ত গুলো নিয়ে চলে গেল। আমাদের ছেড়ে ও সম্পূর্ণ চলে গেল। শুধু থাকল অস্থি আর খাক । এতদিন কার সুখ - দুঃখের আর যন্ত্রণা র জীবন আজ অগ্নি শিখা র সঙ্গে আকাশে বিলিন হয়ে গেল। খাকের সাথে আমাদের কাছে আরো কিছু থেকে গেল। ওর সুন্দর স্মৃতি , ওর থেকে পাওয়া শিক্ষা আর ভালোবাসা...
দাহ সংস্কারে কোনো বাধা- বিঘ্ন এল না। সত্যি আমাদের মা কোনো ঠাকুরের অবতার ছিলেন। ঠাকুর যে মাকে এতো ভালো বেসে নিজের কাছে টেনে নেবে তাই আজ দেখলাম। দুঃখ কিসের যদি ও মনে র কষ্টের শেষ নেই । একটা মানুষকে সর্বক্ষণের জন্য বিদায় জানিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। স্মৃতি আর ওর আমাদের উপর থেকে রক্ষা করছে বলে এই বিশ্বাস সমেত আমরা ওর স্বপ্ন পূরণ করব বলে সেই অগ্নি শিখায়ে শপথ নিয়ে এলাম।