লটারি
লটারি
আকাশের এক কোণে কোনমতে ঝুলছে সূর্যটা। মনে হচ্ছে এখনি টুপ করে পড়ে যাবে। ঘনিয়ে আসছে রাত। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরছে ছোট্ট লকাই। শীতে কাটা দিচ্ছে গায়ে। শরীরে হাত বুলোতে বুলোতে লকাই ওর বাড়িতে গেল। ওর বাড়ি বলতে বর্তমানে ওর সৎ মায়ের বাড়িটা। মানে যেখানে এখন ওর সৎ মা থাকে। লকাই ঢাকার এক বস্তিতে থাকে। বাড়িটা মূলত ওর বাবার নামে ছিল। ওর আপন বাবা-মা দুজনেই মারা গেছে।লকাই ওর সৎ মাকে দু চোখে একদম দেখতে পারেনা। সহ্য করবে কি করে? ও যে ওর আপন মা নয়। আপন মা হলে তো এত মার মারত না। একদিন ও ভালো কিছু খেতে দেয়না। যখন ওর আপন বাবা বেঁচে ছিল তখন এত মার মারত না।যেই ওর বাবা মারা গেল তখনই এই সৎ বাবাটা আসে। কিন্তু সেও তাকে বেদম মার মারে। তাই দুজনেই লকাইয়ের দুচোখের বিষ। বস্তির এই বাড়িটা লকাইয়ের কাছে দুঃস্বপ্নের রূপকথার রাক্ষসপুরীর মত মনে হয়।লকাই বস্তির বাড়িটায় পৌঁছে দেখে দরজা বন্ধ। তাই লকাই দরজায় দুটো টোকা দেয়। কিন্তু কেউ দরজা খোলে না। বস্তির পাশের মসজিদে আযান দেয়া হচ্ছে। মাগরিবের আযানের সাথে রাতের ঠান্ডাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। লকাই ডাক দেয়,-ওই সৎ মা দরজা খোল। ঠান্ডায় খাইয়া ফালাইলো।লকাই আবার দরজায় টোকা দেয়, কিছুক্ষণ পর ওর সৎ ভাই নাবিল দরজা খোলে। লকাইকে দেখেই বলে উঠে,-ও, তুই!-তাইলে আর কেডায় আইব এইহানে? বেরাক ওবামা?-কেডায় আইসে রে নাবিল? ্রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে লকাইয়ের সৎ মা আসমা বেগমের কন্ঠস্বর।-মা, লকাই আইসে।লকাই ঘরে ঢুকে। ঘরের মেঝেতে বিছানো চটের উপর বসে পড়ে।
পকেট থেকে মার্বেলগুলো বের করে খেলতে থাকে।রাতের বেলায় ওর সৎ বাবা-মা, ভাই মিলে খেতে বসে। লকাই বসে আছে ঘরের এক কোণে।হঠাৎ বলে উঠে,-আমারে খাইতে দিবা না?-তরে যে কইছিলাম ট্যাকা কামাইছস আজকা? বলে উঠে লকাইয়ের সৎ বাবা নাজিম উদ্দিন।-ট্যাকা! আমি কেমনে ট্যাকা কামামু? জিজ্ঞেস করল লকাই।-ক্যান! তরে না কইছি ভিক্কা করবি। কথা কানে যায় নাই তর?-ভিক্কা করতে আমার ভালা ঠ্যাকে না। আমি করুম না ভিক্কা।-ভিক্কা তুই করবি, তর মরা বাপ করব।-আব্বারে তুইল্লা কতা কইবা না কইয়া দিতাছি।আমি করুম না ভিক্কা।-তাহলে তর আর এহানে থাকা লাগব না। ভাগ এইহান থেইক্কা।-আমি ক্যানে যামু। আর কোনে যামু। এইডা আমার আব্বার বাড়ি। আমি ক্যান এই বাড়ি ছাইড়া যামু?-আসমা, তোমারে না কইয়া দিছি ট্যাকা না আনলে ওরে ঘরে ঢুকতে দিবা না।বাইর কইরা দেও ওরে।লকাইয়ের সৎ মা আসমা লকাইকে মারতে মারতে বের করে দিল ঘর থেকে। লকাই কান্না করতে করতে চলে এল বস্তির সেই বাড়িটা থেকে। না এলে হয়ত আরও দুঘা পড়ত পিঠে। চারদিকে প্রচুর ঠান্ডা। গা বরফ হয়ে যাবার দশা। দুর্দশা যেমন আঁধার কালো করে আসে তেমন দুর্দশাগ্রস্থ লকাইয়ের কাছে বৈদ্যুতিক আলোয় প্রজ্জ্বলিত শহরটাকে তেমনই কালো অন্ধকার মনে হল।হেঁটে হেঁটে লকাই বস্তি থেকে বেশ দূরেই চলে এলো। লকাই এখন মহাসড়কের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে। শীতের রাতে লকাইয়ের চোখের পাতা প্রায় লেগে এল বলে। ঘুমের চোখে লকাই ক্ষুধার কথা ভুলেই গেল।রাস্তায় কুঁড়িয়ে দুটো বস্তা পেল। আশপাশ থেকে একটা ইটও জোগাড় করল। ইটকে প্লাস্টিকের ব্যাগে মূড়িয়ে বানাল বালিশ।
আর বাকি প্লাস্টিকের ব্যাগটা কে বিছিয়ে তার ভেতরে শুয়ে পড়ল।সকালবেলা লকাইয়ের ঘুম ভাঙ্গে সবুজের ডাকে। সবুজ লকাইয়ের বন্ধু। সবুজের সাথে লকাই মার্বেল গুটি দিয়ে টোন খেলে। লকাইয়ের মত সবুজেরও মা-বাবা নেই। সবুজ রাস্তা থেকে কাগজ কুড়িয়ে তা বিক্রি করে টাকা আয় করে। সবুজ লকাইকে বলে,-কিরে মামু, তুই এইহানে শুইয়া আছস? ব্যাপার কি?সবুজের ডাকে লকাই আড়মোড় ভেঙ্গে উঠল।পাশে সবুজকে দেখে তাড়াতাড়ি চোখ কচলে নিল।সবুজকে দেখে একটু মুচকি হেসে বলল,-আরে সবজি, কি খবর? লকাই সবুজকে সবজি বলে ডাকে।-তোর লগে কদ্দিন পর দেহা। ম্যালা দিন পর। তাছাড়া তুই এইহানে কি করস?সবুজের কথায় কোন উত্তর দেয় না লকাই। চুপ করে থাকে। সবুজ লকাইকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলে,-কিরে লকাই, কিছু কস না ক্যা? তুই এইহানে ক্যা? তরে কি বাড়ি থিক্কা বাইর কইরা দিসে তোর মাও?-মা না, সৎ মা। তাও না। ওইডা আস্ত একখান ডাইনী। আমারে বাড়ি থিকা বাইর কইরা দিছে।-তুই আয়া পড়লি!ওইডা না তোর নিজের বাড়ি।
-না অইলে কি করতাম? বাপ-মা দুইজনেই তো গেসেগা। এহন ওই বাড়ি নিয়া কি করুম?-ক্যানে ওরা তোরে বাড়ি থিকা বাইর কইরা দিল?-সৎ বাপে কইছিল টাকা আনবার। তাও ভিক্কা কইরা। আমার ভিক্কা করতে ভালা ঠ্যাকে না। হেল্লাইজ্ঞা ভিক্কা কইরা ট্যাকা আনি নাই দিক্কা মাইরা ঘর থাইক্কা বাইর কইরা দিছে।-চাপ নিস না। তুই একদম ঠিক কাম করছস।-চাপ তো নিতেই অইব। ট্যাকা কামাইতে অইব। ম্যালা ট্যাকা কামাইতে অইব।-এত ট্যাকা দিয়ে তুই কি করবি রে লকাই।-কি করুম আর? আমি অই টাকা দিয়া একটা বাড়ি বানাইয়া আমি আর তুই থাকুম। তুই থাকবি তো আমার বাড়ি? আমার তো আর কেউ নাই।-হ। আমি থাকুম তোর লগে।-তারপর এক বান্ডিল ট্যাকা লইয়া গিয়া আমার বাড়িত গিয়া সৎ বাপ-মায়ের ্মুখে ছুইড়া মারুম।
আমিতো ওগো খাবার খাইছি। এর মূল্য দিতে অইব না।-তা তুই দিস পরে। তুই আমার লগে এক সাথে কাম করবি ঠিক আছে।-তোর লগে কাম করমু? হেই কাম কইরা অত ট্যাকা পাইতে ম্যালা দিন লাগব। কিন্তু আমার তো তাড়াতাড়ি ট্যাকা কামাইতে অইব। তুই কুনো বুদ্ধি দিবার পারস রে সবজি?সবুজ একটু মাথা চুলকে বলে, একটা বুদ্ধি আছে।-কি বুদ্ধি?-লটারি।-এইডা আবার কি?-এমা, লটারি মানে জানস না?-উঁহু-লটারি হইল ট্যাকার মত দেখতে একখান কাগুজ। এইডা দিয়া ম্যালা ট্যাকা পাওন যায়।এই কাগুজে একটা নাম্বার দেয়া থাকে। এই নাম্বার মিল্যা গেলে ট্যাকা পাওয়া যায়। কেউ কেউ তো ৫০ লাখ আবার এক কুটি ট্যাকাও পায়।-তাই নাকি। তাইলে লটারিই হইব আমার রোজগারের রাস্তা।সবুজের কথা লকাইয়ের কাছে মেঘ না চাইতেই জলের মত বিনা পরিশ্রমে নিজের আশা পূরণের মত মনে হল।
লকাই জিজ্ঞগেস করল,-আরে সবজি এই লটারি কোনে পাওয়া যায়?-আরে মিষ্টির দোকানের গোরায় একটা মোড় আছে না। ওইডার শেষে মাথায় গলির কাছে এক লোক রিশকায় কইরা লটারি বেচতাছে। কাইল্কাই ড্র হইব। কিনবি নাকি?-হবলেই লকাই ভো দৌড় দিল।এক দৌড়েই রিক্সাটার কাছে পৌছে গেল।লকাই লোকটির কাছে গিয়ে বলল,-আমারে একটা লটারি দেন।-লটারি তো দেয়া যায়না।
লটারির টিকেট দেয়া যায়।-তাইলে ওইডাই দ্যান।-২০ টাকা দাও। আর লটারি নিয়ে যাও। কালকেই ড্র।লকাই নিজের প্যান্টটা আঁতিপাঁতি করে খুজে ০৩টা পাঁচ টাকার নোট বের করে বিক্রেতাকে দিল। বিক্রেতা টাকা নিয়ে লকাইকে লটারির টিকেট দিলেন। কিন্তু টাকা গুনে বিক্রেতা দেখলেন পাঁচ টাকা কম আছে। লোকটা লকাইকে বললেন,-একি ছোকরা পাঁচ টাকা কম দিয়েছ যে!-আমার কাছে তো আর ট্যাকা নাই।-টাকা নাই তাহলে লটারি কিনতে আইছস ক্যান? হয় বাকি টাকা দে আর নয়ত লটারি ফেরত দে।-না, আমি এই লটারি ফেরত দিমু না।বলেই লকাই প্রাণপণে দৌড় দিল। পিছনে পিছনে বিক্রেতাসহ আরও তিন-চারজন লকাইকে ধাওয়া করল। তা দেখে লকাই আরো জোরে দৌড়াতে লাগল।
একসময় লকাই রেলষ্টেশন এ ঢুকে পড়ল। লকাই পিছনে ফিরে তাকাল। ভীড়ের মধ্যে মিশে যাবার ফলে লোকগুলো লকাইকে ধরতে পারল না।লকাই লটারির টিকেটটা হাতে নিয়ে আলতো করে ধরে আপন মনে বলল, ‘আমার লটারি। এইডাই আমার জীবন বদলাইব। সৎ বাপ-মায়ের মুখে এইডা দিয়াই ট্যাকা ছুইড়া মারুম।’ এমন সময় এক যাত্রীর সাথে ধাক্কা লেগে লটারিটা হাতছাড়া হয় লকাইয়ের। এমন সময় একটা ট্রেন ছুটে যায় রেললাইনের উপর দিয়ে। ট্রেনটির গতির কারণে বাতাসের প্রভাবে রেললাইনের দিকে উড়ে যায় টিকিটটা। লকাই বলে উঠে,‘আমার লটারির কাগুজ।’কোনকিছু না ভেবেই লকাই রেললাইনের দিকে দৌড় দেয়। লকাই দৌড়ে যায় রেললাইনের ট্র্যাকের উপর দিয়ে লটারিরি টিকেটটা কে ধরার জন্যে।
এমন সময় হঠাৎ ট্রেনের চাকার গা রিরি করা হার্ডব্রেক এর শব্দ শোনা যায়। সাথে থ্যাচ করে একটা শব্দ। মুহুর্তের জন্যে সমস্ত কোলাহল থমে যায়। তারপর রেলস্টেশনে আবার শুরু হয় মৃদু গুঞ্জন। কোলাহলের মাঝেই লকাইয়ের টিকেটটা উড়ে যাই পশ্চিমাকাশে। তবে লকাইয়ের নিথর দেহটা পড়ে থাকে রেললাইনের লোহার পাতের উপর। আর চোখ দুটো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লটারির সেই টিকিটটার উপর। এখনও যেন হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায়!